বাকী অংশ

১.

 

ঘুম থেকে উঠেই ঘড়ি দেখা সজলের অভ্যাসের পরিণত হয়ে গেছে। যথারীতি অ্যালার্ম বন্ধ করে বালিশের নীচে রাখা হাতঘড়িটা টেনে বের করে সময় দেখে ভাবলো, এমন কিছু দেরী হয়নি। উঠে বসলো বিছানায়। নিউজ ফিড স্ক্রল করার সময় নেই ঠিকই কিন্তু নিজেকে তৈরী করে অফিসে যেতে সময় লাগবে না। মনে মনে স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানালো সজল। নিউ ইয়র্কে এসে এমন একটা চাকরী পেয়ে যাবে কখনও ভাবেনি ও। হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়া ওর সার্থক হয়েছে। নিউ ইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত “স্বাদ রেস্টুরেন্ট” এর ম্যানেজার এর দায়িত্বে নিয়োজিত আছে সে গত এক বছর ধরে। রেস্টুরেন্ট এর মালিক একজন বাংলাদেশী এবং মিলিওনিয়ার। কিন্তু উনার চালচলন এমন আড়ম্বরহীন যে উনাকে দেখলে বোঝাই যায় না উনি এত টাকার মালিক হয়ে গেছেন। রেস্টুরেন্টের প্রতিটি কর্মচারীর সাথে অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার করেন সজলের বস। দিন শেষে সজলের কাছ থেকে হিসাব নিকাশ সব বুঝে নেন। রেস্টুরেন্টের খরিদ্দাররা সবাই যে বাংলাদেশী, তা নয়। বাংলাদেশী খাবারের স্বাদ নিতে এখানে ভারতীয়, মেক্সিকান, আমেরিকান সহ নানা বর্ণের মানুষই আসে। কিন্তু খাবারের মেন্যু যা যা তৈরী হয়, তার সবই বাংলাদেশী ঘরানার খাবার।

 

দ্রুত হাতে ইউনিফর্মটা পরে গলার কাছে টাই-টা ঠিক করলো সজল দক্ষ হাতে। এখন সোজা একতলা নীচে নেমে অফিস ডেস্কে চলে যাবে। সব কিছু সেখান থেকে তদারকি করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বসও এসে যাবেন আর সেই সাথে কাস্টমার দেরও দেখা মিলবে। আজকে  সাপ্তাহিক ছুটির দিন বিধায়, কাস্টমারের সংখ্যা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশীই থাকবে। ডেস্কে এসে সজল দেখলো, কয়েকজন বেয়ারা চেয়ারগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে। খাবারের ডিসপ্লেতে নানা রকম বাংলাদেশী খাবার শোভা পাচ্ছে। কাষ্টমার নিজে দেখে শুনে খাবারের অর্ডার দিতে পারে ইচ্ছে করলে। খাবারের অর্ডার নেয়ার জন্য বেয়ারারা সবাই প্রস্তুত আছে। বস আসার আগেই সবকিছু ঠিক ঠাক দেখে সজল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আজ পর্যন্ত তার বস কাউকে ধমকে কথা বলেছেন, সজল দেখেনি। তবুও কর্মচারীরা তাকে অত্যন্ত সমীহ মিশ্রিত ভয় করে চলে। বস নিজেই প্রত্যেকের খোঁজ আলাদা আলাদা করেই রাখেন। বসের অফিসটাও রেস্টুরেন্ট এর এক কর্ণার এ। উনি ওখানে বসেই সি.সি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেন। দরকার হলে কামরা থেকে বেরিয়ে এসে তদারকি করেন। সজল দেখলো ইতিমধ্যেই এক বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান দম্পতি কফি আর বিয়ার অর্ডার করে টেবিলে বসে গল্প করছে আর খাচ্ছে।

 

সজল সব ঠিক ঠাক আছে তো? হালকা স্বরে জানতে চাইলেন শিহাবুর রহমান সাহেব। স্বাদ রেস্টুরেন্ট এর কর্ণধার।

সজল একটু অন্যমনষ্ক হয়ে ছিল। তড়িৎ গতিতে সম্বিত ফিরিয়ে এনে বললো, আসসালামু আলাইকুম স্যার। জ্বী স্যার সবকিছু ঠিক আছে। আপনি কেমন আছেন স্যার?

