সবেমাত্র জাকির এবং সালেহার বিয়ে হয়েছে। আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। বেশ ছোটখাটো সাজানো সংসার। জাকিরের একটি মোবাইল ফোনের দোকান আছে। সালেহা ঘর সামলানোতেই ব্যস্ত থাকে।
জাকিরের মোবাইল ফোন বিক্রির ব্যবসা খুব ভালো না চললেও সংসারে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে না। সে নিজেকে সবসময় একজন আদর্শ স্বামী হিসেবেই সালেহার সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে এবং এই দিক থেকে তাকে সফলও বলা চলে।
স্ত্রীর সকল ছোট বড় চাহিদা পূরণ করা, তাকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া, মাঝে মাঝে সুরমা নদীর ধারে মিষ্টি বিকেলে গরম গরম চটপটি আর ফুচকা খাওয়া ইত্যাদি কাজগুলো জাকির অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সে কখনই এমন কিছু করে না যা করলে সালেহার মন খারাপ হয়। যদিও তার ধূমপানের বদ অভ্যাস ছিল, কিন্তু বিয়ের পর সালেহার অনুরোধে সেটিও বাদ দিয়ে দিয়েছে।
নদী যেমন বইতে বইতে সাগরে পড়ে, তেমনি দিন গড়াতে গড়াতে মাসে গিয়ে পড়ে। একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে সালেহা লাজুক কণ্ঠে জাকিরকে বলে,
- এই, শুনছো!
- কিছু বলবে?
- বলছিলাম কি আমাদের ঘরে একটি নতুন অতিথি আসলে কেমন হয়?
- নতুন অতিথি মানে? ঠিক বুঝলাম না! একটু খুলে বলতো!
- উফ! তুমি না একদম বোকা! কিছুই বোঝো না!
- আরে বাবা! খুলে না বললে বুঝবো কি করে?
- মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে আমরা একটি বাচ্চা নিলে কেমন হয়?
- ও, তাই বলো! আমি আবার কি না কি ভেবে বসেছি!
- আচ্ছা আমার কথার উত্তর দাও!
- আরও কিছুদিন পরে এসব নিয়ে ভাবলে ভালো হয় না?
- কিছুদিন পর করতে করতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। তুমি যে সময়টা দোকানে থাকো, তখন বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে আমার সময় খুব দ্রুত কেটে যাবে। তাছাড়া ছোট্ট বাচ্চা আমার খুব প্রিয়!
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমার কোনও আপত্তি নেই।
অতঃপর সালেহা সন্তানসম্ভবা হয়। সাত মাস পর সে একটি চাঁদের মত সুন্দর কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। ঘরের প্রতিটি অংশে আলোর মতন আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। জাকির এবং সালেহা দুজনই অনেক অনেক খুশী।
কিন্তু তাদের এই সুখ ক্ষণস্থায়ী; তারা জানে না যে তাদের জন্য সীমাহীন দুর্দশা অপেক্ষা করে আছে। ঠিক যেমন হাওয়া (আঃ)কে শয়তান প্ররোচিত করেছিল, এবং স্বর্গ হতে আদম এবং হাওয়া (আঃ)কে বিতাড়িত হতে হয়েছিল, ঠিক তেমনি এক মানুষরূপী শয়তান খুব শীঘ্রই জাকির এবং সালেহার বাগানের মতন সুন্দর সংসারে দাবানলের মতন আগুন ছড়াতে অপেক্ষায় আছে। এই ক্ষেত্রে পার্থক্য এই যে শয়তান একজন মহিলাকে অর্থাৎ হাওয়া (আঃ)কে প্ররোচিত করেছিল, কিন্তু এখানে প্ররোচনার নির্মম স্বীকার হয় একজন পুরুষ যার নাম জাকির।
যাইহোক, সালেহা শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিশুটিকে আদর করতে করতে তার সময় কিভাবে যেন জাদুর মতন নিমিষেই চলে যায়! এদিকে জাকিরের দোকানের পাশেই আরেকটি মোবাইলের দোকান আছে। এই দোকানের মালিক মীর জাফরের কাছে জাকির যখন সন্তানের বাবা হবার সৌভাগ্যে খুশীতে মিষ্টি বিতরণ করতে যায়, তখন মীর জাফর কথায় কথায় জানতে পারে যে সালেহা সাত মাসেই সন্তান প্রসব করেছে।
“ওথেলো” নাটকে যেমন শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত ইয়াগো ওথেলোর কানে ঈর্ষার বিষ ঢেলে ওথেলো এবং ডেসডিমোনার স্বর্গের মতন সংসার নরকে পরিণত করেছে, তেমনি মীর জাফর একদিন জাকিরকে একান্তে ডেকে বলে,
- জাকির, তুমি আমার ভাইয়ের মতন। যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলি।
- কি যে বলেন না জাফর ভাই! আপনার কথায় মন খারাপ করবো কেন? প্লিজ বলেন।
- দেখো, আমি যতটুকু জানি একটা বাচ্চা দশ মাস দশদিন মায়ের পেটে থাকে, তারপর তার জন্ম হয়। কিন্তু তোমার মুখ থেকে যখন শুনলাম যে মাত্র সাত মাসেই তোমার মেয়ের জন্ম হয়েছে, তখন আমার মনে কেন জানি একটু খটকা লাগে!
