একবারেই মেরে ফেলুন
= = = = = = = = =
যারা মনে করেন আমি লেখার মাধ্যমে বিষোদ্গার করি, খুব একটা ভুল বলেন না। তবে যা বলি সত্যিই বলি। যারা মনে করেন আমি বাড়াবাড়ি লিখছি, আমি তাদের দোষ দেই না। কারণ তারা এসব কখনও দেখেননি বা শোনেননি। আর আরও একটা ব্যাপার আছে। সবাই সব কথা অকপটে বলার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না। যদি জন্মাতো তাহলে পৃথিবীর সবাই লেখক/সাহিত্যিক হয়ে যেত। কেউ কেউ স্বীয় অভিজ্ঞতা নিজের ভেতরে পুষে রাখে আর ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে। কেউ কেউ একেবারেই প্রদীপের মত নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রদীপ নিভে যাবার আগে শেষ মুহূর্তে দপ করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু আমি যাদের কথা বলছি সেই, ইন্ট্রোভার্ট বা ঘরকুনো মানুষগুলো সেই সুযোগটুকুও পায় না। আমি এগুলা কেন বলতে পারি জানেন? কারণ আমি নিজেও একজন ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। অন্তত ছিলাম তো বটেই। আর টুকটাক লিখতে পারি। অনেকের মতে ‘বিষোদ্গার’ করি। হলোই না হয় কিছুটা সত্য-বিষোদ্গার। এত কিছু ভাবলে চলে না।
মাস খানেক আগের কথা। একটা গল্প দিয়েই শুরু করি। আমার পরিচিত একজন ছাত্র যে নিজে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তার সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। ছেলেটা টিউশন কোথায় করে এসব নিয়ে আলাপ হচ্ছিলো। তখন কথায় কথায় বেরিয়ে এলো তার এক অভিজ্ঞতার কথা। ছেলেটিকে তার এলাকার একটি ভর্তিচ্ছু মেয়েকে পড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। ছেলেটি প্রথমদিন যখন পড়াতে যায় তখনই কেমন যেন কিছু কিছু বিষয় অস্বাভাবিক ঠেকে। যে মেয়েটিকে পড়াতে বলা হয়েছিল, মেয়েটি ঠিক যেন নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। কেমন যেন ভীত থাকে আর কনফিডেন্সটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এমন মনে হচ্ছিলো। প্রথম দিন পড়ার পরেই, গার্ডিয়ানের তরফ থেকে ছেলেটিকে মানা করে দেয়া হয়। কারণ স্বরূপ বলা হয়, মেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পারবে না। ওর মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। সম্ভব হলে ছেলেটি যেন মেডিক্যাল পড়ুয়া কাউকে খুঁজে দেয়। ছেলেটি সেটাই করেছিল। ওরই এক মেডিক্যাল পড়ুয়া বন্ধুকে খুঁজে দিলো। সেই মেডিক্যালের ছাত্র মেয়েটিকে পড়ালো মাস দুয়েক। এরপর মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা হলো যথা সময়ে। মেয়েটি কৃতকার্য হতে পারলো না। চান্স পাওয়া নামক সোনার হরিণটা মেয়েটার হাতে ধরা দিলো না। মেয়েটার ভেতরে নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলতেই চলে। বাবা মা মেয়েটিকে ভীষণ কঠোর অনুশাসনে রাখে আর ‘মেডিক্যালে চান্স পেতেই হবে’ এই মন্ত্র দিয়ে যেত বারংবার। চান্স না পাওয়ার পর মেয়েটির ভাগ্যে বাসায় কি জুটেছিল সেটা আমার জানা নেই। তবে মেয়েটি ঘর বন্ধ করে, গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়। আত্মহত্যা করে মেয়েটি। শরীরে আগুন ধরানোর আগে নিজের হাউস টিউটরকে মোবাইলে জানিয়ে দেয়, সে চলে যাচ্ছে। তখন সব ঘটে গিয়েছে। আর কিছু করার ছিল না। মেয়েটি মারা গেছে।
