আমার একটুখানি বৃষ্টিবিলাস

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

জানি নে, জানি নে
কিছুতে কেন যে মন লাগে না

ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে

 

আজকের লেখা শুরুই করলাম আমার প্রিয় ভানুকবির লেখা অতি প্রিয় একটা গানের কলি দিয়ে। আজ সকাল থেকেই আবহাওয়া যেন এই গানটার কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। আষাঢ় মাস তার স্বাক্ষর রাখছে আজ সকাল থেকেই প্রায় সারাদিন ধরে। ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম বাইরে ঝিরঝির শব্দে একটানা বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। বিরামহীন ভাবে ঝরছে তো ঝরছেই বৃষ্টি। ঘুম ভেঙ্গে মনে হল, আরেকটু ঘুমাই। কিন্তু গতকালকে অসমাপ্ত উপন্যাসটা টানছিলো ভীষণভাবে। উপন্যাস বাকী থাকলে আর বৃষ্টির সকালে ঘুম কি আসতে চায়। উঠেই পড়লাম! বাইরে শহুরে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে অনেকটা শব্দহীন ভাবেই। আমাদের বাসার পাশেই কতগুলো টিনশেডের বাসা আছে। ওখান থেকে যা একটু অল্পবিস্তর শব্দ পাচ্ছি পানি পড়ার। ওতে মন ভরে না। গাছপালা তো তেমন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে বাসার অদূরে যা দুই একটা আছে ওগুলোর পাতায় বৃষ্টির পানির রিমঝিম শব্দের যে মাদকতা আছে, তার কি কোন নেশার বস্তুতেও আছে? বৃষ্টির শব্দের যে মাদকতা, তা আছে বলেই মনে হয় কবি সাহিত্যিকরা বৃষ্টি নিয়ে এত কিছু লিখে গেছেন। ভানুকবির গানগুলো শুনলে তো মনে হয় গানের মধ্যেই বৃষ্টি ঝরে পরার উদ্দাম উচ্ছ্বলতা ধরে পড়ছে। তখন মনের মধ্যে যে অনির্বচনীয় অনুভুতি হয়, তার সাথে কোন পার্থিব সৌন্দর্যের তুলনা চলে না। কিছুতেই চলে না। কিছু জিনিস অবর্ণনীয়ই থেকে যায়। কবি সাহিত্যিকরা হয়ত তার কিয়দংশ তুলে আনতে পেরেছেন তাদের অনিন্দ্য লেখনীর মাধ্যমে। আমি কি পারছি তার? আমি যে কিছুই পারছি না! আমার দ্বারা তো সাহিত্য হচ্ছে না!

 

আমাদের বাসায় এক চিলতে বারান্দা। সেখানে একজন মানুষ দাঁড়ানোরও উপায় নেই। এতই ছোট একটা বারান্দা। ঐ বারান্দার দরজার এপাশে দাঁড়িয়েই আমাকে বৃষ্টি দেখতে হয়। বারান্দার গ্রিল বেয়ে বেয়ে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মালিপ্ল্যান্ট,আর শিম গাছ জাতীয় কোন একটা গাছ। লতানো গাছ আমার সবসময়ই অনেক প্রিয়। একটি গাছ এমনভাবে গ্রিল পেঁচিয়ে উঠে গেছে যে ওটাকে আর বিচ্ছিন্ন করার কোন সুযোগ নেই। এখন যদি এই বাসা আমাদের ছেড়ে দিতে হয় তাহলে ওই গাছটার কি হবে? সেটা চিন্তা করার কোন সুযোগ মনকে আর দিলাম না। মানুষ যেখানে মানুষের উপরে নিষ্ঠুরতা দেখাতে একটুও চিন্তা করে না, সেখানে সামান্য একটা বোবা গুল্মের উপরে মানুষ নিষ্ঠুরতা দেখাবে এটা আর নতুন কি? আমি কিছুক্ষণ গাছগুলোকে দেখে আবার বৃষ্টি দেখায় মন দিলাম।

 

বৃষ্টি ঝরছিলো তো ঝরছিলোই। অনেকটাই বিরামহীন ভাবে। থাকার কোন নাম গন্ধ ছিল না। দুই একটা পানির বড় বড় ফোঁটা গ্রিলের উপরে পেঁচিয়ে থাকা মানিপ্ল্যান্ট এর উপরে পড়ে, পাতাটা একটু নাড়া দিয়েই আবার নিচে পড়ে যাচ্ছিলো। সেই সাথে পাতাটা মৃদু মৃদু আন্দোলিত হচ্ছিলো। চেয়ারে বসে বসে আমি পানি আর পাতার এই খেলা দেখলাম কিছুক্ষণ। সামনের বাড়িগুলো নিষ্প্রাণভাবে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিলো। ওদের কোন বিরাম নেই। অতন্দ্র প্রহরীর মত ঘুমহীন শহরে বাড়িগুলোও ঘুমহীন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারাটা জীবনে ধরে। শহরের ইট কাঠের এই বাড়িগুলোর প্রতি দেয়ালে দেয়ালে কোন না জানি ‘না বলা কথা’ লেখা আছে অদৃশ্য কালিতে। কখনও হয়ত কিছু সুখের স্মৃতি আবার কখনও হয়ত কিছু কষ্টের স্মৃতি। কখনও হয়ত কারও কারও একাকীত্বের সাক্ষী হয়ে আছে এই নিরব নিথর বাড়িগুলোর প্রতিটি দেয়াল।

 

আমাদের মহল্লার ভেতরে চক্কর দিয়ে দেখা যাবে প্রায় বহুতল ভবনেই “টু-লেট” বিজ্ঞাপন ঝুলছে। অর্থাৎ বাসাগুলো ফাঁকা যাচ্ছে। অনেক বাসাতেই মানুষ নেই। আমি যে বিল্ডিং এ আছি সেখানেও একই অবস্থা। একটা ফ্ল্যাট গত ছয় মাসেরর উপরে ফাঁকাই পড়ে আছে। ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। এমন দৃশ্য কিন্তু নতুন না বর্তমানে। ঢাকার অনেক বাসাতেই এমন অবস্থা তৈরী হয়েছে। কিছুদিন আগেও দেখেছি করোনা এর লকডাউনে কত মানুষ বাসা ছেড়ে চলে গেছে। কে কোথায় গেছে তার খবর কে রাখে? মানুষ ছিটকে সরে গেছে এদিক থেকে সেদিক। মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা মানুষের সবকিছু শেষ করে দেয়। যে বাসায় একটা পরিবার স্বপ্ন দেখেছিলো কতগুলো ভালবাসার, টাকার অভাবে সেই ভালবাসা উবে চলে গেছে। যখন অভাবে চলে আসে সংসারে, তখন কোথায় থাকে ভালবাসা? হয়ত ভালবাসা থাকে কোথাও কোথাও, কিন্তু আমরাই সেই ভালবাসা থেকে এত দূরে সরে যাই যে আমরা খুঁজে পাই না।

 

আমাদের ভালবাসা কি আর আগের মত আছে? আমাদের ভালবাসা কি খুব দ্রুত পরিবর্তন হয় না? ভালবাসার মধ্যেও এখন নতুন পুরানো অনেক কিছুই চলে এসেছে। ইংলিশ এ প্রায়োরিটি যেমন বলে বাংলায় তেমন পরিবর্তনও বলা যায়। আমরা যেমন পরিবর্তন হয়ে যাই আমাদের ভালবাসাগুলোও পরিবর্তন হয়ে যায়। মানুষ দ্রুত বদলায় বলেই জানতাম কিন্তু বর্তমানে দেখি মানুষের চেয়েও বেশী দ্রুত বদলায় মানুষের ভালবাসা। আমি এই জিনিসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। হয়ত একসময় পেরে যাবো, কিন্তু এখন আমার সাময়িক একটু কষ্ট হচ্ছে। একসময় হয়তো আমিও পরবর্তন হয়ে যাবো। আর যে পরিবর্তন হতে পারবে না তাকে পর্যবসিত হতে হবে এক নতুন অন্ধকারে। যে অন্ধকারে শুধু সে থাকবে আর থাকবে তার মনের মধ্যে চেপে রাখা অভিমানগুলো। যেই অভিমানগুলোর সন্ধান সেই অন্ধকারের মানুষটা ছাড়া আর কেউ জানবে না। কেউ বুঝবে না তার কষ্টগুলো কোথায় হচ্ছিলো। সবাই শুধু বাইরের কষ্টটাই দেখে। কিন্তু বাইরের কষ্টগুলো যে কখনও কখনও ভেতরের দহনের অপ্রতিরোধ্য বহিঃরূপ হতে পারে, সেটা কেউ ভেবে দেখে না।

 

আমি বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসব আকাশ পাতালই ভাবছিলাম। আমার ভাবনাগুলো সবসময় এমন এলোমেলোই হয়। আমি গুছিয়ে যেমন লিখতে পারি না, তেমন গুছিয়ে মনে হয় ভাবতেও পারি না। আমার এটা নতুন কোন সমস্যা না। এটা আমার পুরানো সমস্যা। পুরানো সমস্যার মাত্রা এত বেশী থাকে যে আমি নতুন সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় পাই না। বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তখনও বৃষ্টির বেগ একদম কম ছিল না। একটা সাদা রঙের বিড়াল কে দেখলাম মাঝারি গতিতে সামনের বাসার দেয়াল ধরে হেঁটে আসলো। এরপর অবিশ্বাস্য চৌকস ভাবে গেটের উপরের লোহার বারের উপরে দিয়ে একটু  এদিক সেদিক না করে সুন্দর করে হেঁটে চলে গেল! এরপর একটা খোলা জানালার সামনে এসে ভেতরে ঢুকে পড়লো। বেড়ালটার ঢুকে যাওয়ার সহজাত প্রবনতা দেখে মনে হয় ওদের পোষা বিড়াল হতে পারে। হয়ত বর্ষাযাপন করতে বেরিয়েছিল। কি জানি, সবকিছুই আমার মনের কল্পনা। আমি তো আর ঐ বাসায় গিয়ে শুনতে যাবো না, তাদের বিড়াল আছে কিনা। তবে আমি বিড়াল অনেক পছন্দ করি। যত্নের অভাব হবে, আমি হয়ত ঠিকভাবে যত্ন নিতে পারবো না, এজন্য বিড়াল পুষি না। পোষা পশু পাখির কষ্ট হলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। আমাদের একটা পোষা শালিক পাখি ছিল। পরে কখনও লিখবো সেটার কথা। এখন নয়। এখন সেই পাখিটার কথা মনে করে মন খারাপ করতে ইচ্ছে করছে না।

