‘চমকাবে না’ সেই অভিনয়ে শান্তা নিজেকে অনেক পটু ভাবলেও ঠিকই চমকে গেল কিছুটা। খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখলে অবশ্য বোঝা যেত না। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তানভীর সেটা দেখে বুঝে গেল। হাসি হাসি মুখ করে বললো, কি আপু, চমকে গেলেন মনে হয়?
শান্তা পালটা হাসি দিয়ে বললো, না তেমন না। অনেক দিন পরে এলে। ঘরে এসো। এই বলে শান্তা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। তানভীর ঘরে ঢুকলো। হাতে একটা প্যাকেট। ড্রইং রুমে ঢুকে হাতের প্যাকেটটা টি-টেবিলের উপরে রেখে দিলো। বললো, ভাইয়া কোথায় গেছে? উনাকে না বলেই চলে এসেছি। ভাবলাম একটা সারপ্রাইজ দেই?
যদি আমরা বাসায় না থাকতাম? এতদূর থেকে হুট করে চলে এলে? শান্তা পাল্টা জানতে চায়।
তাহলে কি আর করা, ফিরেই চলে যেতাম ফিরতি বাস ধরে। তানভীর মুখে হাসি ধরে রাখে।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে হাতে একটা ভাঙ্গা গাড়ী নিয়ে হৈ চৈ করতে করতে শান্তার তিন বছরের ছেলে নিলয় ঘর থেকে বের হয়ে এসে ড্রইং রুমে এসে তানভীরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন চিনতেই পারছে না।
তানভীর নিলয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। কি রে ব্যাটা আমাকে চিনতে পারছো না? আমি তোমার চাচ্চু হই! তানভীর চাচ্চু!
নিলয়ের তেমন কেন আগ্রহ দেখা গেল না তানভীরের দিকে এগিয়ে যাবার। শান্তা পেছন থেকে একটু ঠেলে এগিয়ে দিতে চাইলেও নিলয় তেমন কোন আগ্রহ দেখালো না। উলটা যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই চলে গেল হাতের সেই ভাঙ্গা গাড়ীটা নিয়ে। শান্তা বললো, একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। তখন জ্বালিয়ে মারবে। অনেক দুষ্টু হয়েছে। তোমাকে অনেক দিন পরে দেখলো দেখে এমন করেছে।
তানভীর বললো, না না ঠিক আছে। একটু পরেই ঠিকই আমি ভাতিজাকে পটিয়ে ফেলবো। তা ভাইয়া কোথায়?
শান্তা খুব শান্ত ভাবে বললো, ও তো বাসায় নেই। সেই সকালে কাজে বেরিয়েছে। আসতে একটু দেরী হতে পারে।
অসুবিধা নেই। আমি হাতে সময় নিয়ে এসেছি। অনেকদিন দেখা হয় না ভাইয়ার সাথে। এবার দেখা না করে যাবো না। তানভীর অকপটে জানালো। হাতের প্যাকেট টা শান্তাকে দিয়ে বললো, বাচ্চাদের জন্য কিছু চকলেট আছে আপু। ওদেরকে দেবেন।
শান্তা প্যাকেটটা নিলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সেটার দিকে। এরপর তানভীরকে বললো, তুমি হাতমুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নাও। আমি রান্না বসিয়েছি। শেষ করি। অর্পা কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি অর্পার সাথে বসে কোন একটা মুভি টুভি কিছু দেখো।
অর্পা কোন ক্লাসে উঠেছে আপু?
ক্লাস টু তে। তুমি বসো। হাতের প্যাকেটটা নিয়ে পর্দা সরিয়ে শান্তা ভেতরের ঘরে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে অর্পা একটা ড্রইং বুক আর রঙ পেন্সিলের সেট নিয়ে হাজির হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় তানভীরের দিকে। তাকিয়ে দেখে তানভীর কে। কেমন আছো মামনি? এই কথা বলে তানভীর হাত বাড়িয়ে টেনে নেয় অর্পাকে। নিজের পাশের সোফায় বসায়।
ভাল। খুব সংক্ষেপ জবাব দেয় অর্পা। যেন কথা ফুরিয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখে তানভীর কে। কি দেখছো মামনি? বলতো আমি কে?
