সাহিত্যে নোবেল ২০২১ বিজয়ী আবদুলরাজাক গুরনাহ

ঐপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ ১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন।

 

তিনি ১৯৬৮ সালে ছাত্র হিসেবে ব্রিটেনে এসেছিলেন এবং এখন ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট-এ সাহিত্য পড়ান। তিনি ওয়াসাফিরি জার্নালের সহযোগী সম্পাদক।

 

তাঁর প্রথম তিনটি উপন্যাস, “মেমোরি অব ডিপার্চার” (১৯৮৭), “পিলগ্রিমস ওয়ে” (১৯৮৮) এবং “ডটি” (১৯৯০) বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমসাময়িক ব্রিটেনে অভিবাসীদের অভিজ্ঞতার দলিলস্বরূপ। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস, “প্যারাডাইস” (১৯৯৪) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পনিবেশিক পূর্ব আফ্রিকার পটভূমিতে রচিত এবং কথাসাহিত্যের জন্য বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল।

 

“অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স” (১৯৯৬) একজন যুবকের গল্প বলে, যিনি জাঞ্জিবার ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যান যেখানে তিনি বিয়ে করেন এবং শিক্ষক হন। ২০ বছর পরে তার জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া তার নিজের এবং তার বিবাহ উভয়ের প্রতি তার মনোভাবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। “বাই দ্যা সি” (২০০১), একটি ইংরেজ সমুদ্রতীরবর্তী শহরে বসবাসকারী একজন বয়স্ক আশ্রয়প্রার্থী সালেহ ওমর বর্ণনা করেছেন।

 

আবদুলরাজাক গুরনাহ পূর্ব সাসেক্সের ব্রাইটনে থাকেন। তার অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে “ডিসার্শন” (২০০৫) যেটি ২০০৬ কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিল এবং “দ্যা লাস্ট গিফট” (২০১১)। ২০০৭ সালে তিনি “দ্যা কেমব্রিজ কম্পেনিয়ন টু সালমান রুশদি” সম্পাদনা করেছিলেন।

 

আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখাগুলো পরিচয় ও স্থানচ্যুতি এবং উপনিবেশবাদ এবং দাসত্বের উত্তরাধিকার দ্বারা কীভাবে এগুলো গঠন করা হয়েছে সেগুলো দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর কাল্পনিক চরিত্রগুলো তাদের নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য একটি নতুনতর পরিচয় তৈরি করে চলেছে। তারা ক্রমাগত তাদের নতুন জীবন এবং তাদের অতীত অস্তিত্বের মধ্যে বোঝাপড়া করছে। চরিত্রগুলোর উপর একটি নতুন ভৌগোলিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে অভিবাসনের মারাত্মক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে গুরনাহর আখ্যানগুলো রচিত।

গুরনাহর কাছে (যিনি তার চরিত্রের মতো তার জন্মস্থান জঞ্জিবার থেকে স্থানচ্যুতি এবং ১৭ বছর বয়সে ব্রিটেনে অভিবাসনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন) পরিচয় হচ্ছে ক্রমাগত পরিবর্তনের বিষয় এবং তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো যেখানে যায় সেখানকার মানুষের নির্দিষ্ট পরিচয়কে অস্থির করে তুলে।  

 

তারা সেই পরিবেশে মুখোমুখি হয় যেখানে তারা স্থানান্তরিত হয়। যেমন সাংস্কৃতিক সমালোচক পল গিলরয় উল্লেখ করেছেন: 'যখন জাতীয় এবং জাতিগত পরিচয়গুলো বিশুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়, তখন ভিন্নতার প্রকাশ তাদের দুর্বল হওয়ার হুমকিস্বরূপ এবং দূষিত হওয়ার চিরকালীন সম্ভাবনার সাথে তাদের মূল্যবান বিশুদ্ধতা আপোষ করে' (“বিটউইন ক্যাম্পস” ১০৫)

 

গুরনাহর উপন্যাসের নায়করা তাদের পার্থক্যের মাধ্যমে অন্যান্য মানুষের পরিচয়ের এই দূষণের প্রতিনিধিত্ব করে। “অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স” (১৯৯৬) এর নামহীন বর্ণনাকারী যখন তার প্রেমিকার বাবা-মাকে বলে যে সে গর্ভবতী, তখন তারা তাকে ঘৃণার চোখে দেখে কারণ এখন তাদের মেয়েকে 'সারা জীবন এক ধরনের দূষণের সাথে থাকতে হবে। আবার সে সাধারণ ইংরেজ মহিলা হতে পারবে না' (৮৫)

