এই লেখাটা আমি লিখছি আমার নিজের জন্য। জীবনকে এগিয়ে নিতে আর নতুন কিছু ভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার প্রয়াসে যত ভাবছি, ততই মনে হচ্ছে, জীবনের ভাল ভাল অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগাই। আমাদের শেখার শেষ নেই আর সেই সাথে সাথে সময় যত যাচ্ছে তত মনে হয় ভাবনারও শেষ নেই। আবার খুব বেশি সুশ্চিন্তা করেও কি আমরা কিছু করতে পারছি? সেটা নয়। জীবনের কিছু কিছু মোড় এতটাই সূক্ষ্ম যে সেখানে অতি সাবধানে না এগোলে পথ হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। সেই সাথে জীবনের কিছু সুন্দর সময়ও আছে। সেগুলোকেও সঙ্গী করে চললে সেই অভিজ্ঞতা পাথেয় হিসেবে থেকে যায়। লেখার এত ভূমিকা করে লাভ কি? একজন মানুষের সাথে কথা বলে তার জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরবো বলেছিলাম। সেটাই করি না হয়।
আমি যার কথা বলবো, সে আমাদের সমাজের অতি সাধারণ পাঁচ দশটা খেঁটে খাওয়া মানুষের মতই। তার জীবনের যে কথা, সেগুলোও অতি সাধারণ। এমন কথা আমরা হর হামেশাই শুনি। জীবনের সংগ্রাম আর তার সাথে জড়িত কিছু দুঃখ কথা। কিন্তু ছেলেটা আমাকে হাসিমুখে এত সুন্দর করে তার জীবন ভাবনা বলেছে, যে সেটাই আমার ভাল লেগেছে অনেক। ছেলেটি নিজের দুঃখকে জয় করতে পেরেছে বা পারছে। আর অতি সামান্য চাহিদা নিয়ে নিজের কথা সে বলেছে, ভাল আছে ও। ওর কথা শুনে মনে হয়েছে, অতি সাধারণ এই ছেলেটার মত যদি আমরাও সহজভাবে জীবনকে চিন্তা করতে পারি, তাহলে তো আমাদের কষ্ট অনেকটাই কমে যায়। কি দরকার এই ক্ষুদ্র জীবনের বোঝা এত ভারী করে? কি দরকার নিজের সাথে দুঃখের বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়ানোর? সামনের দিনগুলো কি করে ভাল থাকা যায়, সেটা নিয়ে এবং সেটার বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করাই তো আমাদের সামনে যাবার সুন্দর অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে।
ছেলেটার নাম হুমায়ুন। বয়স তেইশ চব্বিশ হবে। ওর বাড়ী কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানায়। আমি যেই রিক্সাতেই চড়ি না না কেন, সুযোগ থাকলে চালক ভাইদের দেশের বাড়ি কোথায়, কবে থেকে ঢাকা, কোথায় থাকে এমন কিছু নির্দোষ প্রশ্ন করি। আমাদের সমাজের এই মানুষগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। আর আমার মাথায় আরেকটা জিনিস কাজ করে। সেটা হল, এই মানুষটা আমাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গেল। আমি তার কাছ থেকে অনেক দরকারী একটা সেবা নিয়েছি। বিনিময়ে সে তো পারিশ্রমিক কিছু পেল ঠিকই। কিন্তু সামান্য কয়টা টাকার বিনিময়ে প্রাপ্ত সেবা আর তার বিনিময়ে আমার যে উপকারটা হলো, সেটা কখনই ওই কয়টা টাকার বিনিময় হতে পারে না। আমার পায়ের প্রচন্ড ব্যথা হবার কারণে আমার বাসার কাছাকাছি ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে খাওয়াটাও যেখানে অতি দুষ্কর ছিল, সেখানে হুমায়ুন এর মত একজন রিক্সাওয়ালা ভাই এর সাহায্য যে আমার কত উপকারে এসেছে তা লেখনীতে প্রকাশ অসম্ভব।
হুমায়ুন আমার এলাকাতেই আমার বাসার পাশেই থাকে। তিন দিন আগেই পরিচয় হলো। বাসার পাশে হবার সুবাদে ওর নাম্বার আমি নিয়ে রেখেছি। আমাকে বলে রেখেছে ভাই আমি মহল্লার ভেতরেই রিক্সা চালাই। আপনার দরকার হলেই আমাকে কল দিয়েন। যাত্রী না থাকলে আমি চলে আসবো। গতকাল সকালেই যখন আমার অবস্থা বেশ বেগতিক হয়ে গেল, তখন আমি বুঝলাম আমার তো আর বসে থাকা চলে না। আমাকে বের হতেই হবে। অগত্যা আমি হুমায়ুন কে কল দিলাম। ও চলে এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেহেতু এখন পরিচিত হয়ে গেছে, তাই আলাপচারিতায় ওর বাসার খোঁজ খবর নিলাম কিছু কিছু।