তুমি তানভীর চাচু। আমি জানি। এ কথা বলে অর্পা তার ড্রইং খাতা খুলে বসে। কি আঁকছো মামনি? তানভীর প্রশ্ন করে।
আমাদের আর্ট ক্লাসে একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছে। সেটা আঁকছি।
তানভীর টিভি দেখতে লাগলো আর অর্পা তানভীরের সাথে মাঝে মাঝে দুই একটা গল্প করতে করতে ড্রইং করতে লাগলো। একবার তানভীর অর্পাকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমার আব্বু কখন আসবে? তখন প্রত্যুত্তরে অর্পা শুধু বললো, জানিনা চাচু।
দুপুরে শান্তা খাবার টেবিলে খাবার গুছিয়ে ওদের ডাক দিলো। তানভীর খেতে বসে বললো, এত কিছুর আয়োজন করেছেন কেন আপু? শান্তা বললো, এ আর এমন কি? মাঝে মাঝে তো একটু খাওয়াই যায়। তখন তানভীর বললো, ভাইয়া আসলো না? উনি আসলে একসাথে খাওয়া যেত। শান্তা তখন বললো, তোমার ভাইয়া কাজে আটকা পড়ে গেছেন। আসতে আসতে বিকাল হয়ে যেতে পারে। তোমাকে খেয়ে নিতে বলেছে। খাবার বেড়ে দিতে দিতে শান্তা বললো।
আপু আপনি আমাদের সাথে খেয়ে নেন। তানভীর বললো।
না আমি এখন খাবো না। একটু পরে খাবো। তোমরা খেয়ে নাও। স্থির ভাবে শান্তা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। খাবারের তদারকি করতে থাকে।
বিকাল যখন প্রায় হয়ে হয়ে যায়, তখন তানভীর আবার বলে, আপু ভাইয়া কি আসবেন না আজকে? আমার তো যাবার সময় হয়ে এলো প্রায়। বাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।
শান্তা বললো, ঠিক আছে তুমি তৈরী হয়ে নাও। তোমার ভাইয়াকে আমরা হয়ত পথেই পেয়ে যাবো। তখন কথা বলে নিও।
এর কিছুক্ষণ পর শান্তা ওর দুই বাচ্চাকে নিয়ে তানভীর সহ রাস্তায় বের হয়ে এলো। গন্তব্য জহিরের খোঁজে। এতক্ষন জহিরের সাথে যোগাযোগ হয়নি। তানভীর ও ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে জহিরের সাথে দেখা করার জন্য। অনেকদিন দেখা হয় না। যোগাযোগ হয় না। আগের ফোন এ ফোন দিয়েও নাকি পাওয়া যায়নি জহির কে। শান্তা জানিয়েছে, আগের ফোন নাম্বার পরিবর্তন করা হয়েছে। হয়ত ব্যস্ততার জন্য নাম্বার দিতে ভুলে গেছে জহির।
সূর্যের আলো তখন ধরে এসেছিল। পড়ন্ত বিকেল। বাইরে মৃদু মৃদু একটু বাতাস হয়ে যাচ্ছিলো। বেশ মনোরম পরিবেশ। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে রাস্তা ধরে এগোচ্ছিলো। এমন সময় শান্তা বলে উঠলো, তানভীর তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল ভাই।
জ্বী আপু বলেন।
তুমি এখন কোন বর্ষে পড়ছো?
এইতো আপু, তৃতীয় বর্ষে।
শেষ হতে কতদিন বাকী?
সেশন জটে না পড়লে আর ধরেন বছর দেড়েকের মত লাগতে পারে।
বাহ খুব ভাল। এরপর কি করবে?
বাইরে যাবার ইচ্ছা আছে আপু।
তোমার ভাইয়াও তাই বলতো, সবসময়ই বলে যে তানভীর এর বাইরে যাবার এতো ইচ্ছে, ও যেন ওর মনের মত একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে যায়। অনেক লেখাপড়া করার ইচ্ছা তোমার। তোমার কথা সবসময়ই তোমার ভাইয়া বলে।
আপনাদের কথাও আমার সবসময় মনে হয় আপু।
তাই নাকি? শান্তা কথার ছলে জিজ্ঞাসা করে।
জ্বী আপু।
আচ্ছা শোন। তোমার কি মনে আছে, আজ থেকে প্রায় মাস চারেক আগে তোমার ভাইয়ের যাওয়ার কথা ছিল তোমার হলে, তোমার সাথে দেখা করার জন্য?
জ্বী আপু মনে পড়েছে। ভাইয়া বলেছিলেন দেখা করতে যাবেন। কিন্তু আর জাননি তো। এরপরে আমিও লেখাপড়া নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পরীক্ষা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে। আমিও আর দেখা করার সুযোগ পাইনি। ভাইয়া যাবেন বলেছিলেন মনে পড়েছে, কিন্তু জাননি আপু।
তোমার ভাইয়া গিয়েছিল। তোমার জন্য বেশ কিছু খাবার দাবারও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।
বলেন কি? আমি তখন কই ছিলাম? ভাইয়া গেলেন এত কষ্ট করে, অথচ না বলেই চলে এলেন কেন? কিছুই জানতে পারতাম না। তানভীর বিস্ফোরিত চোখে তাকায় শান্তার দিকে। ওদের চলার গতিও থেমে যায়। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। এভাবে হেঁটে হেঁটে বেশীক্ষণ কথা বলাটা মুশকিল।
হ্যাঁ তোমার দরজা পর্যন্ত গিয়েছিল। এরপর ফেরত চলে আসে। তখন তুমি তোমার রুমমেটদের সাথে তোমার ভাইয়াকে নিয়ে কি কি বলেছিলে তোমার মনে পড়ে?
