সূচনাঃ
এক অনিশ্চিত সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল সত্তরের দশকের কলকাতা শহর। নকশাল বাড়ি আন্দোলনতো ছিলই, পাশাপাশি বেকার সমস্যার তীব্রতা ছিল চোখে পড়ার মতন। অস্থিরতা এবং নৈতিকতার অবক্ষয় সমাজের প্রতিটি স্তরে ভাইরাসের মতোই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল। সত্যজিৎ রায় তাঁর তিনটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সেই অস্থির সময়কে বেশ দক্ষতার সাথে বন্দী করেছেন তাঁর তিনটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে- 'প্রতিদ্বন্দ্বী' [১৯৭০], 'সীমাবদ্ধ' [১৯৭১] এবং 'জন অরণ্য' [১৯৭৫]। ‘জন অরণ্য’ 'সেরা পরিচালক', 'সেরা চলচ্চিত্র' এবং 'সেরা চিত্রনাট্য' বিভাগে অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছিল।
১৯৭৩ সালে শংকর তার 'জন অরণ্য' উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। এটির উপর ভিত্তি করেই সত্যজিৎ রায় 'জন অরণ্য' নির্মাণ করেন। সমাজে ভয়ানক বেকার সমস্যায় হতাশাগ্রস্ত তরুণদের মানসিক যাতনা, তাদের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার তীব্র বাসনা চমৎকারভাবে এই চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে। বিশেষ করে জ্যামিতিকহারে বাড়তে থাকা অনৈতিকতার সাথে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের যে দ্বন্দ্ব তার নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই চলচ্চিত্রে।
জন অরণ্যে চিত্রায়িত মূল বিষয়বস্তুঃ
চলচ্চিত্রটির শুরুতে আমরা পরীক্ষার হলের একটি দৃশ্য দেখি। রুমের প্রতিটি দেয়ালে বিপ্লবের বাণী দৃশ্যমান। উদাহরণস্বরূপঃ ''শ্রেণীশত্রু খতম করো', সশস্ত্র বিপ্লবই সর্বহারাদের একমাত্র মুক্তির পথ' ইত্যাদি। আশ্চর্যের বিষয় এই যে যে ছাত্ররা বিপ্লবের চেতনায় জাগ্রত হয়ে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাই, ঠিক তারাই আবার পরীক্ষার হলে দুজন শিক্ষকের উপস্থিতিতে দেদারসে নকল করে যাচ্ছে! শিক্ষকদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই তাদের। একপর্যায়ে একজন শিক্ষক নকল থামানোর চেষ্টা করে বলেন,"কী হচ্ছে, ভাই?" এর উত্তরে এক ছাত্র ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় বলে, "পরীক্ষা হচ্ছে, ভাই!" এই দৃশ্যটির মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় বেশ সুনিপুণভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নৈতিকতার অধঃপতনকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
যদিও এ চলচ্চিত্রের নায়ক সোমনাথ সততার সাথে পরীক্ষা দেয়, সে অনার্সে কোনওরকমে টেনেটুনে পাস করে! সোমনাথের প্রেমিকা তপোতীর এক ডাক্তারের সাথে বিয়ে হয় কারণ সোমনাথের কোনও চাকরি নেই।
চাকরির বাজারে সোমনাথের সংগ্রামের সূচনা ঘটে। একেকটি পদের বিপরীতে দরখাস্ত জমা পড়ে লাখ লাখ। সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীদের প্রশ্ন "চাঁদের ওজন কত?" সোমনাথের কাছে একেবারেই অযৌক্তিক মনে হয়। সে জিজ্ঞেস করে, "এর সাথে চাকরির কী সম্পর্ক?" অসহায় ছেলেকে দেখে বৃদ্ধ পিতা বলেন, "চাকরি যারা পেল না, তারা আর কী করবে? দুটো বৈ আর রাস্তা আছে তাদের সামনে? হয় অসৎ পথে যাও, নষ্ট হয়ে যাও, আর নয় তো বিপ্লব করো।"