 

লেখকের বই তাদের পাঠকদের জন্য একই চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। বিদেশে অভিবাসী হিসেবে, গুরনাহ সচেতন ছিলেন যে 'আমার সম্ভাব্য পাঠকদের মধ্যে কয়েকজনের আমার দিকে তাকানোর একটি রীতি ছিল যা আমাকে বিবেচনায় নিতে হয়েছিল। আমি সচেতন ছিলাম যে আমি এমন পাঠকদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করবো যারা সম্ভবত নিজেদেরকে আদর্শ, সংস্কৃতি বা জাতিসত্তা থেকে মুক্ত, পার্থক্যমুক্ত হিসেবে দেখেছিলেন। আমি ভাবলাম কতোটুকু বলবো, কতোটা জ্ঞান অনুমান করবো, না করলে আমার আখ্যান কতোটা বোধগম্য হবে' (পল গিলরয়, “রাইটিং অ্যান্ড প্লেইস, ২৮)

 

পূর্ব আফ্রিকা থেকে ইউরোপে হোক বা আফ্রিকার মধ্যে হোক, অভিবাসন এবং স্থানচ্যুতি গুরনাহর সব উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। মেমোরি অব ডিপার্চার” (১৯৮৭) নায়কের তার ছোট আফ্রিকান উপকূলীয় গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে। “পিলগ্রিমস ওয়ে” (১৯৮৮) তানজানিয়া থেকে আসা একজন মুসলিম ছাত্রের ছোট্ট ইংরেজ শহরের প্রাদেশিক ও বর্ণবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম যেখানে সে স্থানান্তরিত হয়েছে। “প্যারাডাইস” (১৯৯৪), যা ১৯৯৪ সালের কথাসাহিত্যে বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত ছিল, সেটি আফ্রিকান পটভূমিকে ধারণ করেই রচিত।

 

এটি ইউসুফের তার পিতামাতার দরিদ্র বাড়ি থেকে চাচা আজিজের ধনী অট্টালিকায় যাত্রার অনুসন্ধান করে, যার কাছে তাকে তার বাবার ঋণ পরিশোধ করার জন্য জমানত হিসেবে রাখা হয়েছিল। “অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স” এর বেনামী বর্ণনাকারী তার জন্মস্থান জাঞ্জিবারের রাজ্য সন্ত্রাস থেকে পালিয়ে ব্রিটেনে নিজের জন্য একটি নতুন জীবন গড়ে তুলেছিল। সে তার স্ত্রী এবং পিতামাতার জন্য তার স্বদেশ সম্পর্কে রোমান্টিক গল্প তৈরি করেছে যা তাকে আফ্রিকায় ফিরে যাবার সময় ভেঙে পড়ে।

 

“বাই দ্যা সি” (২০০১)তে সালেহ ওমর, একজন বয়স্ক আশ্রয়প্রার্থী যিনি সদ্য ব্রিটেনে এসেছেন, এবং লতিফ মাহমুদ, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, যিনি কয়েক দশক ধরে ইংল্যান্ডে রয়েছেন, সাক্ষাত করেন তাদের অতীতের কাহিনী উন্মোচনের জন্য যা একে অপরের সাথে অপ্রত্যাশিত সংযোগ প্রকাশ করবে।

 

এক জায়গার হয়েও অন্য জায়গায় থাকার শর্ত স্পষ্টতই গুরনাহর সমগ্র কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তু। তবুও, লেখক দাবি করেন যে তিনি কেবল তাঁর আত্মজীবনীমূলক অভিজ্ঞতাগুলো নথিভুক্ত করছেন না বরং 'আমাদের সময়ের গল্পগুলোর মধ্যে একটিকে নথিভুক্ত করছেন': 'বাড়ি থেকে দূরে ভ্রমণ দূরত্ব ও দৃষ্টিকোণ এবং প্রশস্ততা ও মুক্তি প্রদান করে। এটি স্মৃতিচারণকে তীব্র করে তুলে, যা লেখকের উপকূল' (“রাইটিং অ্যান্ড প্লেইস”, ২৭)।

 