কারও কিছু এলো গেলো? অনেকে তো মুখ বাঁকিয়ে নানা যুক্তিতে মেয়েটির দোষ দেয়ার চেষ্টা করবেন। আত্মহত্যা মহাপাপ, মেয়েটি বোকা, ভুল করেছে, এসব বলবেন। কিন্তু মেয়েটি কতখানিক মনোকষ্ট পেয়ে থাকলে, নিজের শরীর জ্বালিয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে, সেটা কি কেউ ভেবে দেখেছেন একবারও। না সেই সব পিতা মাতাকে কেউ কিছু বলবে, যারা মেয়েটিকে দিনের পর দিন কোনঠাসা করে ফেলেছে? আমাদের সমাজে এমন সন্তানের অভাব নেই, এমন পিতা মাতারও অভাব নেই যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের কিছু মুখরোচক তৃপ্তির জন্য ছেলে মেয়ের বলি চড়াচ্ছেন অতি হাসিমুখে। তাঁরা নিজেরাও বুঝতেই পারছেন না, ভেতরে ভেতরে শেষ করে দেয়া হচ্ছে সন্তানকে। ‘আমার ছেলে মেডিক্যালে পড়ে’, ‘আমার মেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে’ কথাগুলা বলতে পারা অনেক তৃপ্তির নিশ্চই, কিন্তু এগুলোর পেছনে যে জ্বালা, সেটা কিন্তু কেউ বুঝে না। বাবা মায়ের তৃপ্তি মেটাতে ধরেই নিলাম একজন মেডিক্যালে ভর্তি হল, কিন্তু এরপর যদি সেই মেডিক্যালের পড়া না এঞ্জিনিয়ারিং এর পড়া তার ভাল না লাগে? নিজেকে যদি কোনভাবে মানিয়ে নিতে না পারে, তাহলে? তখন সেই কষ্টের ভাগীদার কেউ হয় কি? রিচ ফুড খাবার পরে সেরেফ একটু মুখরোচক পান মশলা খাবার টাইপ মজা পাবার জন্য, একজন মানুষকে মেরে ফেলতেও আমরা দ্বিধা করি না। বাহ! সমাজ বাহ! মানুষ মারা হচ্ছে শুধু একটু মুখরোচক ‘পান মশলা’ সুলভ মুখের তৃপ্তি পেতে।
এবার আমার নিজের জানা একটা কাহিনী বলি। আমার পরিচিত এক আত্মীয়, ছোট বেলা থেকেই অনেক মেধাবী ছিল। তার বাবা মাও উচ্চশিক্ষিত। ছেলে পরীক্ষায় কোন বিষয়ে যদি একটু কম নাম্বার পেয়েছে, তাহলে তাকে ঘরে বেধকড় পেটানো হতো। এমন চলতে চলতে, একসময় ছেলেটির স্থায়ী ভাবে মানসিক বিকৃতি ঘটে যায় যা আজও শোধারায়নি। ছেলেটি আজও স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করতে পারেনি। সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে নাকি সন্তান পিতা মাতার কাছে ‘ঋনী’ থাকে। এই জাতীয় কথা শুনে এসেছি বহুকাল ধরে অথচ ধর্ম বিধানে এর কোন অস্তিত্ব পাইনি। দায়িত্ব কর্তব্যবোধ তো অবশ্যই থাকে, থাকবে। কিন্তু ঋণটা আসে কথা থেকে, আমার বোধগম্য না। যাই হোক, মেরে ধরে, স্থায়ী ভাবে মানসিক বিকার ধরিয়ে দিয়ে, বাবা মা সন্তানটির ঋণ শোধাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। দুই পাশে ডেবিট-ক্রেডিট সুন্দর মিলে গেল। বাহ!
সন্তান পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। এই কথা বলে বলে অনেক পিতা মাতা খুব আত্মতৃপ্তিতে থাকেন। নিজেদের অনেক কৃতকার্য মনে করেন। উনাদের টেক-কেয়ার আর গাইডেন্সের ফলে ছেলে মেয়ে এমন করছে বলে মনে করেন। কথাটা কিন্তু একেবারে মিথ্যে নয়। হতেই পারে। অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু এর উল্টোটা ভেবেছেন কি? ‘তোমাকে ফার্স্ট হতেই হবে’ এই জাতীয় আপ্তবাক্য যদি প্রতি মুহূর্তে কোন সন্তানের সামনে আউড়ে আউড়ে তাকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দেয়া হতে থাকে, তাহলে তার পরিণতি কি হতে পারে জানেন? ছেলেটি বা মেয়েটি হয়ত দুই একবার ফার্স্ট হবে। পিতা মাতাও অনেক তৃপ্তি পাবেন নিজেদের কৃতকার্য ভেবে। কিন্তু জীবন তো সবসময় এক ভাবে চলে না। এরপর উচ্চতর প্রতিযোগিতায় গিয়ে সন্তান যদি আশানুরূপ ফল না করতে পারে? তখন তাদের উপরে নেমে আসে অপমানের খড়্গহস্ত! কথার