কিছুদিনের আগের বলবো নাকি কয়েকদিন আগের বলব? ব্যাপারটা তো চিরন্তন। পুরানো বলে দূরে ঠেলে দেয়া কি ঠিক হবে? একদম না। যে জিনিস মনের মধ্যে সদা জাগরুক থাকে তাকে কি দূরের জিনিস বলা যায়? স্মৃতিতে কি ওরা জেগে ওঠে না? ওরা কি জানান দেয় না অদের অস্তিত্ত্ব? ওদের কথাক কি ওরা ভুলতে দেয় কখনও? আহা! আমি তো পারি না। আমার তো ‘মায়া’ লাগে! এখানে অবশ্য দুই লাইন কথা আবার লিখতে হচ্ছে। কারণ আমি মনে হয় মনের ভুলেই ‘মায়া’ কথাটা লিখে ফেললাম। এমন একটা শব্দ লিখলাম যার অর্থ আমার কাছেই স্পষ্ট না। ‘মায়া’ জিনিসটা কি আসলে নিজের সাথে কি নিজের মায়া হয়? নিজের সাথে নিজের স্মৃতিগুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখার মধ্যে কি ‘মায়া’ ব্যাপারটা কাজ করে না? যা আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়, তা আমি কি করে যে লিখি? লেখা তো মনে হয় অসমীচীন হয়ে যাচ্ছে। কিছুটা অনধিয়ার চর্চাও মনে হয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করব? উপায় তো নেই। মনের মুক্তি যেখানে লেখার মধ্যে খুঁজে নেই কিছুক্ষণের জন্য সেখানে নিজের লেখা দিয়ে নিজের সাথে একটু অনধিকার চর্চা না হলে হলই বা!
এতক্ষণ আমি যা যা বললাম, তা এখজন মানুষকে বিরক্ত করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। তবে বিরক্ত হয়ে চলে যাবে না যেন! আমি আসলে এখন অন্য কিছু নিয়ে লিখবো। আমার প্রিয় একটা খাবার এবং সেটা নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ! এমন কিছু না! আপনারা সিঙ্গাড়া খান তো? পছন্দ করেন কি? যারা করেন তারা বুঝবেন কারণ আমিও যে অনেক পছন্দ করি! নাস্তা হিসেবে তো মানুষ কত কিছুই খায়। মহল্লার প্রতিটা রেস্টুরেন্টেই বলতে গেলে সকাল বেলায় সিঙ্গাড়া বানানো হয়। সিঙ্গাড়া’র কি কোন তুলনা হয়? একটু ভেবে বলেন তো! আটা দিয়ে তিনকোণা করে মুড়ে তার মধ্যে খানিকটা মশলা মাখা আলু ভরে তেলে ভাজা একটা খাদ্য! আহা! অনবদ্য!
এই খাদ্যটা একবার খাবার জন্য আমার সেই ৫ বছরের প্রবাস জীবনের সে কি এক হাহাকার! আহারে! কিন্তু মজার কথা হচ্ছে, পাঁচ বছরে যতবার দেশে এসেছি, ততবার এত দ্রুত সময় পার হয়ে গেছে যে আর আয়েশ করে সিঙ্গাড়া খাবার কথা মনে হয়নি। পরে আবার প্রবাস জীবনে ফেরত গিয়ে শুরু হয়েছে আবার হাহাকার। মনে মনে বলেছি, এরপর দেশে ফেলে মনের ঝাল মিটায়ে সিঙ্গাড়া খেয়ে নেবো! সেই দিন কি আর এলো? জানি না তো! এখন তো দেশেই থাকি। সেই আয়েশ করে কি আর সিঙ্গাড়া খাওয়া হচ্ছে? ওতে আলু আছে, ওতে আটা আছে, ওতে কার্ব আছে, কত কথা শুনতে হয়। সবাই শুধু কার্ব আর আটাটাই দেখলো! আলু আটার পেছনের ভালবাসাটা দেখলো না। তিনকোনা আটার টুকরার মাঝে যে শুধু মশলা মাখা আলুই থাকে তা নয় বরং একজন মানুষের বছরের পর বছরের স্মৃতিও লুকানো থাকতে পারে, সেটা কি কেউ ভেবে দেখেছে? আমরা শুধু বাইরের খোলসটা দেখেই মন্তব্য করে ফেলি। ওতেই আমাদের তৃপ্তি।