ভালো আছি সজল। বাকীরা সবাই ভাল আছে তো?

জ্বী স্যার সবাই ভাল আছে। স্যার আপনি কি একটা ড্রিঙ্ক নেবেন?

হ্যাঁ আমার ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দাও।

জ্বী স্যার এখনই দিচ্ছি।

 

শিহাবুর রহমান যেমন নিঃশব্দে প্রবেশ করেছিলেন, তেমনই নিঃশব্দে নিজের কামরায় চলে গেলেন আবার। এই মানুষটার এমন নিঃশব্দ চলাফেরা সজলকে খুব অবাক করে দেয়। প্রতিদিন নিজের কামরায় বসে এক কাপ কফি খান শিহাবুর রহমান সাহেব। এর কোন ব্যতিক্রম সজল দেখেনি চাকরি শুরু করার পর থেকে।

 

ইতিমধ্যেই রেস্টুরেন্ট এর অনেক চেয়ার টেবিলে লোকজন বসেছে। বেয়ারাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। ওরা টেবিলে টেবিলে ছোটাছুটি করে অর্ডার নিয়ে সার্ভ করছে। সবকিছু সজল তার ডেস্ক থেকেই দেখতে পাচ্ছে। বসের কাঁচ ঘেরা ঘরে যে কেউ বসে আছে সেটা বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। এমন সময় ডেস্কের টেলিফোনটা অতি মৃদু শব্দ করে বেজে উঠলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো যে নাম্বার সেটা সজলের বস শিহাবুর রহমান সাহেবের।

 

শিহাবুর রহমান সাহেবের বয়স মাত্র বিয়াল্লিশ হলো। কিন্তু উনাকে দেখলে কোন ক্রমেই ত্রিশের বেশী মনে হয় না। একদম যেন সজলের বয়সীই মনে হয়। এমন সুদর্শন সুপুরুষ মানুষ এখনও কেন বিপত্নীক আছে, সেটা সজলের মনে অনেকবার এলেও, বসকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় নি। সজল ফোন তুলে অফিসের নিয়মানুসারে ইংলিশ এই বললো-

গুড মর্নিং স্যার। কিছু লাগবে আপনার?

সজল তুমি এক্ষুণি আমার ঘরে আসো। শিহাব দ্রুত তাড়া দিলো। শিহাবের কন্ঠে এমন উৎকণ্ঠা দেখে, সজল ফোন ছেড়ে দিয়েই হাজির হলো শিহাবুর রহমান সাহেবের কামরায়।

সজলকে দেখে, শিহাব বললেন, আমি অতি দ্রুত তোমাকে কিছু কথা বলবো, তুমি এখন সেইভাবে কাজ করবে এবং অফিসের প্রতিটা স্টাফকে জানিয়ে দাও কেউ যেন কোন রকম প্রশ্ন না করে। এরপর শিহাব অতি দ্রুত সজলকে কয়েকটি নির্দেশ দিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে চেঞ্জ রুমে চলে গেলেন।

 

২.

 

ম্যাডাম আপনার জন্য কি অর্ডার করতে পারি? চোস্ত ইংরেজিতে বেয়ারা জিজ্ঞাসা করলো সামনে বসা একজন বয়স্ক মহিলাকে। দেখে ভারতীয় বা বাংলাদেশী বলেই মনে হয়। তার চোখে একটা সানগ্লাস পরা। বয়স বোঝা না গেলেও এতটুকু আন্দাজ করা যায় ষাটের আশেপাশে কিছু হবে। মহিলার সামনে চশমা পরা একটি ছেলে আছে। ছেলেটির গায়ের রঙ তার মায়ের মত নয় বরং অনেকটাই শ্যামলা। ছেলেটা যে জড়বুদ্ধির, তা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। বয়স পঁচিশের মত হবে বা হয়ত আরও কিছু বেশী। হাতে একটা সফট টয় নিয়ে বাচ্চাদের মত উলটে পালটে দেখছে।

