[বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে! মনে হচ্ছে যেন বর্ষার আকাশে মুহুর্মুহু বজ্রপাত। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেই চলেছে। অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা অর্ক মঞ্চে প্রবেশ করে। কয়েক সেকেন্ড পরে নয়ন হাফাতে হাফাতে মঞ্চে প্রবেশ করে। অর্ক মাটিতে বসে বন্দুক পরীক্ষা করে দেখছে।]
নয়নঃ [হাফাতে হাফাতে অর্ককে বলে] বন্ধু, খবর শুনেছিস?
অর্কঃ কি খবর?
নয়নঃ গ্রামের ঐ লক্ষ্মী পুকুর পাড়ে বেশ কয়েকজন নারীকে গণধর্ষণের পর পাক হানাদার বাহিনী জীবন্ত পুঁতে রেখেছে!
অর্কঃ [অবাক হয়ে বলে] ইয়া আল্লাহ্! কি বলছিস?
নয়নঃ হ্যাঁ, আমি সত্যি বলছি।
অর্কঃ তুই এ কথা কার কাছ থেকে শুনেছিস?
নয়নঃ আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় মুরব্বী ইমাম সাহেবের কাছ থেকে।
অর্কঃ মুরব্বী সাহেবের কাছ থেকে? তাহলেতো কথাটি মিথ্যে নয়। আচ্ছা, ঠিক কখন ঘটেছেরে ঘটনাটা?
নয়নঃ এই মুহূর্তে ঘটছে! পুকুর পাড়ের চারপাশ নাকি অসহায় ও বিবস্ত্র নারীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে গেছে!
অর্কঃ বলিস কি?
নয়নঃ হ্যাঁ!
অর্কঃ [বন্দুক কাঁধে নিয়ে তড়িঘড়ি করে] তাহলেতো আর দেরী না করে এক্ষুনি সেখানে যাওয়া উচিত।
নয়নঃ হ্যাঁ, বন্ধু, আমিও তাই ভাবছি।
অর্কঃ [রওনা দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়] আচ্ছা, শুধুমাত্র আমরা দুজন যাওয়াটা ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কি বলিস?
নয়নঃ আমারও তাই মনে হয়। তাছাড়া আমাদের সাথে শুধু এই দুটি বন্দুক ছাড়া আর কিছুই নেই।
অর্কঃ [একটু ভেবে নয়নের কাঁধে হাত রেখে বলে] বন্ধু, এক কাজ কর, তুই দৌড়ে গিয়ে পাশের বাড়ির সায়েম এবং ইফাজকে তাড়াতাড়ি
ডেকে নিয়ে আয়। বলবি আসার সময় যেন অবশ্যই মনে করে বন্দুক ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে।
নয়নঃ ঠিক আছে।
[দ্রুততার সাথে দৌড়ে নয়ন মঞ্চ ত্যাগ করে। অর্ক একা মঞ্চে পায়চারী করে ভাবতে থাকে।]
[মঞ্চে নয়ন ও ইফাজের প্রবেশ।]
অর্কঃ [মুচকি হেসে বলে] বন্ধু ইফাজ, তোকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।
ইফাজঃ কেমন আছিস?
অর্কঃ বাংলাদেশকে স্বাধীন না করা পর্যন্ত কিভাবে ভালো থাকি বল?
ইফাজঃ ঠিকই বলেছিস। আচ্ছা, বলতো এমন তড়িঘড়ি করে আমাকে কেন ডাকলি?
অর্কঃ তার আগে বল সায়েম কোথায়?
ইফাজঃ সে যে ঠিক কোথায় গেছে আমি বলতে পারছি না।
অর্কঃ শোন, আর বেশি সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে পুকুর পাড়ে কি ঘটছে সেটা সম্পর্কে তোকে একটু জানানো দরকার।
ইফাজঃ আসার সময় নয়ন আমাকে ঐ বিষয়ে জানিয়েছে।
অর্কঃ ও, তাহলেতো ভালোই হয়েছে। চল তাহলে, লক্ষ্মী পুকুর পাড়ে যাওয়া যাক।
[অর্ক ও নয়ন একসাথে বলে, “চল, চল”। ৩ জনই মঞ্চ ত্যাগ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ৫ জন সৈন্য ৩ জন যুবতী বাঙালি নারীকে টেনেহিঁচড়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। অসহায় নারীরা আল্লাহ্র নাম নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পরপর সৈন্যরা উর্দু ভাষায় গালমন্দ করে আর হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে সজোরে সেই নারীদের আঘাত করতে থাকে। তাদের রক্তাক্ত দেহ যেন নিষ্প্রাণ!]
১ম পাকিস্তানি সৈন্যঃ [মাতাল অবস্থায় একজন নারীর হাত ধরে টেনে বলে] সালি, নাখড়ে বান্ধ কার! আভি ইসি ওয়াক্ত মেরে সাথ উস কোণেমে চাল। তু মুঝে খুশ কার দে, মে তুঝে খুশ কার দুঙ্গা! হা, হা, হা!
নারীঃ কুত্তার বাচ্চা! আল্লাহ্ যেন তোরে কুত্তার মত মারে! হারামজাদা কোথাকার!
১ম পাকিস্তানি সৈন্যঃ [নারীর দিকে পিস্তল তাক করে বলে] তেরি ইতনি হিম্মাত? তু তো গেয়া!
[অনেকগুলো গুলির শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ। সাহসী নারীর নিথর দেহ মরা কাঠের মত পড়ে থাকে। ১ম পাকিস্তানি সৈন্য ২য় নারীকে টেনেহিঁচড়ে অন্য কক্ষে নিতে চাওয়ার সময় সে যেতে বারণ করলে ১ম পাকিস্তানি সৈন্য তার দিকে পিস্তল তাক করার সময়। অর্ক, ইফাজ ও নয়ন ঝোপের আড়াল থেকে গ্রেনেড ছুড়ে দিয়ে গুলি করতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সাবধানতাও অবলম্বন করে গুলি ছুড়তে থাকে। ইতোমধ্যে মঞ্চে থাকা নারীরা দৌড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। অনেকক্ষণ গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে একজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকিদের লাশ মঞ্চে পড়ে থাকে। অর্কের মাথায় গুলি লাগার ফলে সে শহীদ হয়। তার লাশ মঞ্চের ঠিক মাঝখানে পড়ে আছে। ইফাজ ও নয়ন অর্কের মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যায়।]
ইফাজঃ [কাঁদতে কাঁদতে অর্কের কপাল ছুঁয়ে নিজের ডান হাতে রক্ত মাখিয়ে বলে] অর্ক! বন্ধু আমার! তোর রক্ত বৃথা যেতে দেবো না! কক্ষনো না! কক্ষনো না!
নয়নঃ [অর্কের বুকে মাথা রেখে কেঁদে বলে] তুই জেনে রাখ বন্ধু, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই! হতেই হবে!
[ইফাজ ও নয়ন কাঁদতে কাঁদতে অর্কের মৃতদেহকে নিজেদের কাঁধে করে মঞ্চ ত্যাগ করার সময় মঞ্চের পেছন থেকে দেশাত্মবোধক গান, “মাগো, ভাবনা কেন? আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে...”, বেজে উঠে। তারা মঞ্চ ত্যাগ করার কয়েক সেকেন্ড পরও গানটি কিছুক্ষণ বেজে বন্ধ হয়।]
[সমাপ্তি]