মাংস

এক//

ভোর থেকেই আকাশে অনেক রোদ। চামড়া পুড়ে যায় যায় অবস্থা। ঘরের দরজায় বসে গায়ে সরিষার তেল মাখছে বেলাল মিয়া। একটু পরে নদীতে গোসল করতে যাবে। মনে স্বস্তি নাই। ঘরে শরিফাকে এই অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারছে না। পাশের বাড়ীর পারুলকে ডেকে এরপর যাবে। না হলে আজকে গোসল করবেই না। সকাল থেকেই মন কেমন কেমন যেন করছে। যে কোন সময় শরিফার ব্যথা উঠতে পারে। এই অবস্থায় কিছুতেই ওকে একা ফেলে রাখা যায় না। শরিফা উঠে এসে জলচৌকি নিয়ে বসে স্বামীর পাশে বসে। পিঠে স্ত্রীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে বেলাল মিয়া পেছনে ফিরে তাকায়। ‘একি শরিফা? তুমি উইঠা আইলা ক্যান? আমারে ডাক দিলা না ক্যান?’ বলেই ব্যস্ত হয়ে ব্যস্ত হয়ে যায় বেলাল মিয়া।
‘আমি কি সারাদিন শুইয়া থাকুম? ভালা লাগতাছিলো না।’ ক্লান্ত কন্ঠে বলে শরিফা।
‘তোমার শইল ভালা তো?’ বেলাল মিয়ার কন্ঠে উৎকন্ঠা।
‘হ ভালাই। তেলের বোতলডা দেন। আপনার পিঠে তেল মালিশ কইরা দেই’।
‘আরে না না। তুমি ঘরের ভিতর যাও’। বেলাল স্ত্রীকে তাড়া দেয়।

শরিফা স্বামীর হাত থেকে তেলের বোতল নিয়ে পিঠে তেল মালিশ করে দেয়। বেলাল মিয়া একলা মানুষ। মাঠে কাজ করতে যায়। পোয়াতী বৌয়ের খুব যত্নও করে সে। এটাই ওদের প্রথম বাচ্চা। বেলাল মিয়ার চিন্তার শেষ নাই। পারুলের মা এসে রান্না করে দিয়ে যায় একবেলা। তাই দিয়ে স্বামী স্ত্রী খেয়ে নেয়। খুব সুখের সংসার ওদের। তেল মালিশ করতে করতে শরিফা ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে থাকে। বাচ্চাকে মানুষ করতে হবে। মা বেঁচে নেই। মা থাকলে কি করতো না করতো সেটা মনে করে। মনের মধ্যে একটা হাহাকার ওঠে। পাঁচদিনের জ্বরে ভুগে মা কেমন করে জানি মরে গেলো! নিজের চিন্তায় ডুবে যায় শরিফা। বেলাল মিয়া একটা দা নিয়ে সেটার ধার পরীক্ষা করতে থাকে গভীর ভাবে। হঠাৎ করে কাঁধে শরিফার খামচি লেগে সম্বিত ফিরে পায়। তাকিয়ে দেখে এক হাত দিয়ে শরিফা পেট চেপে ধরে গোঙ্গানির মত আওয়াজ করছে। ‘কি হইছে তোমার?’ বলেই শরিফার পিঠে হাত দিয়ে এক হাত ধরে আস্তে আস্তে ওকে ধরে দাঁড় করায় বেলাল। ‘তোমার কি ব্যথা উঠছে নাকি?’ চিন্তায় কপালে অনেকগুলো ভাজ পড়ে গেছে তার।
মুখের ইশারা দিয়ে শরিফা সায় দেয় যে তার সম্ভবত ব্যথা উঠেছে। কপাল থেকে দরদর করে ঘামের ফোঁটা বেয়ে পড়ে বেলালের। শরিফাকে ঘরের চৌকিতে নিয়ে শোয়ায়ে দেয়। এক হাত দিয়ে তালপাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। শরিফার যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে ওঠে। শরিফা হাত দিয়ে পাখা নিয়ে নেয়। ‘বাতাস করতে হইবো না আপনের। আমার শীত শীত লাগতাসে’। স্ত্রীর কপালে হাত দিয়ে দেখে বেলাল মিয়া, গা টা বেশ গরম। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। রোদে পোড়া পরিশ্রমী মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেছে তার। ‘তুমি একটু বস। আমি পারুলের মায়েরে ডাইকা নিয়া আসি’। বলেই বেলাল চোট পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় প্রতিবেশী পারুলের মাকে ডাকার জন্য।