রাফিদ তুমি কি খাবে? মহিলা বাংলায় জিজ্ঞাসা করলেন ছেলেকে।

ছেলে কিছু উত্তর না দিয়ে মুখ দিয়ে কিম্ভুত একটা ঘোঁত জাতীয় শব্দ করে আবার সফট টয় নিয়ে খেলায় মন দিল। সে আবার পুতুলটা একটা গ্লাসের মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। পাশেই বেয়ারা কাগজ কলম নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে অর্ডার নেয়ার জন্য।

 

মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বেয়ারার দিকে না তাকিয়েই অর্ডার বললেন। বেয়ারা অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই ভদ্রমহিলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন দেখতে লাগলেন। পরিষ্কার আকাশে তুলোর মত মেঘ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উনি হয়ত সেটাই দেখতে লাগলেন। ছেলে একমনে পুতুলটি গ্লাসে সম্পূর্ণ ভরে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

বেয়ারা খাবার নিয়ে এলো। বললো, আর কিছু লাগবে ম্যাডাম?

ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে না বললেন। বেয়ারা চলে গেল।

প্রায় মিনিট পনেরো পরে, খাওয়া শেষ হলে, বেয়ারা আবার নিঃশব্দে পাশে এসে টেবিল থেকে এটো থালা বাসন সরাতে লাগলো। এমন সময়, ছেলেটি মেঝেতে গ্লাসটি আছড়ে ভাঙল আর বলতে লাগলো, যায় না কেন? যায় না কেন? যায় না কেন?

চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে, মহিলার ছেলের কানের কাছে গিয়ে কিছু একটা বললেন। ছেলে চুপ করে উঠে আবার ঘোঁত জাতীয় একটা শব্দ করলো। ততক্ষনে অন্য একজন বেয়ারা ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা গুলি সব সরিয়ে নিয়েছে।

ভদ্রমহিলা ব্যাগের থেকে ব্যাংক এর ডেবিট কার্ডটা বের করে বেয়ারার হাতে দিয়ে বললো, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। এই গ্লাসের জন্য যে জরিমানা দিতে হয় সেটা বিলের সাথে কেটে রাখুন।

না না ঠিক আছে ম্যাডাম। এই গ্লাসের জন্য আপনাকে কিছু পে করতে হবে না। বেয়ারা এবারের কথাগুলো বাংলায় বললো।

 

মহিলা এই প্রথম বেয়ারার মুখের দিকে তাকালেন এবং কেমন যেন জমে গেলেন। একবার ঠোঁট নাড়তে গেলেন কিন্তু কথা বের হলো না। বেয়ারার চেহারায় কি যেন একটা দেখতে পেলেন। ডেবিট কার্ডটা নিয়ে বেয়ারা চলে গেল বিল রাখতে। কার্ড ফেরত দিতে অন্য একজন বেয়ারা এলো। কার্ড হাতে নিয়ে যে এলো, তার দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, একটু আগে যে এসেছিল, সে কোথায় গেছে?

উনাকে বস একটি কাজে পাঠিয়েছেন মাত্র।

আমি আপনার বসের সাথে কথা বলতে পারি?

ম্যাডাম, আপনার কথা তাহলে আমার বসকে জানাতে হবে। আপনি চাইলে আমি উনার অনুমতি নিতে পারি।

না ঠিক আছে, আমি কাল আসবো। আপনার বসকে কি আগামিকাল আসবেন?

জ্বী ম্যাডাম, স্যার আসবেন। আপনি কাল কখন আসতে চাচ্ছেন ম্যাডাম?

লাঞ্চের সময়।

ঠিক আছে ম্যাডাম আমি আমার বসকে জানিয়ে দেবো।

বেয়ারা চলে গেল। ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন। কোন একটা টেবিল এ কয়েকজন তরুণ তরুণী কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে।

 

৩.

 

আমি আসতে পারি? ভদ্রমহিলা কাঁচের দরজা ঠেলে অনুমতি চাইলো।

জ্বী জ্বী নিশ্চই। গুড মর্নিং ম্যাডাম। আমার স্টাফ গতকাল আপনার কথা আমাকে বলে রেখেছে। ম্যাডাম আপনি কি আমাদের কারও ব্যবহারে অসন্তুষ্ট কিংবা খাবারের মান নিয়ে কোন অভিযোগ করতে চান?

