আমাদের “পারদ”

কবিগুরুর এই লেখা দিয়েই শুরু করি।

 

কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,

ভাই ব'লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।

হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা--

কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!

-(কবিতাঃ কুটুম্বতা বিচার)

 

মাঝে মাঝেই মনে পড়ে ছোট বেলায় বহুবার লেখা ভাব-সম্প্রসারণের জন্য এই পংক্তিমালাগুলো। শৈশবের পড়া আর এখন পরিণত বয়সে এসে পড়ার মধ্যে অবশ্য একটু নয় বরং অনেক খানিক পার্থক্যই থাকে। বয়সের সাথে সাথে বুঝের পার্থক্য থাকে। তবে কে কেমন বুঝবে না বুঝবে, সেটার পেছনেও আরও অনেক কিছুই থাকে। সেসব বিশদ আলোচনা যারা সেই বিষয়ে বোদ্ধা আছেন, তারাই করবেন। আমি অন্তত এর উপযুক্ত তো নই। আসল কথায় আসি এবার।

 

শারদীয় ‘দেশ’ এর ১৪১৭ (বঙ্গাব্দ) সালের পুরানো সংখ্যাটি সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গিয়েছিলাম ফুটপাথের এক বই বিক্রেতার কাছ থেকে। ইদানিং বই এর পাশাপাশি সাহিত্য-সমৃদ্ধ পত্রিকাও গিলছি বুবুক্ষের মত। এতদিন কেন আমার এই পত্রিকা প্রীতি জেগে ওঠেনি সেটাতেই আফসোস লাগে। তবে কি আর করা! এখন হাতের ধারে যা পাচ্ছি, সেটাই পড়ে যাচ্ছি আর নিত্য নতুন কত কিছু জানতে পারছি। এও তো মন্দ না। ১৪১৭ বাংলা সালে প্রকাশ অর্থাৎ ইংরেজী ২০১০ এ প্রকাশ হলেও, যেহেতু আমি পড়িনি সেহেতু আমার কাছে তো নতুনই। ওখানেই পড়তে পড়তে পেয়ে গেলাম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপরে লেখা একটা প্রবন্ধ, নাম “বিশ্বকবির মগধ পরিক্রমা”। লিখেছেন সোমনাথ রায়। সেই আর্টিকেল পড়তে গিয়ে জানতে পারলাম, নোবেল পুরষ্কার পাবার পরে কবিগুরুকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল ২৩শে নভেম্বর ১৯১৩ তে বোলপুরে। সেখানে দেয়া রবীন্দ্রনাথের ভাষণের কিছু উক্তি আমার চোখে পড়লো। আমি পাঠকের সুবিধার্থে তুলে ধরছি কবিগুরুর সেই উক্তিগুলো-

 

“দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে, তার পরিমান নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতকাল তা আমি নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। ...

আজ য়ুরোপ আমাকে সন্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোন মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণিজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমাদের দেশের সঙ্গে তার কোন আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। ...

আজ আপনারা আদর করে সন্মানের যে সুরাপাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহন করতে পারবনা। ...

আমার রচনার দ্বারা আপনাদের যাদের কাছ থেকে আমি প্রীতিলাভ করেছি তাঁরা আমাকে অনেকদিন পূর্ব্বেই দুর্লভ ধনে পুরষ্কৃত করেছেন, কিন্তু সাধারণের কাছ থেকে নূতন সন্মানলাভের কোনও যোগ্যতা আমি নূতন রূপে প্রকাশ করেছি একথা বলা অসঙ্গত হবে”।  

 

কবিগুরুর উক্তিটি এইটুকুই লেখা ছিল আর বোদ্ধাদের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। এই কয়েকটি লাইনের মধ্যেই আমাদের চরিত্র অনেক সুন্দর করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। কবিগুরু অবশ্য সন্মানের শীর্ষে উঠেও অপমান আর লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পান নি। লেখক মাত্রেই কিছুটা অভিমানী হন বলেই আমার বিশ্বাস। কবিগুরুর অভিমানও তার দেয়া ভাষণেই ফুঁটে উঠেছে।

 

জাতি হিসেবে আমাদের নিয়ে আমার ভীষণ গর্ব হয়। আমাদের আর কিছু থাক না না থাক, পেট ভরা “আত্ম-অহমিকা” আর “ইগো” নামক নিজেকে বড় করার অস্ত্র তো আছেই। অন্যের ভাল আমাদের ভাল লাগে না। আমি নিজে উপরে উঠতে পারি আর না পারি, অন্য কারও উপরে উঠাও ভাল লাগে না। নিজের মনের বানানো কাল্পনিক মাপনীতে আমরা যথেচ্ছা অন্যকে উঠিয়ে ফেলে তাকে মাপতে থাকি। অথচ বিবেচনা করেও দেখি না সেটা মাপার যোগ্যতা আমার নিজেরই আছে কিনা।

 

এই প্রসঙ্গে একটা শৈশবের হাসির স্মৃতি দিয়ে শেষ করছি। সবে ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি সম্ভবত। জ্ঞানের দৌড় আর কতই হবে, বুঝে নিন। সেই নব্বইয়ের শুরুর দিকের কথা। বিজ্ঞান বইতে পড়লাম, থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা যায়। ব্যাস আর যায় কোথায়! চুপি চুপি বাসার সবার অগোচরে ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারটা বের করে নিলাম। বড়দের নজর এড়িয়ে চলে গেলাম রান্নাঘরে, দেখলাম ভাত ফুটছে টগবগ করে। কাপে করে সেখান থেকে এক কাপ ফুটন্ত মাড় নিয়ে তার তাপমাত্রা মাপার জন্য চুবিয়ে দিলাম থার্মোমিটারের পারদের অংশটা। ব্যাস আর যায় কোথায়! চোখের সামনেই সেই নলের অংশটা ফেটে সেখান থেকে পারদ বেরিয়ে গেল। আমি চোখের সামনে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

 

আমাদের অবস্থাও মনে হয় কিছুটা এমন। নিজের ‘ইগো’ দিয়ে অন্যের বিচার করতে করতে নিজেদের পারদও যে কখন বেরিয়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছি না।   

Author's Notes/Comments: 

৭ অক্টোবর ২০২১

View shawon1982's Full Portfolio