দুই বন্ধুর মধ্যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। তার বেশীরভাগ অংশই তাদের বাংলা শিক্ষকের মুন্ডুপাত করতেই চলে যাচ্ছে। রকি আর বিপুল রিক্সা করে রকিদের বাসার দিকে যাচ্ছে। কলেজ থেকে সোজা চলে এসেছে দুই বন্ধু। বিপুল আজকে রকিদের বাসায় থাকবে। ওদের বাংলা শিক্ষক ওদের সবাইকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে। সেটা নিয়েই দুইজন উত্তপ্ত আলোচনায় লিপ্ত। এদিকে আকাশে যে মেঘ করেছে, সেদিকে কোন খেয়ালই নেই ওদের।
‘ধুস! ঘোড়ার ডিম! কেমনে করবো এই অ্যাসাইনমেন্ট?’ রকি বেশ চটে আছে স্যারের উপরে।
‘কোন একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে তার বাস্তবজীবনের ঘটনা নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট। এমনটা কোন স্যার দিয়েছেন আগে?’ বিপুলের কন্ঠে হতাশার সুর। তবে রকির চাইতে বেশী শান্ত আছে সে।
‘তাও ভালো সবাইকে আলাদা আলাদা করে কিছু দেয় নি। দোস্ত তুই আমার পাশে না থাকলে আমি তো চোখে অন্ধকার দেখতাম রে’।
‘আরে ধুর! চিন্তা করিস না। কিছু একটা ঠিকি দাঁড় করিয়ে ফেলবো দেখিস। একটু চাপা মারতে হবে আর কি’। বিপুল এবার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাসিমুখে রকিকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। বুঝতে পারছে কাজটা খুব একটা সহজ হবে না।
‘তোর মাথায় কি কোন আইডিয়া আছে?’ রকি একটু উৎসাহ দেখায়।
‘এখন পর্যন্ত না। দেখি ভেবে একটু। সমস্যা কি জানিস? গল্পও উপন্যাস পড়া আমার দুই চোখের বিষ। আমার পড়তে একদমই ভালো লাগে না। কি যে করি? ইণ্টারনেট থেকে কিছু নিতে গেলে সেই তো পড়তেই হল। আরো ঝামেলা। ইংলিশ থেকে বাংলা করতে হবে’।
‘অনুবাদ না হয় করা গেল টেনেটুনে; কিন্তু সাক্ষাৎকার? আমারো তো একই সমস্যা। গল্পের বই কবে পড়ছি সেটা মনেই পড়ে না। ক্লাসের বই পড়েই কূল পাই না আবার গল্পের বই? হুহ!’
‘তুই ওটা নিয়ে চিন্তা করিস না। ওটাও চাপা মেরে দেয়া যাবে’।
গল্পের এই পর্যায়ে ওরা রকিদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেট নক করতে যাবে এমন সময় রিক্সাওয়ালা ডাক দেয়। ‘ভাই শুনেন একটু।’
‘ভাড়া কি কম দেয়া হয়েছে?’ রকি একটু অবাক হয়?
‘না। ঠিকি আছে। আপনারা মুক্তিযোদ্ধার গল্পও নিয়ে আলাপ করতেছিলেন। আমি শুনছি। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিছু যদি মনে না করেন তাহলে আপনাদের আমার গল্পও শুনাইতে পারি’। মাঝবয়সী রিক্সাওয়ালার সরল কথাগুলো ওদের নজর কাড়লো।
‘বলেন কি? আপনি মুক্তিযোদ্ধা? আপনার বয়স কত ছিল তখন?’ বিপুল ভীষণ অবাক হয়।
‘তখন আমার বয়স ছিল সতেরো বছর। এখন কত হিসাব কইরা দেখেন’। মুচকি হেসে বলে মাঝবয়সী রিক্সাওয়ালা।
রকি বিপুলের দিকে তাকায় সমর্থনের আশায়। বিপুল কপাল কুচকে আছে। বিপুলের আবার সবকিছুতেই খুঁতখুঁতে স্বভাব। মাথা নেড়ে সমর্থন দিলো রকি। ‘আপনি ভেতরে আসেন’। রকি বললো।
‘রিক্সা রাখবো কই?’