না সেসব কিছু নয়। আমার কোন অভিযোগ নেই।

তাহলে ম্যাডাম আমি আপনাকে কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?

ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আজও তার চোখে সেই সানগ্লাস। টেবিলের উলটো দিকে বসা স্বাদ রেস্টুরেন্টের মালিকও নিঃশব্দে বসে রইলেন কখন ভদ্রমহিলা মুখ খুলবেন এই আশায়।

 

আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি বাংলাদেশী।

জ্বী ম্যাডাম আমি বাংলাদেশী।

আমি তাহলে বাংলায় কথা বলি?

মৃদু হেসে বস বললো, আপনি বিনা সংকোচে বলুন ম্যাডাম। এবার কথা বার্তা উভয় পক্ষে বাংলায় হচ্ছে।

আপনার এখানে বাদল নামে কোন স্টাফ আছে?

বাদল?

জ্বী বাদল।

না ম্যাডাম আমার জানামনে এই নামে কোন স্টাফ নেই।

আপনি ঠিক জানেন?

জ্বী ম্যাডাম। আমি আমার স্টাফ সবার নাম জানি।

তাহলে শাহেদুর রহমান?

না ম্যাডাম এই নামেও কেউ নেই।

ভদ্রমহিলা আবার কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ হয়ে গেলেন।

ম্যাডাম আপনার জন্য কোন ড্রিঙ্ক অর্ডার দেই?

না ধন্যবাদ। সংক্ষেপে জবাব দিলেন মহিলা।

এবার বললেন, আমি যে তাকে গতকালই দেখলাম?

কাকে দেখলেন?

আপনাদের বেয়ারা যে গতকাল আমাকে খাবার সার্ভ করেছিল। ওর গালের এই দিকটায় একটা জরুল আছে। বলেই আঙ্গুল দিয়ে নিজের গালের ডানদিকের চিবুকের নিচের দিকটা দেখাল ভদ্রমহিলা।

 

আপনি কি সুমনের কথা বলছেন?

সুমন?

জ্বী সুমন। আমাদের স্টাফ সুমনের ডান গালে একটা জরুল আছে।

আপনি ঠিক জানেন ওর নাম বাদল না, সুমন?

জ্বী ম্যাডাম আমি নিশ্চিত জানি।

কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?

না ম্যাডাম কোন ভুল নেই। ওর নাম সুমন।

একটু ডাকা যাবে উনাকে?

কেন ম্যাডাম, সুমন কি কোন ভুল করেছে? ওর ব্যবহারে কোন অসৌজন্য আচরণ প্রকাশ পেয়েছে? থাকলে আমাকে বলুন, আমরা অ্যাকশন নেবো।

না না সেসব কিছু না। উনি ঠিক আছেন। কোন সমস্যা নেই। আমার তার সাথে একটু কথা ছিল।

ও তো আজ এ বেলা ছুটিতে ম্যাডাম। বিকালের দিকে আসবে।

ওহ! তাহলে বিকালে আসলে কথা বলা যাবে?

যেতে পারে। আপনার কি কোন ইমার্জেন্সি? থাকলে বলুন।

হ্যাঁ একটু ইমার্জেন্সি।

আমাকে বলা যায়?

আমার মনে হয় আমি ওকে চিনি। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।

কিভাবে চেনেন ম্যাডাম? জানতে পারি?

প্রশ্নটা শুনে ভদ্রমহিলার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কামরার মধ্যে আবার নৈঃশব্দ্য নেমে এলো।

আপনি বলতে না চাইলে সমস্যা নেই ম্যাডাম। স্বাদের বস ঠোঁটে একটা মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে।

না ঠিক আছে। আমি এখন উঠি। আমি না হয় বিকালেই আসবো আবার। বলেই হাতের লেডিস ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন ভদ্র মহিলা।

ম্যাডাম কিছু যদি মনে না করেন, আমাকে দুই মিনিট সময় দেয়া যায়? অনুনয় করে বললেন স্বাদের মালিক।

জ্বী বলুন। ভদ্রমহিলা আবার বসে পড়লেন।

আপনাকে কয়েকটা কথা বলবো। একটু শুনবেন?