‘ভাইজান! ভাবির তো ব্যথা উঠছে। একটু একটু কইরা ব্যথা উঠতাছে। একটু থাকে তো আর একটু উঠে। আপনি শিগগির খালারে লইয়া আহেন’। পারুলের মা শরিফার ঘর থেকে বের হয়ে বলে।
‘অহনই যাইতাসি বইন। তুমি একটু থাইকো শরিফার কাছে। আমি অখনই যাইয়া খালারে লইয়া আইতাছি’।
‘আপনে যান। আমি ভাবির লগে আছি’। পারুলের মা শরিফার কপাল থেকে ঘাম মুছে দেয়। ক্রমাগত বাতাস করে চলে সে।
‘আপনে জলদি আইসেন। আমার ভালা লাগতাসে না’। সরু গলায় শরিফা বলে ওঠে।

বেলালের দুই চোখের কোনায় পানি জমে ওঠে। স্ত্রীর কষ্টের তীব্রতা তাকেও স্পর্শ করলেও কিছুই করার নেই তা চুপচাপ দেখা ছাড়া। আসে পাশের দশ গ্রামের মধ্যেও কোন বৈদ্য-কবিরাজ নেই। আর থাকলেই বা কি। চুপচাপ প্রসুতি মায়ের কষ্ট দেখা আর অপেক্ষা করা ছাড়া এই অসহায় মানুষগুলার যে আর কিছুই করার নেই! পুরুষ যতই স্পর্শকাতর হোক না কেন, স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রনার ভাগিদার হতে পারে না। বেলাল মিয়া গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছে ঘরের বাইরে চলে যায়। শরিফার দিকে তাকাতেও পারছে না। যন্ত্রণায় তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ‘আল্লাহ! তুমি আমার শরিফারে দেইখো’, মনে মনে এই দোয়াটুকু করেই পা চালায় বেলাল মিয়া। যত দ্রুত সম্ভব খালাকে নিয়ে আসতে হবে পাশের গ্রাম থেকে। উনি খুব ভালো দাই। গ্রামের অনেক মহিলার প্রসবের সময় পাশে থেকে সাহায্য করেছেন।

প্রায় ঘন্টাখানেক পরে, প্রৌঢ়া এক মহিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে বেলাল। মহিলা শরিফার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে বললেন, চুলায় গরম পানি, ন্যাকড়া, ব্লেড এইগুলা তৈরি রাখতে আর ঘরের থেকে দূরে না যেতে।
‘খালা আমি কি শরিফারে দেখতে পারুম না?’ বোকার মত প্রশ্ন করে বসে বেলাল।
‘অহন পারবা না। বাচ্চা হউক আগে। হের আগে ব্যাটারা ঘরে আইতে পারবো না’। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন দাই হালিমা বেগম।

বেলাল দ্রুত চলে গেল মোড়ের ধারে বোনের বাসায়, বোনকে খবর দিতে। এই বোনটার তিন মাস আগে একটা মেয়ে হয়েছে। উঠানে বসে সে মেয়েকে গোসল করাচ্ছিলো। ভাই এর কাছে ভাবির কথা শুনেই, মেয়েকে গা মুছিয়ে, একপ্রস্থ কাঁথায় জড়িয়ে, ভাবিকে দেখার উদ্দেশ্যে চললো সফুরা। সঙ্গে করে ননদ রাহেলা কে নিয়ে গেল মেয়েকে দেখাশোনা করার জন্য।

ভাই এর বাড়ি পৌঁছেই সফুরা চুলা ধরিয়ে পানি গরম করতে বসে যায়। বেলাল উঠানে অস্থির হয়ে পাইচারি করতে থাকে। সফুরা ভাইকে কয়েক দফা শান্ত হয়ে বসতে বলে। কিন্তু বেলাল যেন শুনতেই পায় না সেই কথা। অজানা আশঙ্কায় তার বুক ধড়ফড় করছে। শরিফার যদি কিছু হয়ে যায়! সে বাঁচবে কি নিয়ে? সংসারে তো আপন বলে কেউ নাই এই বোনটা ছাড়া। কিছুক্ষণ পরে ধাত্রী হালিমা বেগম, ঘর থেকে বের হয়ে গরম পানির খোঁজ করে। সফুরা পানির হাড়ি নিয়ে ঘরে যায়। বেলাল শুনতে পায় হালিমা বেগম সফুরাকে বলছে, ‘পানি ভাংতাসে। এইদিকে আবার গায়ে জ্বর আইসে’। বেলাল মিয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। মেয়েলি এই কথার মানে সে কিছুই বুঝতে পারে না। দুপুরের খিদা তার পেট থেকে উধাও হয়ে গেছে দুশ্চিন্তায়। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোন গতি নেই এখন।

এক এক করে ঘন্টা পার হয়ে যায়। ঘর থেকে একটু একটু পর পর শরিফার গোঙ্গানি ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। বেলাল মিয়ার সারা শরীর দুশ্চিন্তায় ঘেমে যায়। দুপুর গড়িয়ে যায়। এখনো কোন সংবাদ আসছে না। নিজের বোন সফুরার যখন বাচ্চা হল, তখন তো ব্যথা ওঠার তিন চার ঘন্টার মধ্যেই বাচ্চা হয়ে গেল। কিন্তু শরিফার কেন কিছু হচ্ছে না? বেলাল মিয়া কিছুই বুঝতে পারে না। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। রোদের তেজ এখনো কমেনি তেমন একটা। এমন সময় সফুরা ঘর থেকে বের হয়ে এলো। চোখ ফুলে গেছে কান্নায়। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ভাই এর সামনে এসে দাঁড়ায়। বেলাল বুঝতে পারে, হয়ত শরিফার অবস্থা ভাল না। বোনের কাছ থেকে সব শুনে বেলাল মিয়ার রক্ত পানি হবার উপক্রম হয়ে গেল। খালা জানিয়েছে, বাচ্চার মাথা নিচের দিকে নামে নাই। বাচ্চা ঘুরছে না। এভাবে চলতে থাকলে শরিফাকে হয়ত বাঁচানো যাবে না। এদিকে শরিফা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছে। কোনভাবেই আর সহ্য করতে পারছে না। বোনের কথা শুনেই বেলাল অনেক ভেঙ্গে পড়ে। ডুকরে কেঁদে ওঠে। এক মুহূর্তের জন্য মনের ভেতরে চঞ্চল শরিফার হাসিমুখটা ভেসে ওঠে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ব্যথা করতে থাকে বেলালের। মনে হয় যেন পায়ের নিচে কোন ঠাঁই পাচ্ছে না। বোন কিভাবে সান্ত্বনা দিবে ভাইকে বুঝতে না পেরে নিজেই কাঁদতে থাকে নীরবে।

বিকেল শেষ হয়ে যায়। মাগরিবের ওয়াক্ত প্রায় হতে চলল। দাই হালিমা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে আসে মাথা নীচু করে। অশ্রুসিক্ত বেলালের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাবা! আমার যা করার ছিল সবই করছি। আল্লায় জানে, কেন এমন হইল। বাচ্চার মাথা নামতাছে না। আপনি জলদি আহেন ঘরে। শরিফা আপনারে দেখতে চাইছে। মাইয়াডা আর সহ্য করতে পারতাছে না’। শেষের কথাগুলা বলতে গিয়ে প্রৌঢ়া মহিলা আর অশ্রুসংবরণ করতে পারলেন না।

দৌড়ে বেলাল ঘরে গেল। নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে যেন চিনতেই পারছে না। কে এই মেয়ে? এই কি তার সেই শরিফা? সকালেও কেমন দেখলো আর এখন এ কি চেহারা দেখছে সে! ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। মুখে যেন একফোঁটা রক্তও নেই। নড়াচড়ার শক্তিও নেই। চোখ বন্ধ করে আছে। দুই চোখের কোনা বেয়ে গালের উপরে পানির একটা ধারা দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে কোন মূহুর্তে পরপারে পাড়ি জমানোর জন্য অপেক্ষায় আছে শরিফা। বেলাল স্ত্রীর সরু একটা হাত নিয়ে নিজের বুকের কাছে রাখলো। কান্নার জন্য নিজে চোখে ভাল করে কিছু দেখতে পারছে না সে। স্বামীর হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ মেলল সে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। শরিফার পাশে বসে নীরবে কাঁদছে পারুলের মা। অসহায় মেয়েটার চলে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কারোরই কিছু করার নেই এখন।