‘ভেতরেই নিয়ে আসেন। আমি বলে দিচ্ছি’।
রকি আর বিপুল ওদের সাথে আগত রিক্সাওয়ালাকে ঘিরে বসে। ওদের চোখে মুখে এক মিশ্রিত অনুভুতি। কি না কি কাহিনী বলবে কে জানে? বিপুল খাতা খুলে বসেছে। এসব ব্যাপারে ও সিরিয়াস! লোকটি গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলতে শুরু করলো তার টুকরো টুকরো কিছু কথা।
‘খুব বেশী কিছু কমু না ভাই। যুদ্ধ কিভাবে হইছিলো সেটা আপনারাও জানেন। সবাই জানে। আমাদের বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ায়। তখন ফরিদপুর ছিল। আমাদের বাড়ি মধুমতি নদীর অনেক কাছে। আমি কিছুদূর লেখাপড়া করসিলাম। যুদ্ধ যখন শুরু হয় আমার বয়স তখন সতেরো বছর। আপনারা জানেন কিনা জানি না, বাংলাদেশ ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় হয়ে গেলেও আমাদের ওখানে মানে ভাটিয়াপাড়ায় যুদ্ধ চলছিল। প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের গ্রাম থেকে পাক সেনারা চলে যায়। জৈষ্ঠ্য মাস চলে যখন আমি যুদ্ধে যাই। আমার আব্বা সবসময় চোখে চোখে রাখতো আমাকে। আমি যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না পারি। আমাদের গ্রামের উত্তর পাড়ার হাশেম সর্দারের বড় ছেলে হাফিয আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় ছিল। একদিন আমার সাথে কথা বলল। আমাকে বুঝালো যে এখন যুদ্ধে যাওয়া আমাদের জন্য কত দরকারী। আমি রাজী হয়ে গেলাম। একদিন সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে আমি হাফিযের সাথে বের হয়ে গেলাম। আমাদের আসতে হবে নারায়নগঞ্জের দিকে। অনেকের সাথে মিলে আমরা লঞ্চ, বাসে, নৌকায় করে আসতে লাগলাম। আমি সেইসব দিকে যাব না। অনেক কষ্টে হানাদার দের নজর এড়ায়ে আমরা নারায়নগঞ্জে গেলাম। আমাকে ওখানে বন্দুক চালানোর ট্রেনিং দিল। একদিনের ট্রেনিঙেই অনেক কিছু শিখসিলাম। আমাদের কমান্ডার আমার উপরে অনেক খুশি হলেন। আমি হাফিয আর আরো বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে গেরিলা বাহিনীতে ছিলাম। ছোটবড় অনেকগুলা মিশনে আমরা যাই। নভেম্বরের দিকে এক মুখোমুখি যুদ্ধে আমার সাথী হাফিয মারা গেল গুলি খেয়ে। আমি অনেক কষ্ট পাইছিলাম কিন্তু মন ভেঙ্গে পড়ে নাই।
বারবার বাড়ির কথা মনে পড়তো। মনে হত কবে হবে আমাদের দেশ স্বাধীন? যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমার হাতে গুলি লাগে। কিন্তু আমি বেঁচে যাই। আর তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় না আমার। একসময় যুদ্ধ শেষ হল। বাড়ি আসবো বলে মনে মনে ঠিক করলাম। যেদিকেই তাকাই খালি লাশ আর লাশ। চোখে সয়ে গেছিলো এসব দেখতে দেখতে। খেয়ে না খেয়ে বাড়িতে পৌঁছুলাম’। এইটুকু বলে লোকটা থাকে একটু। গামছা দিয়ে চোখ মুছে নেয়। রকি আর বিপুলের মনটাও ভারী হয়ে গেছে। ‘তারপর কি হল?’ রকি প্রশ্ন করে।