জ্বী বলুন।

 

৪.

 

রোকেয়া নামের এক মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ভালবেসে বিয়ে করেছিল তারই ভার্সিটি পড়ুয়া দুই ব্যাচ সিনিয়র একজন কে। রোয়েকা অনেক উচ্চাভিলাসী মেয়ে ছিল। আশা করেছিল স্বামী অনেক উঁচুদরের কোন চাকুরী করে অনেক টাকা কামাবে। কিন্তু সেটা হলো না। স্বামী সাধারণ মানের একটা সরকারী চাকরী শুরু করলো। আবার শুরু হলো রোকেয়ার মধ্যবিত্ত জীবন। টানা পোড়েনের সংসারে রোকেয়ার একটা ছেলে হল। দেখতে দেখতে ছেলেটা বড়ও হয়ে গেল। সরকারী চাকুরী করে কিছু প্রমোশন পেয়েছি রোকেয়ার স্বামী। তাতে মাইনে বাড়লেও রোকেয়ার মনের আশা কোনদিনও পূরণ হয়নি।

 

ছেলেটা ততদিনে ক্লাস ফাইভে উঠে গেছে। কিন্তু দুর্ঘটনা যা ঘটার তা ততদিনে ঘটে গেছে। রোয়েকা তার স্বামীরই এক উচ্চবিত্ত বন্ধু তানভীর আমান এর প্রেমে পড়ে যায় এবং একদিন শুধু মাত্র একটা চিঠি লিখে সে তানভীরের সাথে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে। ছেলে স্কুল থেকে এসে মা কে পায় না। চিঠিটা দেখে। এরপর থেকে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও, রোকেয়ার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। আত্মীয় স্বজনও কেউ কিছু জানায়নি। শুধু এইটুকুই জানা গিয়েছিল, রোকেয়া তানভীর কে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেছে।

 

বছর না ঘুরতেই ছেলেটির বাবার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং আরও এক বছরের মাথায় প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ছেলেটির বাবা। এর পরে কি হলো জানেন? ছেলেটি থাকতে বাধ্য হলো তার চাচার সংসারে। সেখানে একটা কাজের লোকের চেয়েও অনেক খারাপ ব্যবহার পেত ছেলেটি। সংসারের সব কাজ করে ঘুমানোর আগে একটু লেখাপড়ার সুযোগ পেত। হাল ছাড়েনি ছেলেটি। চাচা চাচীর অত্যাচারে মানুষ হয়েও জোঁকের মত লেগে ছিল স্বপ্ন সাকার করার জন্য। ছেলেটি বড় হয়েছে। নিজেকে গড়ে তুলেছে। এখন সে অঢেল টাকার মালিক।

 

ম্যাডাম আমার গল্প অনেক শেষ। কেমন লাগলো?

ভদ্রমহিলা ততক্ষণে টিস্যু চেপে ধরেছে চোখে।  

স্বাদের মালিক হাতের কাছে রাখা বেলের বাটন চাপলো। পেছনের দরজা খুলে, কে যেন এসে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা দেখতে পেলেন না।

 

স্বাদের মালিক, তড়াক করে তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার আসুন। আপনার দেয়া দায়িত্ব আমি পালন করেছি স্যার। আপনি বসুন। এটা বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিঃশব্দে আরেকজন মানুষ মালিকের চেয়ারে বসলো। মানুষটা শিহাবুর রহমান।

 

ভদ্রমহিলা কান্না ভেজা কন্ঠে শিহাবের দিকে তাকালেন। ডান গালে সেই জরুল এখনও তেমনি আছে। রোকেয়া ভুল দেখেনি। শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাদল, বাবা গল্পের বাকী অংশটা কি শুনতে চাও?

না মা, শুনতে চাই না।

 

 

শিহাবের শেষ কথাটা শোনার আগেই সজল চেঞ্জিং রুমে চলে গেল। বসের পোশাকটা খুলে এখন তার নিজের পোশাক পরে ডেস্কে বসতে হবে। লাঞ্চের সময় হতে এখনও আরও এক ঘন্টা বাকী আছে।     

Author's Notes/Comments: 

২৩ এপ্রিল ২০২২

View shawon1982's Full Portfolio