- জাফর ভাই, আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন বলেনতো?
- আসলে আমি এর বেশী কিছু বলতে চাই না। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, আশা করি আমার কথার আসল অর্থ তুমি অনুধাবন করতে পেরেছো। যদি নাও বুঝে থাকো, আশা করি বাসায় গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি নিয়ে ভাবলেই সবকিছু পানির মতন তোমার চোখের সামনে পরিস্কার হয়ে যাবে। আমি তোমার ভালো চাই বলেই এই কথাগুলো বলেছি। তুমি আবার অন্য কিছু মনে করো না। এখন যাই তাহলে, ভালো থেকো। পরে কথা হবে।
মীর জাফর ঘোড়ার মতন বেগে দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যায়। ঐদিন দোকানের কোনও কাজেই আর জাকিরের মন বসে না। শুধু মাথায় দুটি জিনিস ঘুরতে থাকে- “সাত মাস” আর “দশ মাস দশদিন”! মীর জাফর যে তার কথার মাধ্যমে ঠিক কোন ইঙ্গিত দিতে চাইছে তা এখনও জাকিরের বোধগম্য হচ্ছে না! তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে দিয়ে সে বাসায় চলে যায়। কলিং বেল চাপতেই সালেহা ছোট্ট শিশু লায়লাকে কোলে নিয়ে এসে দরজা খুলতেই অসময়ে জাকিরকে বাসায় ফিরতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
- কি ব্যাপার জাকির, তুমি এখন বাসায়?
- কেন, এ সময়ে আসা কি নিষেধ নাকি?
- না, নিষেধ হবে কেন? সবসময়তো সন্ধ্যার দিকে দোকান বন্ধ করেই বাসায় আসো, তাই এই দুপুরবেলা তোমাকে দেখে প্রশ্নটা করেছি আর কি।
- ভালো লাগছে না, তাই চলে এসেছি।
- শরীর খারাপ লাগছে নাতো? দেখি জ্বর হয়েছে কি না?
- না, জ্বর আসেনি। এমনিতেই ভালো লাগছে না।
এই প্রথম জাকির তার আদরের কন্যা লায়লাকে কোলে তুলে না নিয়ে, একটু আদর না করেই ঘরের ভেতরে চলে যায়। ব্যাপারটি সালেহার দৃষ্টি এড়ায়নি; তবে সে জাকিরের মনের অস্বস্তির কথা ভেবে কিছু না বলাটাই বিচক্ষণ হবে বলে ভাবে।
জাকির হাতমুখ ধুয়ে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে এক হাত কপালে রেখে মীর জাফরের কথাগুলোর প্রকৃত অর্থ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে সালেহা টেবিলে ভাত দেবে কি না জানতে চাইলে জাকির হ্যাঁসূচক জবাব দেয়। কোনও বিজ্ঞানী একটি সমস্যা নিয়ে দিনের পর দিন ভাবতে ভাবতে যেমন তার সমাধান বের করে ফেলে, জাকিরও তেমনি মীর জাফরের কথার আসল মর্মার্থ আবিস্কার করতে সচেষ্ট হয়! সে বুঝতে পারে যে মীর জাফর জাকিরের স্ত্রীর বিবাহের পূর্বে কোনও ছেলের সাথে সম্পর্কের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছে; হয়তো এ ব্যাপারে সরাসরি বলতে তার দ্বিধা বা লজ্জা হচ্ছিলো বলেই পরোক্ষভাবে বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছে।
অজ্ঞতা হচ্ছে ম্যাচের কাঠির মতন যে নিজে জ্বলে আবার অন্যকেও জ্বালায়! জাকির ভাবে, ঠিকইতো, সাত মাসে বাচ্চা জন্ম হয় কি করে? সালেহা নিশ্চয়ই বিয়ের পূর্বে কারো শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলো। লায়লা কোনোভাবেই তার সন্তান হতে পারে না; নিশ্চয়ই লায়লার পিতা অন্য কেউ। এসব ভাবতে ভাবতে এক নারকীয় রাগে, ক্ষোভে এবং তীব্র কষ্টে জাকিরের দুই হাতের মুঠো এতো জোরে বদ্ধ হয় যেন সে একজন মুষ্টিযোদ্ধা এবং এখনই তার প্রতিপক্ষের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
