গৃহত্যাগী [Bangla Story]

সবেমাত্র জিয়ার বিয়ে হয়েছে লাবণীর সাথে। দুজনে মিলে সংসারটাকে গোছাতে না গোছাতেই মাস ছয়েক পরে জিয়ার মনোজগতে কি এক আশ্চর্যজনক পরিবর্তন সাধিত হয় তা বোঝার সাধ্য সয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারোই নেই।

 

একদিন জিয়া লাবণীকে বলে,

 

- আমি গৃহত্যাগ করব।

 

- গৌতম বুদ্ধ হবার সাধ জেগেছে নাকি মনে? লাবণী ঠাট্টার ছলে খিলখিল করে হেসে বলে।

 

কিন্তু জিয়া সত্যিই বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই বলেছে। যদিও সে লাবণীর হাসির জবাবে কিছুই বলেনি। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লাবণী জিয়াকে সারা ঘর খুঁজেও কোথাও না পেয়ে ফোন করে। ফোনের রিং বাজে ঠিকই কিন্তু জিয়া কলটি কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে রাখে। এরপর অনেকবার ফোন করতে চাইলেও কোনও লাভ হয়নি। লাবণীর মনে হয় যে জিয়া নিশ্চয়ই তার সাথে রসিকতা করছে!

 

        হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর একটি কাগজের দিকে নজর পড়ে লাবণীর। সে আলোর মত গতিতে ছুটে গিয়ে সেটি হাতে নেয়। সেখানে জিয়ার হস্তাক্ষরে লিখা কয়েকটি লাইন- লাবণী, আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আমাকে যেতেই হল। আমি জানি তুমি হয়তো আমাকে অভিশাপ দেবে; হয়তো আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চাইবে না। কিন্তু আমার মনের ভেতর এক আশ্চর্যজনক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যা আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না। এটা বোঝানো যায় না। আমি জানি না আবার কভু তোমার সাথে আমার দেখা হবে কিনা। তবে এটুকু জেনে রেখো যে আমি তোমাকে কখনও ঠকাবো না। আমি জীবনের আসল স্বরূপ অনুসন্ধানে বের হয়েছি। ভালো থেকো। তোমার জিয়া!

 

        মোমবাতি যেমন নিভে যাবার আগে ধপ করে জ্বলে উঠে, ঠিক তেমনি যেন লাবণীর আত্মা তার দেহ থেকে বের হয়ে গেছে। তার আবেগ, অনুভূতি কিছুই যেন নেই! যেন একটি সাদা কাগজ, সেখানে কিছুই নেই!

 

        খানিক বাদে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে তার মাকে ফোন করে কাপড়চোপড় নিয়ে সেখানে চলে যায়। ইতোমধ্যে লাবণী অন্তঃসত্ত্বা হয়। তার গর্ভের সন্তানের জনক জিয়া। কিন্তু আমাদের সমাজে স্বামীহীন স্ত্রীকে বৈঠা ছাড়া নৌকার মতই মনে করা হয়! বৈঠাহীন নৌকা যেমন নদীতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায়, ঠিক তেমনি স্বামীহীন স্ত্রী সংসার সাগরে অনেক কষ্ট সহ্য করেই নৌকার মত এদিক ওদিক ভেসে বেড়ায়!

 

        কষ্ট হলেও সময়ের সাথে সাথে লাবণী জিয়ার অনুপস্থিতিকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু যখন তার একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়, তখন যেন জিয়ার না থাকার চেয়েও সন্তানের জন্ম হওয়াটাই অবর্ণনীয় বেদনার বিষয় হয়ে উঠে।

 

        সমাজের লোকে লাবণীকে দেখলেই সন্দেহের চোখে তাকায়; তার মেয়েকে নিয়ে বাঁকা কথা বলে। লাবনী বাচ্চা নয়; সে বুঝতে পারে যে লোকেরা ভাবছে এই কন্যা নিশ্চয়ই কোনও অবৈধ মেলামেশার ফসল। এখন লাবণীর এলাকায় থাকাটাই অসহ্য মনে হতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে লাবণীর মনে হয় আজ যদি জিয়া পাশে থাকতো, তবে কারোই সাহস হত না এমন অপবাদ দেবার। অবশেষে লাবণী ও তার মা বাসা পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যায়।

 

        দেখতে দেখতে পাঁচ বছর চলে যায়। সময় এতো দ্রুত যায় কিভাবে? পাঁচ বছর তো নয়, যেন পাঁচটি দিন গেছে! লাবণী ভাবে যে কিছুদিন তার মাকে নিয়ে শান্তিপুর গ্রামে থেকে আসবে। গ্রামে যাবার পর লোকমুখে জানতে পারে যে কোনও এক সাধু বাবা নাকি নদীর ধারের সুপ্রাচীন বটবৃক্ষের তলে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁকে ঘিরে নাকি শত শত মানুষের ভিড়।

 

        একদিন বিকেলে বাতাস যখন লাবণীর কাজলের মত কালো চুল নিয়ে খেলা করছিল, তখন কেন জানি তার মনে হয় যে মেয়ে আরশিকে নিয়ে একবার ঐ সাধু বাবার কাছে গেলে কেমন হয়। যদিও সে এসবে কখনও বিশ্বাস করে না, তারপরও গেলে তো কোনও ক্ষতি বা দোষ নেই।

 

        আরশি তার মায়ের হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে হেঁটে সেই বিশাল বটগাছের নিচে গিয়ে উপস্থিত হয়। ছোট্ট আরশি এতো মানুষের ভিড় দেখে ভেবেছে এখানে হয়তো কোনও মেলা হচ্ছে! যাইহোক, আরশিকে কোলে নিয়ে লাবণী অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে সাধু বাবার সামনে যায়।

 

        সাধু বাবাকে দেখেই শ্রদ্ধায় লাবণীর চোখে পানি চলে আসে। তাঁর মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল আর মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ির মাঝে তাঁর চেহারা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। তিনি ধ্যানরত বুদ্ধের মত বসে আছেন।

 

        লাবণী একেবারে সন্নিকটে গিয়ে শ্রদ্ধাভরে সাধুর পা স্পর্শ করতেই তিনি চোখ খুলে তাকান। এ স্পর্শ যে তাঁর অতি পরিচিত; এ স্পর্শ যে তাঁর অতীতকে সিনেমার রিলের মত তাঁর চোখের সামনে নিয়ে এসেছে অনেক অনেক সুখময় এবং দুঃখভরা স্মৃতি! লাবণী তখনও তার মাথা নিচু করেই হাঁটু গেড়ে বসা। দেখে মনে হয় যেন কৃষ্ণের মূর্তির সামনে মীরা বসে আছে! 

 

        সাধু বাবা হাত বাড়িয়ে লাবণীর চিবুক স্পর্শ করে তার মুখটা দেখে এবং বলে, লাবণী! আমি জীবনের স্বরূপ আজ এখানে, এই মুহূর্তে পেয়েছি!

View kingofwords's Full Portfolio
tags: