অধ্যবসায় বা ধৈর্য কোনটাই আমার মধ্যে খুব একটা নেই। আমি বরাবরই ছটফটে টাইপ ছিলাম। যদি আমি আমার লেখাপড়ার কথাই বলি, তাহলে সেখানেও আমার ধৈর্যের কোন বালাই ছিল না। একটানা দশ মিনিট ও পড়ে পেরেছি কিনা কোন কালে জানা নেই। অনেকেই হয়ত দেখে টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বসে ছিলাম। কিন্তু আমি কিছুক্ষণ পরেই হয়ত অন্য কিছু করতাম। আমাকে খুব সহজেই এক ঘেয়েমিতে পেয়ে বসতো। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যেতাম। তখন তো এটা ওটা করা লাগতোই। আমার সেই স্কুল কলেজের দিনগুলোতে তো মোবাইল, ইন্টারনেট এসব ছিল না। আমার শখের মধ্যে গল্পের বই পড়াই ছিল ভরসা।
আমি লেখাপড়ার মাঝে মাঝেও দেখা যেত একঘেয়েমি লাগলে গল্পের বই টই পড়তাম। তবে আমার এই গল্পের বই পড়াটাকে সবসময় ভাল চোখে দেখা হত না। মনে করা হত, আমি বুঝি ফাঁকি দিচ্ছি। হয়ত ফাঁকিই দিতাম, কিন্তু একটানা পড়ে ওঠার ধৈর্য হতো না। গ্যাপ দিয়ে দিয়ে পড়তাম। আবার মাঝে মাঝে লিখতাম! কি লিখতাম তারও কোন ঠিক ঠিকানা ছিল না। আরেকটা শখের মধ্যে ছিল বন্ধুদের কাছে চিঠি লেখা। চিঠি লিখতাম। ভাল লাগতো। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করে আবার নতুন উদ্যমে পড়তে বসতাম। আমার ক্ষেত্রে যেটা হত সেটা হল, একটু আগের একঘেয়েমিতে যে পড়া হচ্ছিলো না, সেটা একটু এদিক ওদিক করার পরে আরও দ্রুত হয়ে যেত। সবারই কিছু না কিছু নিজস্ব টেকনিক থাকে। আমার কম ধৈর্যের মত আমার টেকনিক গুলাও অদ্ভুত।
এবার আরও কিছু অদ্ভুত কথা বলছি। আমার দেখা মতে, যারা মন দিয়ে পড়ে, তারা সবাই নির্জনে, নৈঃশব্দ্যে পড়তেই পছন্দ করে। একাকী, নিরিবিলি। কেউ কেউ আবার শব্দ করে পড়ে। অনেককেই বলতে শুনেছি, শব্দ করে না পড়লে নাকি পড়া হয় না তাদের। আমার ক্ষেত্রে শব্দ করা তো দূরে থাক, আমি ঠোঁট ও নাড়ি না। আর নৈঃশব্দ্য? প্রশ্নই আসে না। আমি শব্দহীন ভাবে কিছুই করতে পারি না। একা একা থাকলেও আমার কিছু না কিছু শব্দ লাগে। আমি সেই কলেজ ভার্সিটিতে পড়ার দিনগুলোতে, আমাদের তৎকালীন বাসার ডাইনিং টেবিল এ পড়তে বসতাম। বাসার সবাই যে যার মত কথা বলতো, কাজ করতো, নানা রকমের শব্দ হতো। আমিও মাঝে মাঝে কথা বলতাম। কেউ কেউ টিভি দেখতো। আমি ওসবের মধ্যেই পড়তাম। নয়েজ বা আশেপাশে শব্দ না থাকলে আমি একাকী এখনও পড়তে পারি না। পরীক্ষার আগে পড়ছি, হয়ত অভিভাবকদের কেউ বললেন, এখানে কেন ঘরে গিয়ে পড়। আমার সেটা হত না। আমি বলতাম, না আমি এখানেই ভাল আছি। আমার শব্দ ছাড়া পরতে ভাল লাগে না। এমনও দেখা গেছে, ঘরে থাকলে কোন গান বা মিউজিক বাজিয়ে পড়ছি। আমার অভ্যাসটা এমনই। নির্জনতা খুব একটা পছন্দ হয়।
সেইসব পুরানো অভ্যাস বদলায়নি। এত সহজে বদলানো যায় না। এখনও একাকী কোন কাজ করতে গেলে কম্পিউটারে কিছু না কিছু চলতে থাকে। কখনও বৃষ্টির শব্দ, কখনও সমূদ্রে গর্জন। সারা পরিবেশ যখন স্তব্ধ তখন দেখা যায় আমার ঘরে বাজ পড়ছে, বাতাসের একটানা কলিজা-কাপানো শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। ওর মধ্যে আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। কাজ বা লেখাপড়ার মধ্যে নিজেকে সার্থক ভাবে ডুবিয়ে দিতে পারার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, মনোঃসংযোগ। সেটা আমার শব্দ দিয়ে আসে। আমি শব্দের মধ্যে ডুবে থাকি। বাইরে শব্দ না হলেও আমার মনের মধ্যে শব্দ হতে থাকে। কখনও কখনও সেই মনের শব্দগুলো অক্ষরে ফুটিয়ে তুলি। এখন যেমন করছি। আমি আমার শব্দহীনতার জগতটাকে নানা রকম অতীত বর্তমানের শব্দ দিয়ে ভরিয়ে তুলি। একটু একটু এগিয়ে যেতে থাকি। নতুন কোন অর্বাচীন শব্দের দিকে। এরপর কোন এক সময় নেমে আসবে সেই দুর্লঙ্ঘ্য নৈঃশব্দ্য।