ঠিক সেই মুহূর্তে সালেহা কক্ষে প্রবেশ করে জাকিরের গালে চুমু খেতে যাবে এমন সময় পানির নিচে ঘাপটি মেরে থাকা কুমির যেমন তার শিকারের উপর আক্রমণ করে ঠিক তেমনি জাকির তার স্ত্রীর উপর আছড়ে পড়ে। এতদিন যে মানুষটি জাকিরের প্রাণের চেয়ে প্রিয় ছিল, যার অস্তিত্ব তার চেতনায়, দেহে প্রাণে সর্বত্র, সেই সুন্দর মানুষটিই আজ তার কাছে এক কুৎসিত ডাইনীর মতন মনে হচ্ছে। ওথেলো যেমন ডেসডিমোনার গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, জাকিরও তেমনি সজোরে সালেহার টুঁটি চেপে ধরে হত্যা করে।
জাকিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশি জেরায় সে নিজ হাতে তার স্ত্রীকে হত্যা করার কথা অকপটে স্বীকার করে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমন নৃশংস হত্যার পেছনের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকির নির্বিকারভাবে বলে,
- আমার প্রয়াত স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান আমার নয়।
- তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে যে সন্তান তোমার নয়?
- কারণ আমি হিসেব করে দেখেছি যে লায়লার জন্ম হয়েছে মাত্র সাত মাসেই।
- তুমি কি এটা জানতে না যে কখনও কখনও বাচ্চার জন্ম দুয়েক মাস আগেই হয়ে যায়। এটাতো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা! আজকাল যে কোনও মানুষই এটা জানে!
- আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে এমনটি বুঝিয়েছে। তাছাড়া আমারও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবং এখনও তাই আছে যে লায়লা আমার সন্তান নয়।
- আরে বোকা, তোমার মনে যদি সন্দেহ থেকেই থাকে তাহলে আজকাল কত রকম টেস্ট করেও সন্তানের প্রকৃত পিতামাতা কে তা নির্ধারণ করা যায়; এভাবে খুন করে কি কোনও সমস্যার সমাধান হয়? তুমি নিজেতো ফাঁসিতে ঝুলে মরবেই, তার উপর একটি ফুলের মতন নিস্পাপ শিশুকে তার মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছো। তোমার কি বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই?
- না।
- আমরা তোমার এবং লায়লার ডিএনএ টেস্ট করাবো। আজই একজন ডাক্তার এসে তোমার ডিএনএ-র নমুনা নিয়ে যাবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই টেস্টের রিপোর্ট হাতে আসবে। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে এই রিপোর্টের ফলাফল জানার পর তোমার মনে অনুশোচনার বন্যা বয়ে যাবে! তখন বুঝবে কতোটা বোকার মতন কাজ করেছো তুমি! ও ভালো কথা, তোমার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী তোমার ধ্বংসের কারণ হলো তার নাম এবং ঠিকানা চাই। তাকে একটু থানায় এনে ভালো করে ধোলাই দেয়া প্রয়োজন। কারণ তারও বোঝা উচিৎ যে এভাবে প্ররোচনা দিয়ে কাউকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়াও একটা জঘন্য অপরাধ এবং এর শাস্তিও তাকে পেতে হবে।
জাকিরের কাছ থেকে মীর জাফরের তথ্য নিয়ে পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। তার নামেও একটি মামলা দায়ের করা হয়। এদিকে ডিএনএ রিপোর্টে দেখা যায় যে জাকিরই লায়লার প্রকৃত পিতা। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যখন জাকিরকে বিষয়টি জানান, তখন জাকির কষ্টে পাথর হয়ে যায়; নিজের কৃতকর্মের ফলে তার নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
হত্যা করার ঠিক আগ মুহূর্তে লায়লাকে ঘৃণিত আবর্জনার মতন মনে হলেও এখন জাকিরের চোখে লায়লা একজন সতী সাধ্বী নারী। ঠিক যেন স্বর্গের কোনও অপূর্ব অপ্সরার মতন। এখন জাকির নিজের চোখেই ঘৃণিত। জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী অবস্থায় জাকির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর ভাবে, “হে আল্লাহ্! এ আমি কি করলাম?”