কিছু কথা নিজের মনের মধ্যেই বাকী থাকে। কিছু কথা মনের মধ্যেই জমতে জমতে অনেকটা স্তুপাকৃতির হয়ে যায়। সেগুলো কাউকে বোঝানো যায় না, কাউকে বলা যায় না। যার কথা শুধু সেই মনে হয় উপলব্ধি করতে পারে। সেই কথাগুলো নিজে নিজে যখন চিন্তা করি, তখনও মনে হয় সব কেমন যেন এলোমেলো আগোছালো হয়ে যায়। নিজের সেই সাজানো কথাগুলো, এলোমেলো হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে আবার আগের মত করেই রেখে দেই। কি দরকার সবগুলো একসাথে নাড়িয়ে? মনে হয়, সবকিছু নষ্ট বয়ে যেতে পারে। সবকিছু হয়ত এমনভাগে আগছালো হয়ে যাবে যার কোন কূল কিনারা আমি আর করতে পারবো না। এজন্য বারবার হাত দিয়েও আমার আগের মতই রেখে দেই। উপর দিয়ে দেখে দেখে তৃপ্ত হতে চাই, আছেই তো সব স্তুপের ভেতরে! একদম ভেতরের চাপা পড়া কথাগুলো মনে পড়ে, তখন আবার সেই সাজানো স্তুপটার দিকে তাকাই। জানি ওখানেই আছে। তবুও সেগুলো তুলে আনা যায় না। শুধু মনের কল্পনায় দেখা যায়, ওগুলো ওখানেই আছে।
সব প্রিয় জিনিস মনে হয় ছুঁয়ে দেখতে হয় না। কিছু কিছু প্রিয় জিনিস দূর থেকে দেখার মধ্যেই তৃপ্তি। কাছে এলেই মনে হয় যেন ব্যবধান বেড়ে যাবে। দূরে থাকা কিছু জিনিস দূর থেকে যত আপন বলে মনে হয়, কাছে এলে মনে হয় ততটাই দূরে সরে যাবে। এজন্য সব দূরের জিনিস আমি আপন করতে চাই না। দূরের থেকে ভাললাগার যে অনুভুতিটা থেকে যায়, সেটাই সযত্নে মনের ভেতর জমিয়ে রাখি। ছুঁয়ে দেখি না। ওরা ভাল থাকুক ওদের মত। আমাদের স্পর্শে যদি স্মৃতিগুলো কলুষিত হয়ে যায়, তবে সেই স্পর্শ না দেয়াই ভাল।
এক একজন মানুষ পৃথিবীতে চলে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকে যারা তাদের জন্য মনে হয় পাহাড়সম স্মৃতি রেখে চলে যায়। যে মানুষগুলো চলে যায়, তাঁরা কি বুঝতে পারে, তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো, ফেলে আসা মানুষগুলোর উপরে কি কি প্রভাব ফেলতে পারে? যে চলে যায়, সে তো একরকম নিজের মত করেই চলে গেল, কিন্তু যা রেখে গেল, তাঁর প্রভাব থেকে কি বাকীরা মুক্ত হতে পারে? এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা খুব সহজেই হয়ত হাত ধুয়ে ফেলতে পারে। অনেক কিছুই অনেক সহজে ভুলে যেতে পারে, কিন্তু সবাই তো এক নয়। সেই এক না হওয়া সবার মধ্যে মনে হয় আমিও একজন। আমি যে কিছুই সহজে ভুলি না। একসময় মনে মনে আনন্দিত হতাম এটা ভেবে যে আমি তো তেমন কিছুই ভুলে যাই না। আমার সবকিছুই বেশ ভাল করে মনে থাকে। কিন্তু এখন সেটার জন্যই মাঝে মাঝে বেশ আফসোস করি। কি দরকার সব কিছু মনে রাখার? মনে রাখা জিনিসগুলো সবসময় যে আনন্দ দেয় তা তো না! আনন্দ আর কষ্ট মেশানো অনুভুতিগুলো পালাক্রমেই আসতে থাকে। শুধু আনন্দ কে মেনে নেব আর কষ্টগুলো ভুলে যাবো, এমন নিরবিচ্ছিন্ন স্বার্থপরতার জায়গা তো এই পার্থিব জীবন নয়! এখানে দুটোকেই মেনে নিতে হবে একসাথে, নতুবা কোনটাকেই নয়।
পুরানো সমাধি বা সমাধি চিহ্নগুলো আমাকে খুব টানে। না দেখেও মনে হয় মনের ভেতরে আমি দেখার চেষ্টা করি ঐ সমাধিগুলোর ভেতরে সমাহিত মানুষগুলোকে। কেমন ছিল তারা আর কি নিয়েই বা চলে গেল সবকিছু ছেড়ে? তাঁরা কি আনন্দ নিয়ে গেছে নাকি এক রাশ হতাশার সাগরে অন্যদের ডুবিয়ে দিয়ে নিজেরাও সেই হতাশার খানিকটা সঙ্গী করে চলে গেছে? এইসব অর্থহীন ভাবনা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তবুও আমি যাই, দেখি। সমাধি ফলকগুলো চোখে পড়ে। ভাবতে থাকি এমন অনেক অনেক কিছুই। নিজের মনে মনে নিজেরও একটা সমাধি ফলক বানাই। সেখানে খোদাই করে লিখতে থাকি কিছু কিছু কথা। লিখি আর মুছে ফেলি। নানা আঙ্গিক থেকে দেখে দেখার চেষ্টা করি। যা লিখলাম তার কতটুকু সুন্দর হলো? আমার নিজের কাছেই সুন্দর লাগছে কি আমার সমাধি ফলকটা? বেশীরভাগ সময়েই মনের মধ্যে উদিত হওয়া কথা গুলো মনের মধ্যেই দাফন করে দেই। সেখানে একটা স্মৃতিফলক তুলে দেই মনে মনে। সেই স্মৃতিফলকের কথাগুলো আমার নিজের আছেই বড় অস্পষ্ট ঠেকে।