তানভীর এবার মাথা নীচু করে ফেলে।
তুমি বলেছিলে, ‘আর বলিস না। জ্বালায়ে খেলো। কই না কই রাস্তায় একবার পরিচয় হয়েছে। এরপর থেকে ভাই বানিয়ে নিয়েছে। হুটহাট করে দেখা করতে চলে আসে। সবকিছুর খোঁজ খবর নেয়। ধুর, ভাল্লাগে না। আজকেও নাকি বলেছে আসবে। আজ আমার শর্মির সাথে দেখা করার কথা অথচ উনি আসবেন বলে শর্মির সাথের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে বসে আছি। কইতেও পারি না সইতেও পারি না’। মনে পড়ে তানভির কথা গুলো?
তানভীর কোন জবাব দেয় না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্পা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। নিলয় একটা কাঠি চকলেট চুষতে থাকে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে।
তোমার বলা সেই কথাগুলো যখন বলেছিলে, তখন তোমার ভাই তোমার দরজা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এরপর এগুলো শুনে দরজা থেকে চলে আসে। তোমার ভাই আমাদের মত সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করতো না। অনেক বেশী আবেগ নিয়ে চলতো। ও আসলে বুঝতেই পারেনি, রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে ভাই ভাই সম্পর্ক হতে পারে, সেটা ওর কাছে অনেক মূল্যবান হলেও, যাকে ভাই বানিয়েছে তার কাছে নাও হতে পারে। ও যেমন এত দূর থেকে পাগলের মত শুধু তোমাকে দেখার জন্য ছুটে যেত, তেমনি ওর উপস্থিতি তোমার ভাল নাও লাগতে পারে। এটা বুঝতে পারতো না। ওর সমস্যা এটাই ছিল। এই নিয়ে আমাকের মধ্যে কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে। ওকে বোঝাতেও চেষ্টা করেছি। বোঝেনি। বুঝতে চাইতো না।
তানভীর এবারও কিছু বলে না।
শান্তা বললো, এরপরে কি হলো আমার কাছেই শুনে নাও। এরপর তোমার ভাই এর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ও কাছেই আছে। এরপর হাতের সমস্ত খাবার নিয়ে তোমার ভাই পার্কে চলে যায়। চুপচাপ ওখানে অনেক্ষণ বসে ছিল। হাতের সমস্ত খাবার যেগুলো তোমার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, একে একে সব পথশিশুদের দিয়ে দেয়। এরপর খালি হাতে বাসায় আসে। ওর মুখ কালো দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম কিছুটা। আমাকে তখনই বলেনি। বেশ কয়েকদিন পরে বলেছিল, যখন ধরা পড়ে ওর দুটা কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। তোমাকে বলতে মানা করেছিল দেখে আমরা বলিনি। জহিরের কিডনিতে সমস্যা ছিল। ডায়ালায়সিস করেও তেমন সুবিধা হয়নি। তোমার ওখান থেকে চলে আসার পরে আসতে আসতে ওর শরীর অনেক খারাপ হয়ে পড়ে। সাধ্যমত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করেও কিছু করা যায় নি। অনেক অভিমানী ছিল। কারও কাছ থেকে কোন সাহায্যও নেয় নি। কাউকে জানতেও দেয় নি। বারবার বলতো, আমার যা সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে চিকিৎসা হলে হবে না হলে নেই। চলে যাবার আগে তোমার ভাই আমাদের সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আমি যেন অন্তত দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে পথে না বসি। তুম যদি কোনদিন আসো তাহলে আমি যেন সাথে সাথে বলে না দেই, সেটাও আমাকে বলে গিয়েছিল। তুমি তোমার ভাইকে দেখবে বলেছিলে না? আসো দেখে যাও। রাস্তার পাশের গোরস্থানের একটা নতুন কবরের দিকে ইঙ্গিত করে শান্তা বলে, এই যে জহির! কি যেন বলেছিলে তানভীর? জ্বালিয়ে মারছে না? আর তো জ্বালাবে না ভাই। একদমই চলে গেছে। কাউকেই আর জ্বালাবে না। বলতে বলতে নিজের ওড়না দিয়ে চোখ মোছে শান্তা।
তানভীর তখন নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে জহিরের কবর তাকিয়ে দেখে।
তোমার বাসের সময় হয়ে এলো জহির। বাস মিস করলে তোমার সমস্যা হবে। দেরী হয়ে যাবে। তুমি যাও। অর্পা, নিলয় চল আমরা বাসায় যাই। বলে শান্তা দুই ছেলে মেয়েকে তাড়া দেয়। সন্ধ্যা হয়ে এলো বাবা। বাসায় গিয়ে পড়তে বসতে হবে।
মা, সায়াহ্ন মানে কি? অর্পা জিজ্ঞাসা করে।
তুমি এই কঠিন শব্দ কোথা থেকে শিখলে অর্পা?
স্কুলে এক ম্যাডামকে বলতে শুনেছি মা।
সায়াহ্ন মানে সন্ধ্যা! এই যেমন এখন। চল আমরা বাসায় যাই। শান্তা তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় ফেরার পথ ধরে। জহির আর তানভীর যে যার অবস্থানে থেকে যায়। শুধু শান্তাকে একরাশ শূন্যতা ঘিরে ধরে। যেই শূন্যতা পূরণ হয় না।