শব্দের মানদণ্ডে বিচার করলে ‘সাহিত্য’ একটি ব্যাপক শব্দ। তবে অনেকেই এটিকে স্থায়ী শৈল্পিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লেখা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেন। সাহিত্যে প্রাচীন গ্রীক নাটক, উইলিয়াম শেইকসপিয়ারের নাটক, লিও টলস্টয়ের উপন্যাস ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই ধরণের সাহিত্যকর্মগুলো মানব জীবনের জটিল সমস্যা এবং ধারণার সাথে সম্পর্কিত যা পাঠকদেরকে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ হবার কিছু কারণ নিম্নে বর্ণিত হয়েছে:
সাহিত্য মানসিক চাপ কমায়
এটা প্রায় সকল পাঠকেরই জানা যে সাহিত্য চাপ এবং উদ্বেগ দূর করতে পারে। কেউ একটু সময় বের করে একটি ভালো বই পড়লে তার মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি দ্রুত হৃদস্পন্দন মন্থর করতে পারে এবং ঝড়ো চিন্তা থেকে পাঠকের মনকে শান্ত রাখে। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা কৃত গবেষণায় দেখা গেছে যে মাত্র ছয় মিনিট পাঠের ফলে ৬৮% পর্যন্ত চাপ হ্রাস হয়েছে। অনেকেই নির্দ্বিধায় এ ধারণা পোষণ করেন যে সঙ্গীত শোনা বা হাঁটার চেয়ে ‘পঠন’ মানসিক চাপ সামলানোর একটি ভালো উপায় হয়ে উঠেছে।
সাহিত্য কল্পনাশক্তিকে ধারালো করে
ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশন অনুসারে, পঠন শক্তিশালী কল্পনাশক্তি বিকাশের একটি মোক্ষম উপায়। একটি চলচ্চিত্র দেখার জন্য তেমন বেশী মানসিক কর্মের প্রয়োজন পড়ে না কিন্তু একটি পাতা থেকে শব্দ পড়ার জন্য পাঠকদেরকে তাদের মনে দৃশ্য তৈরি করতে হয়। এই অনুশীলন মস্তিষ্কের কল্পনাপ্রবণ অংশগুলোকে দৃঢ় করে, সৃজনশীলতা এবং নতুনত্বকে উত্সাহ দেয়।
সাহিত্য পাঠে একাগ্রতা এবং মনোযোগ বৃদ্ধি পায়
হাসকিন্স ল্যাবরেটরিজ ফর দ্যা সায়েন্স অব দ্যা স্পোকেন অ্যান্ড রাইট ওয়ার্ড-এর গবেষণায় দেখা গেছে যে অন্যান্য ধরণের গণমাধ্যমের চেয়ে পড়ার সময় মস্তিষ্কের বেশী ‘সময়’ প্রয়োজন। পাঠের সময় যেহেতু শুধু শব্দ নিয়েই কাজ করতে হয়, তাই মস্তিষ্ক তখন কঠোর পরিশ্রমে লিপ্ত থাকে। একটি বই যতো বেশী জটিল বা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠে, মনোযোগের প্রয়োজনীয়তাও ততোই বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঠকগণের মনোযোগ তখনই বাড়ে, যখন তারা সাহিত্যের সাথে আরও বেশী নিযুক্ত হন।
সাহিত্য পাঠ মস্তিষ্ককে সক্রিয় ও সুস্থ রাখে
মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর পাঠের প্রভাব অপরিসীম। কল্পনার বিকাশ এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি উভয়ই মানসিক উদ্দীপনার ধরণের মধ্যে পড়ে। যেহেতু মস্তিষ্ক একটি পেশী, তাই এটিকে সক্রিয় এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে পাঠের মতন অনুশীলন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত মানসিক উদ্দীপনা আলঝেইমার এবং ডিমেনশিয়ার মত মস্তিষ্কের অবস্থাকে ধীর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সাহিত্য শব্দভাণ্ডার প্রসারিত করে
সাহিত্যে প্রায়ই চ্যালেঞ্জিং শব্দভাণ্ডার থাকে। বিশেষ করে পুরাতন বইয়ে এমন ভাষা বা শব্দ থাকতে পারে যা অনেক পাঠকের কাছে অপরিচিত। বিভিন্ন সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একজন ব্যক্তি নতুন শব্দ ও বাক্যাংশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে প্রসারিত করে। যারা একটি নতুন ভাষা শিখছেন, সাহিত্য তাদের দক্ষতা উন্নত করার অন্যতম সেরা উপায়।
সাহিত্য পাঠে লেখার দক্ষতা বাড়ে
যে যতো বেশী পড়বে, তার লেখার দক্ষতা ততো বেশী বাড়বে। এ কারণেই সফল ব্যক্তিগণ সর্বদা পড়ার প্রশংসা করেন। সাহিত্য কল্পনাকে ইন্ধন যোগানোর পাশাপাশি শব্দভাণ্ডারকেও প্রসারিত করে। যার শব্দভাণ্ডার যতো বেশী সমৃদ্ধ, তার লেখাও ততো বেশী উন্নত মানের হবার সম্ভাবনা থাকে। সাহিত্য পাঠ বিভিন্ন শৈলী, ধারণা সংগঠন, চরিত্র উন্নয়ন এবং আরো অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে।
সাহিত্য যোগাযোগ দক্ষতা উন্নত করে
সত্যি কথা বলতে কি, পাঠকগণ পড়ার মাধ্যমে শুধুমাত্র তাদের লেখার উন্নতি ঘটায় না, তারা একইসাথে তাদের সামগ্রিক যোগাযোগ দক্ষতাকেও সমৃদ্ধ করে। যে পেশা বা সম্পর্কের মধ্যেই হোক না কেন, জীবনযাপনে ভালো যোগাযোগের কোনও বিকল্প নেই। অল্প বয়সে সাহিত্যের সংস্পর্শে আসার ফলে মানুষের মাঝে শক্তিশালী যোগাযোগ দক্ষতা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যারা প্রাপ্তবয়স্ক, তারা আরও পড়ার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তাদের দক্ষতা উন্নত করতে পারে।
সাহিত্য বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাকে উৎসাহ দেয়
মানব জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এটা মানুষকে সমস্যার মধ্য দিয়ে কাজ করতে এবং কোনটা সত্য তা নির্ধারণ করতে সহায়তা করে। সাহিত্য পাঠ বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য নিখুঁত সুযোগ হিসেবে কাজ করে। একজন পাঠককে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা, সংযোগ তৈরি করা এবং বইটিতে কি ঘটছে সে বিষয়ে তাদের নিজস্ব মতামত তৈরি করার মাধ্যমে সমগ্র বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। শিক্ষকরা খুব ভালো করেই সাহিত্যের ক্ষমতা বুঝতে পারেন, তাইতো প্রায়ই তাঁরা তাদের ছাত্রদের শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা বিকাশে সাহায্য করার জন্য সাহিত্যকে ব্যবহার করেন। এই প্রক্রিয়াটি ছাত্রদেরকে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে এবং তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে ব্যবহারের জন্য উল্লেখযোগ্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
সাহিত্য পাঠকদেরকে ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা দেয়
এটা বলা হয় ‘যদি আমরা ইতিহাস সম্পর্কে/থেকে না শিখি, তাহলে এর পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী!’ সাহিত্যের মাধ্যমে একজন পাঠক খুব সহজেই ইতিহাসের সাথে যুক্ত হবার সক্ষমতা অর্জন করেন। তথ্য মুখস্থ করার চেয়ে সাহিত্য পাঠ অনেক বেশী আকর্ষণীয় এবং উপকারী। যদি বইটি কাল্পনিক হয় এবং একটি নির্দিষ্ট ঘটনার উপর মনোনিবেশ না করে, তবুও একজন পাঠক বইটির জন্মলগ্নের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ বা সময়ের সাথে পরিচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন চীনের সাহিত্যকর্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের বইয়ের চেয়ে ভিন্ন সত্য প্রকাশ করবে এ কথা বলাই বাহুল্য।
সাহিত্য পাঠে সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়
‘সহানুভূতি’ মানব সমাজের অংশ। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে সাহিত্য পাঠের ফলে একজন পাঠকের হৃদয়ে সহানুভূতির অনুভূতি বৃদ্ধি পায়। কল্পকাহিনী নির্ভর সাহিত্য সহানুভূতিকে উৎসাহিত করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করে কারণ এর জন্য একজন পাঠককে আরো জটিল চরিত্রগুলোর মনের অভ্যন্তরে প্রবেশের প্রয়োজন পড়ে। প্রিন্সটন সোশ্যাল নিউরোসায়েন্স ল্যাবে একজন মনোবিজ্ঞানী জেনেছেন যে যারা নিয়মিত কল্পকাহিনী পড়েন, তারা অন্যদের ভাবনা এবং অনুভূতিগুলোকে অনেকাংশেই বুঝতে পারেন। যদিও বিষয়টি এখনো বিজ্ঞানের দ্বারা নিষ্পত্তি বা প্রমাণিত হয়নি, তবুও সাহিত্য আমাদের আরও ভালো মানুষে পরিণত করতে পারে এই ধারণাটি বেশ কৌতূহলের জন্ম দেয়।