পাশের ঘরে একজন নতুন ভাড়াটে এসেছেন। দেখতে একেবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন। ইয়া লম্বা দাড়ি; চুলও অনেক লম্বা। পরনে একটি সাদা রঙের পাঞ্জাবি। লোকে দেখলে দুটি চিন্তার উদয় হবে মনে- হয় লোকটা বদ্ধ পাগল, নয় অসম্ভব মেধাবী কোনও লেখক! সে যাই হোক, সেই নামহীন বাউণ্ডুলের মত দেখতে মানুষটির সাথে যেদিন প্রথম কথা হলো, সেদিনই জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা লাভ করেছি বলা যায়। কথাবার্তায় এতো অমায়িক মানুষ এর আগে আমি দেখিনি! ওনার বসার ভঙ্গিমা, কথা বলার ধরণ সবকিছুই আমার কাছে গৌতম বুদ্ধের কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো।
আসলে সেদিন সিঁড়ি ভেঙে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দেখি ঐ নামহীন ভদ্রলোক তার দরজার তালা খুলতে রীতিমত যুদ্ধ করছেন। তার চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা থাকা সত্ত্বেও কেন জানি তিনি যতবার চেষ্টা করলেন, ততবারই বিফল হলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে সেই অচেনা অজানা লোকটির উপর এক প্রকার মায়া অনুভব করলাম; মনে হল যেন তিনি আমার চেনা কোনও আত্মীয় যাকে সাহায্য করলে আমার বেশ ভালোই লাগবে। আমি বললাম,
- কিছু মনে না করলে আমাকে চাবির গোছাটা দিন। আমি একটু চেষ্টা করে দেখি।
- না, না, থ্যাংক ইউ। আমিই পারবো।
- আহা! দিন না! আমি খুলে দিচ্ছি!
- বেশ! তবে তাই হোক।
তালাটা খুলে দিতেই তিনি আমাকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রথমে আমি একটু ইতস্তত করলেও পরে রাজি হলাম। তিনি আমাকে বসতে বলে ভেতরের কক্ষে গেলেন। ঘরে কক্ষ সর্বসাকুল্যে দুটি। রান্নাঘর আছে তাও বেশ ছোট। আসলে ব্যাচেলরদের জন্য এমন ঘরই পারফেক্ট।
আমি যে কক্ষটিতে বসে ছিলাম সেটির আশেপাশে দৃষ্টি ঘোরাতেই লক্ষ্য করলাম যে দেয়ালে চমৎকার সব পেইন্টিং ঝুলানো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কার্ল মার্ক্স, ভিঞ্চির মোনালিসা, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ। সবাই যেন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! যেন আমি কোনও বন্দী আসামি এবং সেইসব কৌতূহলী চোখগুলো আমার দিকে সন্দেহপ্রবণভাবে তাকিয়ে আছে!
তবে সেসব ছবির মধ্যে যে ছবিটি আমাকে অবাক করল তা হল মেরিলিন মনরোর সেই বিখ্যাত ছবিটি যেটিতে উচ্ছ্বসিত মনরোকে বাতাসে উড়ে যাওয়া স্কার্ট সামলাতে দেখা যায়! আমি মনে মনে ভাবলাম যে লোকটি ফিরে আসলে আমি এ ছবিটি রাখার পেছনের কারণটি তার কাছ থেকে অবশ্যই জানতে চাইবো।
কক্ষটিতে একটি কোণায় ছিল একটি বইয়ের তাক। আমি সেটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বইয়ের সংগ্রহের দিকে একটু চোখ বুলাতে থাকলাম। আমি শিশুর মতই মুগ্ধ হলাম যখন অসাধারণ সব বইয়ের সম্ভার দেখলাম সেই মোটামুটি দেখতে বইয়ের তাকে! কি ছিল না সেই তাকে! রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, হোমার, ভার্জিল, সেনেকা থেকে শুরু করে আধুনিক কালের লেখক ও সাহিত্যিকদের এক আশ্চর্য মিলনমেলা যেন সেই বইয়ের তাক। রবীন্দ্রনাথের “গল্পগুচ্ছ” হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই বুঝলাম যে বইটি সম্ভবত সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান থেকে কেনা। তখনই সেই লোকটির উপর আমার একটু করুণা হল। হয়তো নতুন বই কেনার মত তার এতটা সামর্থ নেই। কিংবা হয়তো আছে কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড বই পড়ার পেছনে তার কোনও স্মার্ট যুক্তি নিশ্চয়ই ছিল।
আমি জানি যে বইয়ের তাক থেকে কোনও বই হাতে নেবার পর সেটি আবার সেই স্থানেই সুন্দর করে রাখতে হয় কারণ এটি সাধারণ ম্যানার। বইটি নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে না রাখতেই পেছন থেকে লোকটির গলা খাঁকারির শব্দ কানে এল। তিনি বললেন-
- তোমার নামটাই জানা হলো না!
