এক বিশাল দৈত্যের মতন বটবৃক্ষের কাছে এসে রবীন্দ্রনাথ পরম মমতাভরা চোখে গাছটির সমস্ত দেহের উপর নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অনেক দূর থেকে হেঁটে আসার ফলে রবীন্দ্রনাথ বেশ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। ক্ষণিকের বিশ্রামের তরে তিনি বট গাছের কোলে বসতে যাবেন এমন সময় বজ্রের মতন কণ্ঠে গাছটি তাকে প্রশ্ন করে,
- তোমার নাম কি?
- আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। তোমার নাম?
- আমার ডাকনাম ‘বট’। কেউ কেউ আমাকে ‘মহীরুহ’ বলেও সম্বোধন করে! আমার চামড়ায় যেমন রেখা বিদ্যমান, ঠিক তেমনি রেখা তোমার মুখ-মণ্ডলেও দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ কি?
- কারণ আমার বয়স হয়েছে!
- মানে? ঠিক বুঝলাম না!
- মানে আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি।
- আচ্ছা, আমরা গাছেরা মারা গেলে মাটির সাথে মিশে যাই, বা তোমরা মানুষরাই হয়তো আমাদের শাখা প্রশাখা কেটে নিয়ে পঙ্গু করে দিয়ে সেইসব কাঠ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করো ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ মারা গেলে কি হয়? ওরা কোথায় যায়?
- এই প্রশ্নের উত্তরতো এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়!
- আমার তেমন একটা তাড়া নেই! তোমার উত্তর যত দীর্ঘই হোক না কেন, আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শ্রোতার মতন শুনবো!
- কিন্তু বন্ধু, আমার উত্তর শোনার জন্য অফুরন্ত সময় তোমার আছে ঠিকই, তবে আমার যে বলার জন্য এতো সময় নেই!
- মানে?
- মানে হচ্ছে এই যে তুমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো, তোমাকে কোথাও যেতে হয় না, নড়তে চড়তে হয় না, কিন্তু আমিতো মানুষ তাই না? আমার যে অনেক অনেক ব্যস্ততা!
- মানুষের কি এমন ব্যস্ততা থাকতে পারে? আচ্ছা, তুমি কি করো?
- আমি লেখালেখি করি, অর্থাৎ আমি একজন লেখক।
- ‘লেখালেখি’? লেখালেখি কাকে বলে?
- এই যে আমি তোমার সাথে কথা বলছি, এর নাম হচ্ছে ‘কথোপকথন’; ঠিক একইভাবে আমি যদি কোনও কথা কাগজে লিপিবদ্ধ করি তখন সেটির নাম হবে ‘লেখা’। আশা করি বুঝতে পেরেছো?
- বুঝেছি, তবে পুরোটা নয়, আংশিক!
- আংশিক কেন?
- কারণ ঐ যে তুমি ‘কাগজ’ না কি একটা বললে, সেটা কি?
- কাগজ তৈরি হয় গাছ থেকে। নানান বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবার পর অবশেষে কাগজ সৃষ্টি হয়। সেই কাগজে কলম ঘষে ঘষে অসাধারণ সব গল্প, গান, উপন্যাস, কালজয়ী সাহিত্য রচনা সম্ভব।
- তার মানে আমাদেরকে অর্থাৎ গাছকে হত্যা করেই তোমরা লেখার সরঞ্জাম সংগ্রহ করেই চলেছো তাই না?
- হ্যাঁ, অনেকটা তাই।
- তার মানে তোমরা মানুষরা আসলে হিংস্র প্রকৃতির প্রাণী!
- ‘হিংস্র’? এ কথা বললে যে?
- হিংস্র নয়তো কি? আমরা গাছেরা কি কখনও তোমাদেরকে হত্যা করি, তাহলে তোমরা কেন যুগের পর যুগে আমাদের প্রাণ হরণ করে চলেছো? এ কথার কি কোনও উত্তর আছে তোমার কাছে?
- দেখো বট, এটাকে হিংস্রতা বলাটা সমীচীন হচ্ছে না। এটা প্রয়োজন। মানুষ তার অস্তিত্বের স্বার্থে, সভ্যতা এগিয়ে নেবার স্বার্থে এসব করছে। তাছাড়া দেখো একটি মাছ কিন্তু আরেকটি মাছকে হত্যা করেই বেঁচে থাকতে চায় এবং থাকে; ঠিক একই বিষয় পশুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ধরো একটি গরু যদি ঘাসের সাথে বন্ধুত্বে জড়ায়, তখন সে কি খেয়ে বাঁচবে?