 

এরপর মনে হল সেই বৃষ্টির আমেজে একটু কালো কফি না খেলা কি হয়? যদিও ক্রিমার আর চিনি দেয়া কফি আমার বেশী প্রিয়। কিন্তু এখন ক্রিমার আর চিনি খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি। এজন্য শুধু কালো কফি। সেটা বানাতে আর কি লাগে। আমার তো আর ব্রু কফি নেই। ইন্সট্যান্ট কফিতেই ভরসা। আমি মাইক্রোওয়েভ ওভেনে কফির পানি গরম করে ওর মধ্যে দেড় চামুচ কফি দিয়ে হাতে কফির মগ নিয়ে বসলাম। তিতা কফিতে চুমুক দিয়ে দিয়ে এটা ওটা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। অনেক কিছুই মনে পড়ে। সবকিছুকে মনে ঠাই দিতে ইচ্ছে হয় না। মনে চায় অনেক কিছুকেই ভুলে যাই। কফি আমার সেই কথাগুলো ভোলাতে পারে না। বৃষ্টি আর কফি আবার নতুন করে সবকিছু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার সব কিছু নতুন করে মনে করিয়ে দেয়। আমার উপায় নেই। আমার নিয়তি থেকে বের হয়ে আসার উপায় নেই।

 

 আমাকে অনেকেই পরামর্শ দেয়, ‘ভুলে যান’। আমাকে কেউ একটু দয়া করে জানাবেন কিভাবে ‘ভুলে যায়’। বিশ্বাস করেন, আমাকে যদি বলতে পারেন কিভাবে ভুলে যায়, আমি সেটাই করবো। আমি সব ভুলে যেতে চাই। কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবার একগাদা চিন্তা করে বসলাম যার কোন মাথা মুন্ডু নেই। তবে সবকিছু মিলিয়ে বেশ ভালই লাগছিলো।

 

কফি খেতে খেতে মনে হলো একটু নাটক না শুনলে কেমন হয়? আমার প্রিয় বেতার নাটক! খুঁজে খুঁজে বের করলাম একটা নাটক। কোন ধারনা ছিল না নাটকটা কেমন হবে। আমি শুধু মাত্র শিরোনাম দেখে পছন্দ করলাম নাটকটা। নাম ‘সীমান্তে দাঁড়িয়ে’। নাটকটা শুনে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে, আমি অনেকদিন ধরেই এমন কিছুই শুনতে চাচ্ছিলাম। এমন ভাল নাটক আমি অনেকদিন ধরেই শুনিনি। ঠিক আমি যেমনটা পছন্দ করি, পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন আর সেই আবহের নাটক, ওটা ঠিক তেমনই ছিল। আমার বৃষ্টি উপভোগের সময়টা বেশ ভালই কাটলো। আমি ব্যালকনিতে একা একা বসে গাছ দেখছি, বাড়িগুলোর বর্ষাস্নান দেখছি। কফির কাপে চুমুক দিয়ে দিয়ে মাদকতা নিচ্ছি আর কানের ভেতর বেজে চলেছে একটা নাটক, যা আমার জীবনের প্রতিচ্ছবিই আমার সামনে এনে দিচ্ছিলো অনেকাংশে। সবকিছু মিলে মিশে কেমন যেন একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। এক অদ্ভুত এক অনুভুতি নিয়ে আমার সেদিনের বর্ষাযাপন হলো।

Author's Notes/Comments: 

২১ জুন ২০২১

View shawon1982's Full Portfolio
patriciajj's picture

I felt like I was right there

I felt like I was right there with you, watching all the tranquil drama of a rainy day. I loved how you focused upon details with a meaningful, insightful eye, such as your concern for the tree's survival, the "reckless exuberance" of the rain's natural melody, the secret lives behind the drenched walls. 

 

A superbly written and entrancing blog. 

shawon1982's picture

thank you so much for your

thank you so much for your kind and soothing words. <3


Dr. Zayed Bin Zakir Shawon