পর কথা শোনানো হতে থাকে। লজ্জায় অপমানে তখন সেই ইন্ট্রোভার্ট বাচ্চারা শামুকের মত গুটিয়ে যেতে থাকে। নিজেকে আর প্রকাশ করতে পারে না ঠিকমত। নিজের কথাগুলাও কাউকে বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সারাক্ষণ একটা হীনমন্যোতায় ভুগতে হয়। না পারার এক অযথা দায় তাকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। সেলফ-কনফিডেন্স যাও ছিল, একসময় সেগুলো নষ্ট হতে থাকে। নানা রকম হতাশা তাকে ঘিরে ধরে। আর সে ক্রমাগত নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। যতটুকু পারার ক্ষমতা ছিল, সেটুকুও একসময় শেষ হয়ে যায়।
আমি নিজেই ছিলাম একটা এক্সপেরিমেন্টাল গিনিপিগ! যেখানে যা কিছু শোনা হত, সবকিছুই আমার উপরে চালানো হত। সেটা আমার ভাল লাগুক বা না লাগুক। ‘তুমি আমাদের চেয়ে বেশী বোঝ’, ‘আমরা ভাল বুঝি’, ‘এগুলা সব সময় মত শেষ করে রাখবে’, ‘পরীক্ষায় তোমাকে টপ করে দেখাতে হবে’, ‘নিজের যোগ্যতা প্রমান করে দেখাও’ এই জাতীয় কথা হর হামেশা আমাকে শুনতে হতো। কোন কিছু ভুল ভ্রান্তি হয়ে গেলে, যে কোন ধরণের মানুষের সামনেই আমাকে অপমানও করা হতো। আমার ব্যর্থতার কথাগুলো অনেক রসিয়ে রসিয়ে বলা হতো। দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাবার পরেও, মেহমানের সামনে আমি সেই ১৯৯৬ সাকে কেন ক্লাস এইটে সরকারী বৃত্তি পেলাম না সেই কথা শুনতে হয়েছে।
আমি ছোট বেলা থেকে অনেক ধরণের সহিংসতার শিকার ছিলাম। সেগুলা কেউ বুঝতে চায়নি, বোঝার চেষ্টাও করেন নি। আমার কাছে শুধু একটাই চাওয়া ছিল, ভাল রেজাল্ট আর ভাল রেজাল্ট। এর বাইরে কোন গন্ডি আমার ছিল না। আমার ইন্ট্রোভার্ট ন্যাচার কে আরও উস্কে দেয়া হতো। ও তো এমনই, খেলাধুলা করতে চায় না, শুধু পড়ে। এসব বলা হতো আমাকে। অথচ এই ইন্ট্রোভার্ট গুলা যে নিজেদের একসময় শামুকের মত গুটিয়ে নেয় সেটা উনারা বুঝতে চাইতেন না। গল্পের বই আর সিনেমার জগতের আড়ালে যে এরা নিজেদের মত একটা জগত বানিয়ে সেখানে দুদন্ড মিথ্যা মুক্তির স্বপ্ন দেখে, সেটাও উনারা বুঝতেন না। পোষাক আসাক থেকে শুরু করে, সবকিছুই উনাদের ইচ্ছা মাফিক করতে হতো। ওভাবে চলা মানেই হলো ভাল ছেলে হওয়া। আমাকে ভাল ছেলেও হতে হয়েছে উনাদের মত করে। কিন্তু এই ইন্ট্রোভার্ট রাও একসময় ‘বার্স্ট’ করতে পারে। তখন কিন্তু সেটা সামাল দেয়া যায় না। সবাই যে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় সেটা নয়। কেউ কেউ কিন্তু প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তখন কি করা হয় জানেন? বাড়ী বাড়ী গিয়ে, দুর্নাম ছড়ানো হয়। কারণ যারা নিজেরা নিজেদের অনেক ভাল আর বড় মনে করে, তারা হাজার দোষ করেও ভাল থাকেন। তারা যখন খুশি তখন ধর্মের পোশাক পরে নেন, সমাজের পোশাক পরে সাজেন। দোষ গেলার জন্য তখনও রয়ে যায় এই ইন্ট্রোভার্ট গুলাই।
ধর্মেই তো বলা আছে, কোন হিংস্র প্রানীকে যদি নিজের জান বাঁচাতে মেরেও ফেলতে হয়, তাহলে তাকে সম্পূর্ণই মেরে ফেলতে হবে। অঙ্গহানী করে দিয়ে, কোমর ভেঙ্গে দিয়ে তাকে না খেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য ফেলে রাখা গহির্ত অপরাধ এবং নিষিদ্ধ। সন্তানের উপরে খামখেয়ালীর স্টিম-রোলার চালিয়ে তাদেরকে ধুঁকে ধুঁকে এভাবে মেরে ফেলবেন কেন? সারা জীবনের জন্য শারীরিক মানসিক ভাবে পঙ্গু বানিয়ে রাখবেন কেন? কি তৃপ্তি পান এটাতে? ফেরে ফেলতে চান তো একবারেই মেরে ফেলুন না।