হুমায়ুনরা দুই ভাই। ও ছোট। হুমায়ুন যখন অনেকটাই ছোট ছিল তখন ওর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর ওর মা অন্যত্র বিয়ে করে। ওকে ওর ছোটবেলায় লালন পালম করেছে ওর দাদী। কিন্তু একসময় সেও বয়সের কারণে অক্ষম হয়ে গেলে, হুমায়ুনের বাবাকে আবার বিয়ে করতে বলে। হুমায়ুনের বাবাও পরে আবার বিয়ে করে। হুমায়ুন বললো, ভাবছিলাম সৎ মা হয়তো ‘মা’ হবে। কিন্তু তা হল না ভাই। আমার সৎ মায়ের একটা ছেলে আছে। তার বয়স এখন ১৫ বছরের মত। তাকে লেখা পড়া শিখিয়েছে। আমার লেখাপড়া আর হয়নি। আসলে ছোটবেলা থেকে গাইডলাইন পায়নি লেখা পড়ার। আমাদের দেশের অতি সাধারণ হতদরিদ্র অনেক পরিবারের অতি সাধারণ চিত্র এটাই। হুমায়ুন আমাকে যখন তার মোবাইল নাম্বার বলছিল, ইংরেজি ডিজিটিগুলো এত সুন্দর করে উচ্চারণ করেছে, তা শুনে আমার মনে হয়েছিল ও হয়ত কয়েক ক্লাস তো লেখাপড়া অন্তত করেছেই। কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলো।
হুমায়ুনের বড় ভাই ঢাকার অন্য এক অঞ্চলে অটো-রিক্সা চালায়। আর ওর বাবা মতিঝিলে গাড়ী চালায় কিছু একটা। ওর বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইলাম। বললো আছে। একটু হেসে দিয়ে বললো, ভাই বুঝেনই তো, নিজের নতুন সংসার হলে যা হয়। সেই সংসারের গুরুত্বই বেশী থাকে। আমার সৎ মা সবকিছু তার নিজের মত করে করে নিয়েছে। বাবার সম্পত্তি বা কোন কিছু আমি পাবো বলে মনে হয় না। যা করার আমার নিজেরই করতে হবে। টাকা জমাতে পারলে নিজেই একটু কিছু করার চেষ্টা করবো। নিজের জন্মদাত্রী মায়ের কথা বললো, এইতো ভাই কিছুদিন আগে গ্রামে গেছিলাম তখন দেখা করে এসেছি। ওর মা তার পরবর্তী সংসারে আবার দুই সন্তানের জননী। হুমায়ুনের বাবা এবং মা যে যার সংসারে ভালই আছে যার যার মত। শুধু হুমায়ুন আর আর তার ভাইটাই যেন বৃন্তচ্যুত দুইটা ফুলের মত নিজেদের মত করে বেড়ে উঠেছে। নিজেদের জীবন সংগ্রাম নিজেদের মত করে চালিয়ে নিচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা সরেছিলাম, তুমি সি.এন.জি স্কুটার চালাতে পারো না? তোমার পরিশ্রম কম হতো। তখন ও বললো, ভাই আমি চালাতে পারি, কিন্তু আমার চোখের দেখায় সমস্যা আছে। আমি পরামর্শ দিলাম, দ্রুত চোখ দেখিয়ে নাও আগে।
হুমায়ুন অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছে। দুই বছর হলো। ও ওর স্ত্রী আর শাশুড়ি একই বাসায় থাকে। ওর শ্বশুরও বেঁচে নেই। ওর স্ত্রী তার মায়ের একমাত্র সন্তান। তারও অল্প বয়স। হুমায়ুন তার সংসার নিয়ে ভাল আছে। আমার সাথে যখন কথা বলে, মুখে একটা অমায়িক হাসি দেখি। এই হাসির মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই। নিজের ক্ষুদ্র গন্ডিতে যে মানুষ খুশী থাকতে পারে, এই হাসি শুধু তারাই হাসতে পারে। আকাশচুম্বী উচ্চাশা যত বাড়তে থাকে, সেটা পূরণ করার জন্য যখন মানুষ ছুটতে শুরু করে, তখনই জীবনে নানা রকম অশান্তি আর হতাশা আসতে থাকে। যার জীবনের চাহিদা যত কম, যে তার জীবন নিয়ে তত বেশী সন্তুষ্ট থাকতে পারে। হুমায়ুন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। কিন্তুই ও জীবনে যে জিনিস দেখেছে, সেখান থেকে নিজেকে আগে বাড়ানোর যে সুন্দর চিন্তাধারা নিজের মধ্যে তৈরী করেছে, সেখান থেকে আমার জন্যও কত সুন্দর শিক্ষণীয় বিষয় রয়ে গেল।