৭ নভেম্বর ২০২১

আজকে গেছিলাম একটা কাজে বাইরে। সেখান থেকে ফেরার পথে মন অযথাই কঠিন হয়ে গেল। মেট্রোরেলের পিলার গুলার মত। কি কঠিন কাঠিন্য নিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে! ওদের প্রায় প্রতিটার গোড়া পাবলিক টয়লেটে পরিণত হয়ে গেছে আমাদের নির্লজ্জ সভ্যতার আভরণের আবরণের আড়ালে। তবুও কি কঠিন তাদের অবয়ব। নোংরা মেখেও কিছু বলছে না। অবশ্য বলার ক্ষমতা নেই যে। তেমনি আমারও ঐ পিলার গুলার মত অবস্থা। মনে, গায়ে যতই কালিমা লেপে দিক না কেন, কিছুই বলা যাবে না। কারণ তাতে কালিমা লেপনকারীরা কষ্ট পাবে যে। তাদের কে তো কষ্ট দেয়া চলবে না। তাঁরা বিত্তশালী, চিত্তশালী, দয়ার সাগর! সব কালিমা গায়ে লেপে আমাকে সমাজ আর সমাজের নিয়মানুসারে চলতে হবে। জন্মের পর থেকে সেই সমাজ আমাকে সেটাই শিখিয়ে আসলো, যেই সমাজ আমার বিপদে এক বেলা ভাত খাইয়ে দেবে না। বলতে গেলে সারা রাস্তাই কঠিন কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না যে। এখন সেই কঠিন কথাগুলো আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। তবে আমি যা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা আমি ভুলে যাইনি। ভোলার মত না যে। মনে অনেক ঘৃণার দীপ জ্বালিয়ে সে বেঁচে থাকে আদিম জান্তব উল্লাসে। আমিও তাকে মরতে দেই না। লিখবো সেই কথাগুলোও কোনদিন। হয়ত আজ নয়।

 

বাতাসে এখন কি শীতের আগমনী দেখতে পাচ্ছেন কেউ? দেখতে বলতে বুঝিয়েছি, অনুভব তো করতে পারছেন কি? এখন রাতে জোরে ফ্যান চালালেও একটু শীত শীত লাগছে। ভোর বেলায়ও একটু কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে না? তবে দুপুরের বেলা বাইলে গেলে, সেই ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ আর মনে থাকে না। ঠোঁট তো আর নতুন করে ফাঁটা শুরু হয়নি। গরমকালেও এবার দেদারসে ঠোঁট ফেঁটেছে। আমাদের শহরটার আবহাওয়া যে মরুভূমির মত আবহাওয়া হয়ে যাচ্ছে সেটা কি কেউ বুঝতে পারছে না? হয়ত যখন বুঝবে তখন আর কিছু করার থাকবে না। আজকে রেডিও তে গাছপালার দরকার নিয়ে শুনছিলাম। পুরানো কথা। সবই জানি। কে না জানে? শুনতে শুনতে তাকিয়ে দেখলাম, সারা শহরের যেদিকেই তাকাই শুধু কিছু শুষ্ক রুক্ষ দালান ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। কোথায় গাছ? যে গাছের দিকে তাকালে চোখ জুড়াবে সেই গাছ কোথায়? শহরের বাতাস দূষণে এতটাই ভারী হয়ে গেছে যে নিঃশ্বাস নিচ্ছি না বিষ নিচ্ছি সেটা আমরাও বুঝি না। কারণ সারাক্ষণ এই দূষিত ভারী বাতাস টেনে নিতে নিতে আমরা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছি। দুর্বল ফয়ে যাচ্ছে আমাদের ফুসফুস। আমরা ধীরে ধীরে আক্রান্ত হচ্ছি আর পর্যুদস্ত হচ্ছে আমাদের জীবনীশক্তি। আমার এখন মনে হয় আগের থেকেও বেশী করে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আর শীতকালে বাতাসের ঘনত্ব এমনিতেও বেশী থাকে। তখন কষ্টটা আরও বেশী অনুভূত হয়।

 

তবুও শীত আসছে। আনন্দ বেদনার নব নব উপাখ্যান নিয়ে শীত আসছে। কারও কারও আনন্দ নিয়ে আসছে আবার কারও কারও দুর্গতি বাড়িয়ে দিতে শীত আসছে। শীতে বাতাসের পোড়া গন্ধ পান কেউ? জ্বালানী কাঠ বা কাগজ পোড়ালে যেমন গন্ধ হয়? আমি পাই। রাস্তায় মানুষ পুরানো কাগজ পোড়ায়, এটা ওটা পোড়ায়! সেই গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে যায়। আমার কাছে এটাই হচ্ছে শীতের গন্ধ। ছোটবেলা থেকেই আমি এই গন্ধটাকেই শীতের গন্ধ হিসেবে চিনে এসেছি। শীতের গন্ধ বাড়তো, আর আমার আতঙ্কও বাড়তো। কারণ শীতকালেই যে ভাগ্য নির্ধারণী ফাইনাল পরীক্ষা হবে! শীতের মধ্যেই হবে! পরীক্ষা ভাল হবে শীতের বাকিটুকু হয়ত অনেক আনন্দ করবো, আর পরীক্ষা ভাল না হলে, কি হবে কি হবে সেই দুশ্চিন্তায় আমার ভেতরের পোড়া গন্ধটাও বাতাসে মিশে যেত। তবে সেই পোড়া গন্ধ শুধু আমি একাই টের পেতাম। কারণ ওগুলো আমার ভেতরের পোড়া গন্ধ যে। অন্যরা বুঝবে কি করে?

 

 

শীত এখনও আসে। এখন আর আমাকে পরীক্ষা দেয়ার জন্য আতঙ্কিত থাকতে হয় না। এখন আমার কাছে পরীক্ষার ফল, পরীক্ষার খাতা নিয়ে কোন জবাবদিহিতা করতে হয় না। তবুও আমি এখনও শীতের সেই পোড়া গন্ধ পাই। রাস্তায় কিছু না পোড়ালেও আমি নিয়মিত পোড়া গন্ধ পাই। জানালা খুললে পাই, বারান্দায় গেলে পাই, গায়ে পারফিউম দিলেও পাই। বাইরের পোড়া গন্ধ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায় কিন্তু ভেতরের পোড়া গন্ধ তো ফুরায় না। শীতকালে বাইরের সেই গন্ধে সবকিছু মনে পড়ে যায়। আর আমি টের পাই, আমার ভেতরের স্মৃতিগুলো পুড়তে থাকে, একের পর এক। কাগজ পুড়ে ছাই হয়। স্মৃতি পুড়লে ছাই হয় না। ওরা শুধু বারংবার গন্ধ ছড়াতেই থাকে। 

View shawon1982's Full Portfolio