জীবনের প্রথম শিক্ষকতা শুরু হয়েছিল একটি স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। আমি আর তাহমিনা শবনম আপা একসাথে একই দিনে জয়েন করেছিলাম। তাহমিনা শবনম আপা হচ্ছেন সেই সমস্ত মানুষদের একজন যাদের আমি সারাজীবন আমার আইডক, আইকন মেনে যাবো। সিঙ্গাড়া প্রসঙ্গ আসবে আর তাহমিনা আপার কথা আসবে না সেটা কি হয়? ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছি আমরা একসাথে। কত কত স্মৃতি আমাদের। আমার জানামতে তাহমিনা শবনম আপাও সিঙ্গাড়া খেতে অনেক পছন্দ করেন। আমাদের টিচার্স কমন রুমে মাঝে মাঝেই সিঙ্গাড়া খাওয়া হতো। দেখা যেত টিফিন আওয়ারে বা ছুটির আগে কেউ না কেউ মাঝে মাঝে সিঙ্গাড়া আনতো। সবাই মিলে মজা করে খাওয়া হতো। সিঙ্গাড়া আর চা। চা প্রতিদিন বড় ফ্লাস্ক ভরে দুইবার দেয়া হত স্কুল থেকে।
একদিনের কথা মনে পড়ে। আর সিঙ্গারা খেতে গেলে বা সিঙ্গারা দেখলেই আমার সেই কথা মনে পড়ে। সামান্য কথা কিন্তু নস্টালজিক হই। একদিন সিঙ্গাড়া খাচ্ছি টিচার্স কমন রুমে বসে তখন তাহমিনা আপা বললেন, জায়েদ সিঙ্গারা কিভাবে খেতে হয় জানো? আমি বললাম কিভাবে আপা? উনি বললেন প্রতি সিঙ্গাড়া একটা করে কাঁচামরিচ মাস্ট! সিঙ্গাড়ার সাথে কাঁচামরিচ না হলে কি আর জমে? খুব মজা পেয়েছিলাম সেদিন আপার সেই কথায়। আমি নিজে প্রচুর পরিমাণে মরিচ খেতে পারি। অস্বাভাবিক রকমের ঝাল খেতে পারি। আমিই মজা পেয়েছিলাম তাহমিনা আমার কথা শুনে। আমি তখন কাঁচা পেয়াজে কচকচ করে কামড়ে সিঙ্গাড়া খাচ্ছি। এরপর প্যাকেট থেকে গোটাকয়েক কাঁচামরিচ নিয়ে বসলাম। কারণ কাঁচামরিচের ঝাল আমার কাছে প্রায় সব্জির মতই। ঝাল তেমন লাগতো না বললেই চলে। এখনও সিঙ্গাড়া যদি কখনও খাই, কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ ছাড়া খাওয়ার কথা অনেকটা আমার কল্পনার বাইরে। অনেকে সস দিয়ে খায় দেখেছি। ওটা আমার দ্বারা হবে না। সিঙ্গাড়া খেতে হলে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ লাগবেই লাগবে আমার! তবে এখন আর মরিচ তেমন খেতে পারি না। মানে আগের মত অস্বাভাবিক ভাবে আর পারি না। পেট ব্যথা করে। আর তখনই মনে হয়, দিন মনে হয় ফুরিয়ে আসলো। পেটও এখন আর ঝালের তেজ বেশী নিতে পারছে না। গ্যাস্ট্রিক জিনিসটার যন্ত্রণা আগে বোধ না করলেও এখন মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছে।
প্রবাস জীবনে সিঙ্গাড়া আর পাবো কোথায়? রবিবারের দিকে যদি ফ্যারার পার্কের দিকে যেতাম তাহলে হয়তো দেখতাম কোন না কোন বাঙ্গালী হোটেলে কদাচিৎ পাওয়া যেত। প্রচন্ড ভিড় হয় বিধায় রবিবার পারত পক্ষে ফ্যারার পার্কে যেতে চাইতাম না। তবুও সিঙ্গারা খেতে মন আকুপাকু করলেও পাবো কোথায়? একদিন আমাদের ভার্সিটিতে আবিষ্কার করলাম “ওল্ড চ্যাং কি” নাকে একটা চাইনিজ দোকান আছে যেখানে স্ন্যাক্স আইতেম পাওয়া যায়। ওখানে একটা আইটেম দেখলাম নাম “কারি পাফ” এই জাতীয় কিছু। এক একটা কারি পাফ এক ডলার করে দাম। একদিন পরীক্ষামূলক খেয়ে দেখলাম। ভেতরে আলুর পুর দেয়া ছিল। খেতে অনেকটা সিঙ্গাড়ার মত হলেও দেখতে বাংলাদেশি কুলি-পিঠার মত। ঐটাই খেতাম মাঝে মাঝে আর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতাম আর কি। চাইনিজ দোকানদারকে তো আর বলতে পারতাম না, ভাই একটু কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ দেবেন? আয়েশ করে কারি পাফটা খেতাম!