- হুম! তোমার কথায় যুক্তি আছে বৈকি! ঠিক আছে আমি আর এ ব্যাপারে কোনও তর্কে জড়াতে চাই না। আমি এও জেনেছি যে তুমি অনেক ব্যস্ত, তোমাকে অনেক কায করতে হয়। তবে যাবার আগে তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আশা করি এর একটি সুন্দর উত্তর তুমি দেবে।
- ঠিক আছে, চেষ্টা করবো।
- মাঝে মাঝে কিছু প্রবীণ মহিলা ও পুরুষ আমার সুশীতল ছায়াতলে বসে শিশুর মতন কাঁদতে থাকে। কান্নারত অবস্থায় ওরা ওদের সন্তানদের নামে নিন্দা করে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের মৃত্যু কামনা করে কারণ ওদের সন্তানেরা নাকি ঐ বয়স্ক লোকদেরকে কুকুর বিড়ালের মতন ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তোমরা মানুষরা এতোটা নির্মম হও কি করে? আমার ডালে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনও পাখি কিংবা প্রজাপতি বসে থাকে, বিশ্রাম নেয়, বাসা বেধে থাকে, আমিতো তখন তাকে ঘৃণা করি না, বরং ওরা যেন সবসময় আমার সান্নিধ্যে থাকে মনে প্রাণে আমি সেই কামনাই করি। দেখো, ঐসব প্রজাপতি, পাখি ইত্যাদি কিন্তু আমার আত্মীয় স্বজন নয়, তাদের সাথে আমার কোনও শিকড়ের সম্পর্কও নেই, তবুও তাদের প্রতি আমি সীমাহীন ভালোবাসা অনুভব করি। এই ভালোবাসা, এই স্নেহ, এই মায়া, এই মমতা মানুষের মনে এতো কম কেন? তোমরাতো সৃষ্টির সেরা জীব, তাই না? আমরা গাছেরা আমাদের সারা জীবন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু অন্যের তরে নিজেকে বিলিয়েই যাই, কিন্তু বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে এই একই ধরণের প্রবণতা দেখতে পাই না, এর কারণটা কি?
- হে মহীরুহ, একটি প্রশ্ন করতে গিয়ে তুমি বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছো। হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে এখানে একমত যে আমরা মানুষেরা এখনও লোভ, লালসা, হিংসা ইত্যাদির উর্ধে উঠতে পারিনি। প্রযুক্তিগতভাবে আমরা অনেক অনেক দূর এগিয়েছি এ কথা সত্যি, তবে উদারতা, মানবতা, ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা অনেক অনেক পিছিয়েছি। আসলে আমরা মুখে বলি যে ‘সভ্যতা’ এগিয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে সভ্যতা একটুও এগোয়নি। সভ্যতা তখনই এগিয়ে যায়, যখন মানুষের মানবীয় গুণাবলীগুলো সূর্যের আলোর মতন চারপাশে আলো ছড়ায়! হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা বৃদ্ধ পিতা মাতাকে বোঝা মনে করে। সেইসব সন্তানদের আচার আচরণ দেখে মনে হয় যেন ঐ প্রবীণ পিতা মাতা মানুষ নয়, যেন তারা সিসিফাসের ঘাড়ের বিশাল ও ভারি পাথরের গোলকের মতন! আর এ কারণেইতো আমি ‘কলম’ হাতে নিয়েছি যাতে আমি সমাজের সকল অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারি। আমার বই পড়ে যদি একজন মানুষও আলোর দেখা পান, আমার উপন্যাস বা নাটকের কোনও চরিত্রের করা মারাত্মক ভুল যদি একজন মানুষকে সাবধানী হতে শেখায়, যদি তার বিবেক জাগ্রত হয়, যদি সে সত্যিকারের ‘মানুষ’ হতে চেষ্টা করে, তবেই আমার চেষ্টা সার্থক হবে বলে আমি মনে করি। তোমার শেষ প্রশ্নের উত্তরে আমি বলতে চাই যে মানুষ যদি তার মন থেকে হিংসা ও লোভ নামক বিষাক্ত সাপ দুটোকে বিতাড়িত করতে পারে, তবে সমাজ ও সভ্যতা প্রকৃত অর্থেই অনেক দূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। আসলে সবকিছুর মূলেই রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ!
- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ হে বন্ধু!
- তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। ভালো থেকো। আবার হয়তো দেখা হবে।
রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে শুরু করেন। বটের ডালে বসে মধুর মতন মিষ্টি কণ্ঠে একটি কোকিল একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। হয়তো বটগাছটি কোকিলকে বলেছে বিদায়বেলায় রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে গান গাওয়ার জন্য! ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথের পিঠে কেউ একজন হাত রাখেন, রবীন্দ্রনাথ শত চেষ্টা করেও পেছন ফিরে তাকাতে পারেন না, তাঁর পেছনে কে দাঁড়িয়ে আছে সেটি জানার তাঁর প্রবল সাধ থাকা সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই পেছনে ফিরতে পারছেন না! তবে তিনি সেই মানুষটির কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন; কণ্ঠটি সুমিষ্ট, একজন নারীর, ঠিক যেন ঐ কোকিলের গানের মতন গলার স্বর!
রবীন্দ্রনাথের নিদ্রা ভঙ্গ হয়; চোখ খুলেই তিনি কাদম্বরী দেবীকে দেখতে পান। কাদম্বরী পরম আদরে আলতো করে রবীন্দ্রনাথের কপালে হাত রাখেন। রবীন্দ্রনাথ অবাক হন; মৃণালিনীকে ডাকতে চেয়েও তাঁর মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয় না! রবীন্দ্রনাথ সক্রেটিসের মতন গভীর মনোযোগের সাথে ভাবেন- তাহলে এতক্ষণ কি তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন? কাদম্বরীতো কয়েকদিন আগেই মৃত্যুবরণ করেছে! এটা পরকাল নয়তো? নাকি এটাই প্রকৃত স্বপ্ন? নাকি মানবজীবনটা কেবলই স্বপ্নের ভেতরে অজস্র স্বপ্নের মায়াজাল! কে জানে?