অদ্ভুততা আরও তীব্র করে তুলে 'পিছনে ফেলে যাওয়া জীবনের অনুভূতি, অযৌক্তিকভাবে এবং চিন্তাহীনভাবে পরিত্যক্ত মানুষ, একটি জায়গা এবং হারিয়ে যাওয়ার উপায়' চিরতরে (রাইটিং অ্যান্ড প্লেইস”, ২৬)। একই অনুভূতি গুরনাহর উপন্যাসের চরিত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যারা পেছনে যা ফেলে এসেছে তাদের অতীতের দিকে তিক্ততা এবং অপরাধবোধের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে তাকায়। প্রায়শই, একটি ভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরের অর্থ হচ্ছে গুরনাহর চরিত্রগুলোর তাদের অতীতের পরিবারের সাথে যোগাযোগকে মুছে ফেলা।

 

ইউসুফ দুঃখজনকভাবে ভাবছে 'তার বাবা-মা এখনও তাকে নিয়ে চিন্তা করে কিনা, তারা এখনও বেঁচে আছে কিনা, এবং সে জানতো যে সে বরং খুঁজে পাবে না। সে এই অবস্থায় অন্যান্য স্মৃতি প্রতিহত করতে পারেনি, এবং তার পরিত্যাগের ছবিগুলো তার কাছে ক্ষোভ হয়ে এসেছিল' (প্যারাডাইস, ১৭৪)।

 

পূর্ব জার্মানি হয়ে ব্রিটেনে আসার পর থেকে লতিফ মাহমুদ কখনোই জাঞ্জিবারে রেখে যাওয়া পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি। যদিও সে সামনের দিকে তাকাতে চায়, সে নিজেকে সব সময় পিছনে ফিরে দেখতে পায়, 'অনেক আগের কথা চিন্তা করে...তখন থেকে অত্যাচারী ঘটনা যা আমার উপর ভর করে এবং প্রতিটি সাধারণ কর্মের নির্দেশ দেয়...প্রতিটি স্মৃতি রক্ত টেনে নেয়। এটি একটি নিখুঁত জায়গা, স্মৃতির ভূমি, পচা তক্তা এবং মরচেপড়া মইসহ একটি আবছা গুদাম...' (“বাই দ্যা সি”, ৮৬)

 

গুরনাহর বইগুলো হচ্ছে সঙ্করতার অস্থির শক্তি এবং পনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়ী উপস্থিতির দ্বারা জাতিগত ধারণার দিকে নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর চর্চা। 'আমাদের চুক্তির একটি অংশ', “অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স” এর বর্ণনাকারী বলেন, 'উপনিবেশিত হতে হবে, একত্রিত হতে হবে, সংহত হতে হবে, সংস্কৃতির সংঘর্ষে ভুগতে হবে, একটি পতাকা এবং একটি জাতীয় সংগীত জিততে হবে, দুর্নীতিগ্রস্ত হতে হবে, অনাহারে থাকতে হবে এবং নালিশ করতে হবে এসব সম্পর্কে। এটি একটি ভালো চুক্তি এবং আমরা প্রতিভা অনুযায়ী আমাদের অংশগুলো সম্পাদন করি, কিন্তু অতি সংবেদনশীল দেশপ্রেমিকদের সন্তুষ্ট করার জন্য পর্যাপ্তভাবে পর্যাপ্ত নয়, যারা উদাসীন অপরিচিতদের দ্বারা দরজার ভিতরে বিপজ্জনকভাবে বসে আছে বলে মনে করে' (১৬)। জাতিগত, ধর্মীয়, নৈতিক বা সামাজিক পার্থক্যের ফলে বহিরাগত এবং ভিন্ন হওয়ার পরিস্থিতিগুলো আবদুলরাজাক গুরনাহর কথাসাহিত্যের কেন্দ্রে দৃঢ়ভাবে খোদাই করা আছে।

 

বইয়ের তালিকা

 

১। মেমোরি অব ডিপার্চার (১৯৮৭)

২। পিলগ্রিমস ওয়ে (১৯৮৮)

৩। ডটি (১৯৯০)

৪। এসেইস ইন আফ্রিকান লিটারেচারঃ এ রি-এভেলিউএশন (১৯৯৩)

৫। প্যারাডাইস (১৯৯৪)

৬। অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স (১৯৯৬)

৭। বাই দ্যা সি (২০০১)

৮। ডিসার্শন (২০০৫)

৯। দ্যা কেমব্রিজ কম্পেনিয়ন টু সালমান রুশদি (২০০৭)

১০। দ্যা লাস্ট গিফট (২০১১)

পুরস্কার 

 

১। বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন (১৯৯৪)

২। লস এঞ্জেলেস টাইমস বুক প্রাইজ (ফিকশন) (২০০১)

৩। কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ (২০০৬)

৪। সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ (২০২১) 

View kingofwords's Full Portfolio