কিছু একটা বলতে চাইলো শরিফা। কিন্তু বলার মত শক্তি আর নেই তার এখন। পেটের মধ্যে বাচ্চার নড়াচড়া বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীতে আসার জন্য বাচ্চাটা ছটফট করছে কিন্তু আসার রাস্তা সে খুঁজে পাচ্ছে না। স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু যেন হাসার চেষ্টা করলো বেচারী। ঠোট একটু বাঁকা হল মাত্র কিন্তু সেটা হাসি বলে মনে হল না। নিজের মনে মনেই যেন বেলাল বলে উঠলো, তুমি ভালা হইয়া যাইবা শরিফা। কিন্তু নিজেও জানে এই কথার কোন মানে নেই। লম্বা করে দুইবার শ্বাস টেনেই শরিফা কেমন যেন স্থির হয়ে গেল। চোখ উপরের দিকে খোলা। পারুলের মা, ‘শরিফা রে’... বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। সফুরা চোখ বন্ধ করে দিলো শরিফার। একটু আগেও বেলাল কাঁদছিল কিন্তু এখন আর তার চোখে পানি নেই। কেমন যেন অদ্ভুত একটা কাঠিন্য এসে ভর করেছে মুখে। ভাই এর এই চেহারা দেখে সফুরা ভয় পেয়ে গেল। শরিফা আর নেই। চিরতরে চলে গেছে। বেলাল কারো সাথে কোন কথা না বলে ঘরের দেয়ালে গুজে রাখা ছুরিটা হাতে নিলো। কালকেও ধার করেছে সে ছুরিটা। কাউকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ছুরিটা শরিফার তলপেট বরাবর ঢুকিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলো। কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে পারুলের মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। হালিমা বেগম কোন কথা বলতেও ভুলে গেল। বেলাল অতি দ্রুত ছুরি চালিয়ে শরিফার পেট একদিকে ফেঁড়ে ফেললো অনেকটা। আর চিন্তা করার সময় নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেলাল নাড়ি ছিড়ে ফেলে একটা রক্তে জড়ানো মাংসের দলা বের করে আনলো। প্রথমে কয়েক সেকেন্ড এটা নড়াচড়া করলো না। এরপর হঠাৎ এটি নড়ে উঠলো। জানান দিল যে, সে বেঁচে আছে। হালিমা বেগম দ্রুত বাচ্চাটিকে উল্টিয়ে ধরলেন পা ধরে। চিৎকার করে উঠলো বাচ্চাটি। পৃথিবীতে তার আগমন হল এক অব্যক্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে। বেলাল ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দুই//

শরিফার স্মৃতি কখনো ভুলতে পারেনি বেলাল মিয়া। ছেলেটা দেখতে হয়েছে অবিকল ওর মায়ের মত। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বেলাল মিয়া আর বিয়ে করে নি। বোন সফুরা দুধ খাইয়েছে ছেলেটাকে। চার বছর বয়স থেকে ছেলেকে নিজের কাছে এনে রাখে বেলাল। মাঠে কাজে যাবার যময় পারুলের কাছে দিয়ে যায়। পারুল ওকে খাইয়ে দেয়, গোছল করিয়ে দেয়। পারুলকে নিজের বোনের মত করেই জানে বেলালের ছেলে নিজাম। সেই ছোট্ট ছেলেটা দেখতে দেখতে এখন ক্লাস এইটে উঠে গেছে। ছেলের লেখা পড়ার দিকে অনেক নজর বেলালের। ছেলেকে বলে, ‘বাজান! বড়ো হইয়া তুই ডাক্তার হবি। মানুষের জান বাচাইবি। তোর মায়ের মত যেন কারো মইরা যাইতে না হয়’। নিজাম এর মায়ের জন্য তেমন কোন অনুভুতি কাজ করে না। তার সারা জগৎ জুড়ে আছে শুধু তার বাবা আর পারুল বুজি। কতবার বাবাকে দেখেছে মায়ের কবরের কাছে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে। বাবাকে কত বলেছে, ‘আব্বা তুমি আর কাইন্দো না’। কিন্তু বেলাল তার কথা শোনে না।