- আমি ফারদিন।
- আমি লালন।
- লালন?
- হুম! কেন? শুনে অবাক হলে মনে হচ্ছে?
- না, তেমন কিছু না!
- বই পড়ার অভ্যাস আছে নাকি?
- একটু একটু!
- কার বই পড়তে ভালো লাগে বেশী?
- শব্দরাজ নামে একজন লেখক আছেন। তার লেখা।
- শব্দরাজ তো তার ছদ্মনাম! প্রকৃত নাম জানো?
- হ্যাঁ, তাও জানি। আপনার বইয়ের সংগ্রহ দেখে আমি রীতিমত মুগ্ধ।
- কই! তেমন কোনও বইই তো নেই!
- আমি কি মাঝে মাঝে আপনার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়তে পারি?
- অবশ্যই! কেন নয়? তুমি বই পড়বে, আমরা মাঝে মাঝে চা খেতে খেতে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেব। বেশ ভালোই হবে।
- আসলে প্রথম সাক্ষাতেই আমি আপনার কাছ থেকে বই নেবার কথা বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেন না?
- না, না, এতো ফর্মালিটির কিছু নেই। আমি সত্যিই খুব খুশী হব। তবে আমার একটি ছোট্ট শর্ত আছে।
- কি সেটা?
- একটি বই নিতে পারবে। যেটি নেবে সেটি পড়া শেষ হলে আরেকটি নেবে। একবারে একটার বেশী বই নিতে পারবে না। ঠিক আছে?
- ও এই শর্ত! আমি ভাবলাম না জানি কি কঠিন শর্ত হবে!
- আজ তুমি চাইলে একটি বই নিতে পারো। নেবে?
- নিতে পারি।
- কোনটা নেবে?
আমি মনে মনে ভাবছিলাম জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” নেব; ঠিক তখনই লালন আমাকে বলল “একাত্তরের দিনগুলি” নিতে পারো; চমৎকার বই। আশা করি তোমারও ভালো লাগবে”। লালন বই সম্পর্কে কি প্রশংসাসূচক কথা বলছে সেখানে আমার মনোযোগ ছিল না কারণ আমি আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে আমার মনের কথা সে কিভাবে পড়ে ফেলল! একবার মনে হল বিষয়টা কাকতালীয়, আবার মনে হল লোকটি কোনও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কেউ নয় তো? আমি আর কথা না বাড়িয়ে ‘ধন্যবাদ’ বলে বইটি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।
সেইদিনই বইটি পড়তে শুরু করলাম; বইটি খুব বেশী বড় নয় তবে প্রচুর তথ্য সমৃদ্ধ। যেহেতু বইটি ডায়রির আদলে লেখা সেহেতু এটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি অসাধারণ দলিল হয়ে আছে। আমি যত পড়লাম ততই মুগ্ধ হলাম। জাহানারা ইমামের ছেলে রুমীর অসীম সাহসিকতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, তার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ ইত্যাদির বর্ণনা পড়তে পড়তে আমার নিজেকে রুমী বলেই মনে হচ্ছিল! অনেক পৃষ্ঠা পড়ার পর যখন ঘুমাতে গেলাম তখন মনে হলো যে দেয়ালে টানানো মেরিলিন মনরোর সেই বিখ্যাত ছবিটির কথাতো জিজ্ঞেস করাই হল না! ভাবলাম আগামীকাল দেখা হলে কারণটা জেনে নেবো।
ঘুমে আমি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম! আমি একটি কক্ষের ঠিক মাঝখানে মেঝেতে শুয়ে আছি; আমার চারপাশে শুধু বই আর বই। দেশ বিদেশের মূল্যবান সব বইয়ের মাঝখানে আমি। যেন এই বইগুলো আমাকে কোনও বাজে বা খারাপ কিছু থেকে সুরক্ষা করছে; যেন আমি একটি সুরক্ষিত দুর্গের মাঝখানে আছি; বইগুলো যেন একেকটি ফেরেশতা! স্বপ্নে আমি একটি বই পড়ছি কিন্তু মলাটে সেই বইয়ের নামটি শত চেষ্টা করেও দেখতে পাচ্ছি না! এমন সময় কার পদধ্বনিতে আমার ঘুম ভেঙে যায়!
হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে বাইরে বের হবার সময় দেখি লালনের ঘরের দরজায় তালা। আমি ভাবলাম হয়তো বাইরে কোনও কাজে গেছে ফিরে এসে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে; তখন সাহিত্য নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাবে। যেহেতু সে অনেক বই পড়েছে, সেহেতু তার কাছ থেকে নানান বিষয়ে প্রচুর জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা শোনা যাবে। আমি নানান ব্যস্ততায় বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হল। তখন এগারোটা বাজে; বাসার দিকে যেতে দেখি তখনও লালনের ঘরে তালা। একটু চিন্তা এসে কালো ছায়ার মত চাদর বিছিয়ে দিল যেন আমার মনে। যেহেতু লালন একা মানুষ; তার বয়সও অনেক হলো, তাই আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো। তার ফোন নাম্বার থাকলে অবশ্যই কল করে খবর নিতে পারতাম। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়।
সেই মুহূর্তে আমাদের বিল্ডিং-এর দারোয়ান আক্কাসকে দেখতে পেয়েই লালনের কথা জিজ্ঞেস করলাম। আমি জানতে চাইলাম যে ইতোমধ্যে সে বাসায় এসেছিল কি না। আমার কথা শুনে আক্কাস যেন ছিটকে পড়া ধূমকেতুর মত আছড়ে পড়লো। সে বললো যে আমার কথা নাকি সে কিছুই বুঝতে পারেনি! এ ঘরে নাকে কোনও নতুন ভাড়াটে আসেনি! যখন আমি তাকে বললাম যে এই ঘরে গতকাল লালন নামে একজন ভাড়াটে ছিল; তার সাথে আমার কথা হলো; সে আমাকে একটি বইও দিলো পড়ার জন্য! আক্কাস এসব কথা শুনে আর কথা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়লো। আক্কাসের চোরের মত পালিয়ে যাবার ধরণ দেখে মনে হলো যেন সে আমাকে পাগল ভাবছে!
আমি ঝড়ের মত দৌড়ে আমার কক্ষে গিয়ে লালনের কাছ থেকে আনা বইটি খুঁজতে লাগলাম কিন্তু পেলাম না! তখনই আমার মনে হলো এসবই স্বপ্নের অংশ নয়তো! তবে কি আমার সাথে লালনের সাক্ষাত বাস্তবে হয়নি? দু বছর পর আমরা বাসা পরিবর্তন করে অন্যত্র যাবার প্রস্তুতি নেবার সময় আমি আমার বইপত্র আর কাপড়চোপড় গোছানোর সময় হঠাৎ মেঝেতে একটি বই পড়লো। আমি বইটি তুলে রাখতে গেলাম এমন সময় দেখলাম বইটির নাম “একাত্তরের দিনগুলি”! মলাট উল্টাতেই পৃষ্ঠার ডানদিকে কোণায় চোখে পড়লো হাতে লেখা একটি নাম- ‘লালন’!