‘আমার আসল গল্পও এখন শুরু ভাই। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম আমার মা আর নেই। পাক হানাদার বাহিনী আমার মা কে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমাদের গ্রামের অনেক মেয়েকে হানাদার বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। ওদের অনেকেরই কোন খোঁজ নেই। মারা গেছে অনেকেই। কয়েকজন শুনলাম আত্মহত্যাও করেছে। আমার বড় বোনটাকেও হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। কোন খোঁজ পেলাম না। আজও জানি না আমার বোনটার ভাগ্যে কি হয়েছিল’। এইবার আক্ষরিক অর্থেই কেঁদে ফেলল মানুষটা। পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে দিয়ে সান্ত্বনা দেয় রকি।
‘আমাদের গ্রামে শুনলাম দুইজন রাজাকার তৈরি হয়েছিল। একজন লতিফ সুমাদ্দার আর একজন টুনু মোল্লা। লতিফ মানুষের বাড়িঘর লুট করাতো আর টুনু মোল্লা মেয়েদের তুলে দিত হানাদার আর রাজাকারদের হাতে। লতিফ সুমাদ্দার কে ১৬ই ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যায়। পরে তার লাশ মধুমতির ঘাটের কাছে পাওয়া যায়। বাকী ছিল টুনু মোল্লা। আমি মনে মনে পণ করলাম, টুনু মোল্লাকে আমিই খুন করবো। আমার বেয়োনেটটা তখনো আমার সাথেই ছিল। পরের রাতে আমি মুখে একটা গামছা পেচায়ে টুনু মোল্লার ঘরে ঢুকে যাই। ঘুম থেকে জেগে উঠার আগেই আমি তার মুখ কাপড় দিয়ে শক্ত করে পেঁচায়ে দেই। জানের আতঙ্কে টুনু মোল্লা নড়াচড়া করার আগেই আমি তার বুকে পাড়া দিয়ে দুই হাত রশি দিয়ে বেঁধে দেই। আস্তে আস্তে হাত আর মুখ বাঁধা অবস্থায় টানতে টানতে মধুমতির ঘাটের কাছে নিয়ে দাঁড় করাই! টুনু মোল্লা বুঝে গেছিলো। তার আর বাঁচার কোন আশা নেই। তখনো সুভে সাদিক হয় নাই। চাঁদের আলো ছিল অনেক। আমি আমার মুখের থেকে গামছা সরালাম। টুনু মোল্লা অবাক হয়ে আমাকে দেখলো। তার দুই গাল বেয়ে তখন পানি পড়ছে। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়তে গেল। আমি ধরে আবার দাঁড় করায়ে দিলাম। বেয়নেট সরাসরি বুকের উপরে তাক করলাম। টুনু মোল্লার কানের কাছে গিয়ে একবার কইলাম শুধু, ‘আব্বা! তোমার পাপের কোন মাফ নাই। কালেমা পইড়া নেও’। একটা মাত্র গুলি করলাম। সব শেষ’।
‘ভাই আমি যাই এখন’। বলেই লোকটা উঠে দাঁড়ায়। রকি আর বিপুলকে ধাতস্ত হবার সময় না দিয়েই দ্রুত পায়ে উঠে চোখ মুছতে মুছতে রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যায় রাস্তায়।
বিপুল আর রকি কেউ মাটি থেকে মাথা তুলতে পারে না। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই চুপ হয়ে গেছে। অনেক্ষণ পরে বিপুল বলে, উনার নাম কি রে? উনার নামটা কি যেন বলল’?
‘উনি উনার নাম একবারও বলে নাই। আমরাও শুনতে ভুলে গেছি’।