নিজাম পড়ছে ঘরে। বেলাল মাঠ থেকে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাজান, কি খাইবি? বাজারে যামু। কি খাইতে মন চায় তোর’?
‘গোসত আইনো আব্বা’। নিজাম বই থেকে মুখ তুলে উত্তর দেয়।
‘ঠিক আছে আনুমনে। অহন আমি কয়েক বস্তা ধান নিয়া যাইতাছি। এইগুলান বেইচ্যা তোর লাইগা গোসত কিন্যা আনুম’।
ধানের বস্তাগুলা ভ্যানের উপরে তুলতে বাবাকে সাহায্য করে নিজাম। বেলাল মিয়া ধানের বস্তাবোঝাই করে ভ্যান নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে চলে।

বিকেলে বেলাল ঘরে এল। ভ্যান চালিয়ে নয়। ভানের উপরে শুয়ে, লাশ হয়ে। লোকজন ধরাধরি করে বেলালের লাশ ঘরে নিয়ে এলো। সাথে এক টোপলা গরুর মাংস। নিজাম কথা বলতেও যেন ভুলে গেছে। লোকেরা জানালো, মাংস কিনে ঘরে ফেরার পথে, বেলালের বুকে আচমকা ব্যথা উঠে। বাজারের মধ্যেই পড়ে যায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ দিয়ে ফেনা উঠে মারা যায় বেলাল।

শরিফার কবরের পাশে বেলালের লাশ দাফন করার সময় এতিম ছেলেটা বলে, ‘আব্বা! গোসত খামু না। তুমি আমারে ছাইড়া যাইও না আব্বা। তুমি চইলা গেলে আমি কার কাছে থাকুম? আমি আর গোসত খাইতে চামু না। তুমি আমারে ছাইড়া যাইও না আব্বা...’। শূন্য মাটির ঘর থেকে বেলাল মিয়া ছেলের এই ডাকে সাড়া দেয় না। দেবার কথাও নয়।

তিন//

শুভ সকাল থেকেই চিন্তা করছে কখন দুপুর হবে! আজ কোরবানির ঈদ। এই একটা দিনই এমন আছে যেদিন বেশী করে মাংস খেলেও মা বকা দেয় না। আর মা বকা দিতে চাইলেও বাবা নিষেধ করেন। শান্তা তার এই ছেলের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। ছেলে জন্মের পর থেকেই বেশ স্বাস্থ্যবান। নিষেধ করলেও শুনবে না। গরুর মাংস দেখলে ছেলের মাথা ঠিক থাকে না। মায়ের নজর এড়িয়ে হলেও ঠিকই বেশী করে খেয়ে নেবে! বকা ঝকা দিয়েও ছেলের সাথে খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারে না শান্তা। এদিকে মেয়েটা হয়েছে ভাই এর উলটা। তালপাতার সেপাই এর মত শরীর। মেয়ে কেন ঠিকমত খায় না, এটা শান্তার দুই নম্বর দুশ্চিন্তার কারণ! শান্তা ভেবে পায় না, দুই ভাই বোনের মধ্যে এত অমিল হয় কিভাবে? শুভ ক্লাস এইটে পড়ে আর মিতু পড়ে ক্লাস ফাইভে। হয় নয় কথায় দুই ভাই বোন ঝগড়া করে বসে থাকে। দুই ছেলে মেয়ের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতেই শান্তার দিন কেটে যায়। ডাক্তার স্বামী সারাদিন রোগী আর হসপিটাল নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে বাসায় ফেরারও অবসর হয় না। ছেলে মেয়েগুলা এমনও দিন গেছে, কয়েকদিন ধরে বাবাকেই দেখে না। সংসারের ঝক্কি ঝামেলা সব শান্তাকেই সামলাতে হয়। অবশ্য এজন্য শান্তা কখনো স্বামীকে দোষারোপ করে না। পাকা গৃহিনীর মত সবকিছু ঠিকই সামলে নেয় সে।