হাঁটতে গিয়ে পূর্বপরিচিত বিশুদার ফেলা কলার খোসায় পিছলে পড়ে যায় সোমনাথ। এই দৃশ্য কিছুটা হাস্যরসাত্মক হলেও এর কিন্তু অন্য একটি তাৎপর্য আছে আর সেটি হচ্ছে এই যে সোমনাথ পা পিছলে পড়ে যাবার ফলেই বিশুদার নজরে পড়ে। এখানে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য রচনার দক্ষতা আরও একবার প্রতীয়মান হয়- বিশুদা বলেন, “দেখে শুনে চলো হে, সর্বত্র পিটফল, রাস্তার তিন অবস্থা, ব্যাড, ভেরি ব্যাড, ভেরি ভেরি ব্যাড!” এখানে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকলে হলে বুঝেশুনে পা ফেলতে হয়। পরবর্তীতে এই দয়ালু বিশুদাই সোমনাথকে একটি সুযোগ দেন- “অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা, এনিথিং ফ্রম আলপিন টু এলিফ্যান্ট।” সোমনাথ হয় ‘দালাল’ বা 'The Middleman'।
সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন নতুন প্রজন্মের তরুণদের মানসিকতার সাথে পুরনো প্রজন্মের লোকদের মানসিকতার কতোটা ফারাক! 'ঘুষ' বা 'উৎকোচে' শব্দগুলো সোমনাথ বা তার ভাই যতো সহজে মেনে নিচ্ছে, সেখানে তাদের বাবা এসব অন্যায় কোনোভাবেই মেনে নেবার বিপক্ষে।
তখনকার কলকাতায় অভাবের তাড়নায় অনেক কিশোরী, গৃহবধূ এবং বালিকারা পতিতাবৃত্তি বেছে নয়। এমন ভয়ংকর কাজে সহযোগীতা করছেন তাদের পরিবারেরই সদস্যবর্গ বা নিকটাত্মীয়রা!
চলচ্চিত্রের শেষের দিকে সোমনাথ মিস্টার গোয়েঙ্কার কাছ থেকে অর্ডার পেতে হলে মিস্টার গোয়েঙ্কার জন্য একজন সঙ্গিনী জোগাড় করতে হবে। কিছুটা মানসিক দ্বিধার ভেতর দিয়ে গেলেও অবশেষে সোমনাথ নিজের নৈতিকতাকে চরমভাবে বিসর্জন দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে তার বন্ধু সুকুমারের বোন কণাকে, যার নতুন নাম যুথিকা, গোয়েঙ্কার কাছে পৌঁছে দেয় এবং অর্ডারটি পায়। অর্ডার পাবার কথা শুনে সোমনাথের বাবা আনন্দিত হন। ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজে, “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে”। নাগরিক জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব ঘটলে নৈতিকতার সাথে আপোস করে নেয় সোমনাথ। এভাবেই ধীরে ধীরে অনৈতিকতার ছায়া গ্রাস করে নিচ্ছে সকল বিশুদ্ধ “হৃদয়কে!
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রের কারিগরি বিশ্লেষণঃ
গতিময়তা
সত্যজিৎ রায়ের এই চলচ্চিত্রটি শুরুর দিকে বেশ গতিময়। বিশেষ করে সোমনাথের চাকরি পাবার যে সংগ্রাম, নিরন্তর এদিক ওদিক দরখাস্ত পাঠানো, দালালি শুরু করার সময়কার কর্মকাণ্ড ইত্যাদি দর্শকদের সামনে নাগরিক জীবনে যান্ত্রিকতার উপস্থিতি তুলে ধরে। চলচ্চিত্রটির চিত্রধারণ অত্যন্ত সাবলীল। সাদাকালো হওয়াতে মনে হয় যেন এটি বাস্তবতার অবয়ব আরও বেশি মাত্রায় পেয়েছে। এর আবহ সংগীতও প্রশংসনীয়।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে ‘শট’ এর ব্যবহার
জন অরণ্য চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় শটের ব্যাবহারে বরাবরের মতোই দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি যেসব শট বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছেন তা হচ্ছে, ক্লোজ শট, কাট ইন, কাট এয়োয়ে, ট্র্যাক শট, এক্সট্রিম ক্লোজ শট, ওভার দ্যা সৌল্ডার শট, মিড শট, কম্পজিট শট, জুম আউট শট, ডলি শট, টু শট, থ্রী শট, জুম ইন শট এবং ওয়ান শট। সোমনাথ তার বাবার সাথে কথা বলার সময় ডিপ ফোকাসের ব্যবহার লক্ষণীয়। বিশুদা হেঁটে হেঁটে সোমনাথের সাথে কথা বলার সময় পিওভি শটের দেখা মেলে। এ ক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায় এবং সম্পাদক দুলাল দত্তও প্রশংসার দাবী রাখেন।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে টোনাল মন্তাজ