রান্না করার মাঝে দুইবার শুভ রান্নাঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছে। মায়ের রান্না হয়ে গেল কিনা! শান্তা বলে, ‘তুমি কি কাঁচা মাংসই খেয়ে ফেলবা নাকি বাবা? একটু সবুর কর। এইত রান্না প্রায় হয়ে গেল’। শুভর আর দেরি সয় না। এর মধ্যেই মিতুর সাথে একচোট ঝগড়া করা হয়ে গেছে খাওয়া নিয়ে। কারণ মিতু শুভকে ‘ছুচা-পেটুক’ বলেছে। শুভর বাবা ডাঃ নিজামুদ্দিন ছেলেমেয়ের এই কান্ড খুব আনন্দ নিয়ে উপভোগ করছেন। শান্তা স্বামীকে বলে, ‘তুমি কি পারো না ছেলেমেয়েকে একটু বকা দিতে’? নিজাম তখন বলে, ‘দেখো, ছেলেমেয়ে দুইটা আমাকে পায়ই বা কতক্ষণ? আমি আর বকা দিয়ে ওদের কাছে খারাপ হতে চাই না। তুমিই সামলাও’। শুনে শান্তা গজগজ করতে করতে আবার রান্নাবান্নার দিকে মন দেন। স্বামী বেচারাকে শুধু শুধু দোষ দিয়েও লাভ নেই!

অবশেষে দুপুরের খাবার সময় চলে এসেছে। শুভর আর দেরী সইছে না। তারাতাড়ি গরুর মাংসের বাটি নিয়ে নিজের প্লেটে বেশী করে মাংস তুলে নিল। পাছে যদি মা আবার কিছু বলে বসে! মিতু টেবিল এ বসে পা দোলাচ্ছে। খাবার ব্যাপারে তার খুব একটা উৎসাহ নেই। তবুও ঈদের দিন বলে কথা। শান্তা মেয়ের প্লেটে খাবার আর মাংস তুলে দিলেন। শুভ একটা মাংসের টুকরা কেবল মুখে দিবে, এমন সময় মিতু ভাই এর কনুইতে একটা টোকা দিল। অযাচিৎ এই টোকা পেয়ে শুভ বিরক্ত হয়ে বোনের দিকে তাকায়। মিতু চোখের ইশারা দিয়ে ভাই কে বাবার দিকে তাকাতে বলে। শুভ তাকিয়ে দেখে বাবা প্লেটে ভাত নিলেও মাংস নিচ্ছে না। কিছুই খাচ্ছে না বাবা। বাবার চোখ ছলছল করছে। শুভ বলল, ‘একি বাবা? তুমি খাচ্ছো না যে? কি হইসে তোমার’?

নিজাম ছেলের ডাকে সাড়া দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকাতেই দুই চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তড়িঘড়ি করে বাম হাত দিয়ে মুছতে গিয়েও ছেলেমেয়ের কাছে লুকাতে পারলেন না। ‘একি বাবা তুমি কাঁদছো কেন’? মিতু প্রশ্ন করে।
‘কই মা কাঁদছি না তো। তোমরা খাও। তোমরাও তো খাচ্ছো না’। একটু সহজ হতে চেষ্টা করে নিজাম।

‘বাবা! তোমার আজকে দাদার কথা মনে পড়েছে তাই না? তাই তুমি মাংস খেতে পারছো না’? শুভ এবার প্রশ্ন করে বাবাকে। উত্তরে নিজাম কিছুই বলেন না। আজ তার নিজের বাবাকে বড্ড বেশী করে মনে পড়ছে। কোন খাবারই মুখে উঠছে না তার।

‘বাবা!’ শুভ আবার ডাক দেয়, ‘তুমি যদি আজ আমাদের সাথে মাংস না খাও, তাহলে আমরাও কেউ খাব না। তুমি আজকে কিছুতেই মন খারাপ করতে পারবে না। তোমাকে আজকে মন খারাপ থাকতে দেব না বাবা। এই নাও আমার হাত থেকে একটা মাংস খাও’ বলেই বাবার মুখের দিকে এক টুকরা মাংস তুলে ধরে শুভ।
‘আমার কাছ থেকেও একটা খেতে হবে বাবা’, বলে মিতুও এক টুকরা মাংস বাবার দিকে তুলে ধরে।
অশ্রুসিক্ত চোখে নিজাম তার দুই সন্তানের কাছ থেকে দুই টুকরা মাংস মুখে তুলে নেন। আজ আর সে মন খারাপ করবে না। অনেক দুঃখের মাঝেও কিছু সুখের অনুভুতি নিয়ে বেঁচে থাকার পুঁজি কিছু না কিছু থেকেই যায়।

[আমার এই গল্পটা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারানো সব মায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত]

Author's Notes/Comments: 

15th September 2012

View shawon1982's Full Portfolio