সোমনাথ শুধু পাশ করার কারণে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। তার পিতা সত্য বন্দোপ্যাধায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার পর সে আধো আলো আধো ছায়ায় দাঁড়ায়। তার মুখে কালো ছায়া পড়ে, যা কিনা তার মনের বিষণ্ণতার প্রতিফলন বলা চলে।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে লো কি লাইটের ব্যবহার
সোমনাথের পুরানো বান্ধবীর চরিত্রে অপর্ণা সেন অনবদ্য অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনার মুনশিয়ানা আরও একবার ফুটে উঠে বিশেষ করে অপর্ণা সেন যখন পার্কের বেঞ্চে বসে এক ডাক্তারের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার তথ্যটি কাঁদো কাঁদোভাবে সোমনাথকে জানায়। এখানে নির্দেশক লো কি লাইটের ব্যবহার করেছেন যা এই বিষণ্ণ দুজন মানুষের মানসিক অবস্থাকে দ্যোতনাময় করেছে। সোমনাথ তার বাবা ও ভাইয়ের সাথে মোমের আলোয় ডিনারে লো কি লাইটের ব্যবহার লক্ষণীয়। এখানেও বিষণ্ণতার ছাপ প্রতীয়মান।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে হাই কি লাইটের ব্যবহার
সোমনাথ যখন বিশুদার সাথে বাইরে কথা বলে, তখন উজ্জ্বল আলো অর্থাৎ হাই কি লাইটের বেশ নান্দনিক ব্যাবহার চোখে পড়ে। তাছাড়া সোমনাথ তার বন্ধুর সাথে বাদাম খেতে খেতে বাইরে আলাপচারিতার সময়ও হাই কি লাইটের সফল প্রয়োগ লক্ষণীয়।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে মিজ ও সিন এর ব্যবহার
প্রতিটি দৃশ্যে প্রতিটি মানুষ, প্রত্যেকটা ছোটখাটো জিনিস এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন মনে হয় নিখুঁত! যেমন সোমনাথের টেবিলে পুরনো প্রেমিকার বিয়ের কার্ড রাখা, রাস্তায় পড়ে থাকা কলার বাকল, বাসায় ভাই, বাবা, বৌদি ও সোমনাথের দাঁড়ানো বা বসার ভঙ্গিমা- সবকিছুই অসাধারণ মিজ ও সিন সৃষ্টি করে।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে মিজ ও কাদার এর ব্যবহার
অপর্ণা সেন চলে যাবার সময় সোমনাথ যে ইতোমধ্যে তাকে নিজের রুমাল দিয়েছিল চোখের জল মুছতে, সেটি সে সোমনাথকে ফেরত দেয়, এখানে একটি চমৎকার মিজ ও কাদার এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। অপর্ণা আসলে রুমাল ফেরত দিচ্ছে না, ফেরত দিচ্ছে সোমনাথের ভালোবাসা। সে আর সোমনাথের নয়, সে অন্য কারো হতে যাচ্ছে।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রে হিউমার এর ব্যবহার
কলার বাকলে সোমনাথের পা পিছলে পড়ে যাওয়া, বিশুদার রসিয়ে রসিয়ে কথা বলার ধরণ ইত্যাদি বেশ হাস্যরসাত্মক! বাদাম খেতে খেতে সোমনাথ ও তার বন্ধু যেভাবে কথা বলে, সেখানে অনেকটা হাস্যরসের উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়।
‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রের ত্রুটিবিচ্যুতি
সোমনাথের বাবা তার বৌমার সাথে কথা বলার সময় সোমনাথে মাথা সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছিল না। অর্থাৎ হেডরুম কম ছিল। তিনি কথাপ্রসঙ্গে প্রয়াত স্ত্রীর উল্লেখ করেন যা দর্শকদের জন্য তথ্যপূর্ণ একটি বিষয়। আরও কয়েকটি শটে হেডরুম কম ছিল যা ছবির সৌন্দর্য কিছুটা হলেও ম্লান করেছে।
উপসংহারঃ
নীতির সাথে আকাঙ্ক্ষার সংঘাত, তরুণদের মনে হতাশা- এসবই ‘জন অরণ্য’ চলচ্চিত্রের মূল বিষয়। ‘সোমনাথ’ যেন নায়ক নয়, সে যেন আমাদেরই একজন। বহু আগে নির্মিত এই ছবিটি যেন এখনো সমসাময়িক। সত্যজিৎ রায় তার মেধা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার ছাপ বেশ সফলতার সাথেই রেখেছেন এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে।