সন্তানের ‘দোয়া’ পেতে চাই

আমি একজন বাবা। আল্লাহ পাকের অশেষ দয়ায় আমার সন্তানরা বড় হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সমস্ত সন্তানকে একটা সুস্থ এবং নিরাপদ জীবন দান করুণ। সতত নিজের মনে বাবা হিসেবে এই প্রার্থনা করে চলি। দিন যায়, ওরা বড় হয়। বাবা হিসেবে আমার চিন্তা বাড়ছে। সন্তানদের কিভাবে মানুষ করবো, ওরা কি শিখবে, কিভাবে বেড়ে উঠবে এই চিন্তাতেই দিন কেটে যায়। প্রতিদিনই নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। মাঝে মাঝে মনে হয় হিমশিম খেয়ে যাই। কিন্তু বাবা হিসেবে ধৈর্য হারা হওয়া যে কিছুতেই চলবে না। সন্তানরা বড় হবার সাথে সাথে ওদের মানসিক বিকাশ নানা রকম ভাবে হতে থাকে। বাড়তে থাকে ওদের চাহিদা আর সেই সাথে পরিবর্তন হতে থাকে ওদের আচার আচরণ। বেড়ে ওঠার সময়গুলো নিঃসন্দেহে অনেক নাজুক একটা সময়। বাচ্চার বয়স যখন পাঁচের বেশী হয়ে যায়, তখন থেকে সে অনেক কিছুই বুঝতে শিখে যায় এবং সেগুলোকে মনে রাখতে পারে। আমি আমার পাঁচ ছয় বছর বয়সের অনেক স্মৃতি অনায়াসে নির্ভুল ভাবে মনে করতে পারি। কাজেই এই বয়সী একটা বাচ্চার সাথে আমি কেমন আচরণ করছি, ওকে কিভাবে মানুষ করছি, সেটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

 

বাচ্চাকে মানুষ করতে গেলে আদর এবং শাসন দুইটাই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনটির বাড়াবাড়িই কখনও সুফল বয়ে আনতে পারে না। ‘শাসনবিহীন অতি আদর’, আর ‘আদরবিহীন অতি শাসন’ কোনটাই সন্তানের মানসিক বিকাশ সঠিক ভাবে করে না। ইংলিশে একটা প্রবাদ আছে, Excess of anything is bad বা অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না। এজন্য সন্তান লালন পালন করতে গিয়ে বাবা হিসেবেও আমি মনে করি এই কথাগুলো মেনে চলা আমার জন্যই অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছুকেই Optimize বা একটা উপযুক্ত এবং সঠিক মাত্রায় পরিচালনা করাই কাম্য। শাসন করতে গিয়ে বাচ্চার সাথে এমন রুঢ় আচরণ করা কোন অবস্থাতেই উচিত না যা বাচ্চার মনে পিতা মাতা সম্পর্কে কোন কষ্টের স্মৃতি জন্ম দেয়।

 

আমি নিজে যে সব কিছু ভালভাবে বুঝে গেছি তা নয়। ভুল আমার দ্বারাও হচ্ছে। এজন্য আমি সেই সব জ্ঞানী মানুষের পরামর্শ নিতে চাই বা নিচ্ছি, যারা আমার দৃষ্টিতে বেশ সহনশীল এবং আমাকে সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিচ্ছেন। আমি সেই সব মহাত্মা মানুষগুলোর কাছে কৃতার্থ। আমি চাই না, আমার সন্তান আমার প্রতি কোন নিরানন্দের স্মৃতি বা কোন বিরুপ ধারণা নিয়ে বড় হোক। সন্তান প্রতিপালন করা যে কতখানিক ধৈর্যের ব্যাপার সেটা টের পাচ্ছি। শাসন করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করলে এবং সবসময় নিজের মতামত সন্তানের উপরে চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশী। যেখানে যতটুকু শাসন, আর যেখানে যতটুকু ছাড় দেয়া দরকার, স্বাধীনতা দেয়া দরকার সেটাই করা উচতি। আটকে যাওয়া সুতা জোরে টান দিলে, ছিঁড়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

 

বাবা হিসেবে আমার সন্তানের কাছে আমার দুইটি প্রতিজ্ঞা। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আমি আমার প্রতিজ্ঞার উপরে নিজেকে অনড় অটল রাখতে পারি। প্রথমটি হল, কোন অবৈধ উপার্জনের সাথে নিজেকে জড়াবো না, তাতে আমার যত কষ্টই হোক না কেন। বাচ্চাদের মুখে হালাল বা বৈধ গ্রাস তুলে দিতে চাই। আর দ্বিতীয়টি হলো, বাচ্চাদের জন্য একটা নিরাপদ এবং আনন্দের শৈশব নিশ্চিত করা। আমি আমার নিজের জীবনে যে সব শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিলাম, আমি আমার বাচ্চাদের সেগুলো থেকে বঞ্চিত করতে চাই না। কখনই না। আমি আমার মতামত, শাসন বা পড়ালেখার বাহুল্য চাপ এমন কিছুই জোর করে চাপিয়ে দিতে চাই না যাতে ওদের শৈশব একটা দুঃসহ স্মৃতিতে পরিণত হয়। ওরা বেড়ে উঠুক আনন্দ নিয়ে। ওদের সারা জীবনে ‘বাবা’ শব্দটা যেন আনন্দের স্মৃতি হয়েই থাকে ওদের কাছে।

 

বাচ্চাদের কে যৌন-সহিংসতা থেকে রক্ষা করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকামী কিছু দানব বা পিশাচের হাত থেকে কোন শিশুই নিরাপদ নয়। এসব পিশাচের কাছে ছেলে শিশু, মেয়ে শিশুর কোন পার্থক্য নেই। এই দানবদের পৈশাচিক আনন্দের ছোবল একটা বাচ্চার পরবর্তী সারাজীবন দুর্বিসহ করে দিতে পারে। সমস্ত বাবা মায়ের উচিত সন্তানের সাথে এমন বন্ধুর মত আচরণ করা, যেন যে কোন অন্যায়ের কথা বাচ্চারা নিঃসঙ্কোচে বাবা মা কে এসে বলে দিতে পারে। মুখচোরা বা ঘরকুনো (Introvert) বাচ্চারা এই জাতীয় যৌন সহিংসতার শিকার বেশী হয় এবং কাউকে বলতে পারে না। সমস্ত বাবা মায়ের অত্যন্ত সতর্ক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা উচিত যে, বাচ্চার কাছে কে আসছে, কে কোলে নিচ্ছে, বা কে তাকে আদর করার চেষ্টা করছে। এই জাতীয় যৌন সহিংসতা আত্মীয় এবং কাছের মানুষদের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশী আসে। আর পরিচিত জনরা এই জাতীয় কাজ করে ফেলে দেখে মুখচোরা বাচ্চারা বাবা-মায়ের সামনে ভয়ে আরো গুটিয়ে যায়। কারণ পিশাচগুলা এমনই ধারণা দেয় যে, বাবা মা এগুলা শুনলে বকবে বা মারবে। আমার বাচ্চার সাথে কখনই আমার এই দূরত্ব থাকা উচিত নয় যে সে তার মনের কষ্টগুলো পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করে! শৈশবে যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া অনেক বাচ্চার মধ্যেই এর বিরুপ প্রভাব পরবর্তী বয়সে পড়তে থাকে। এবং কখনও কখনও বয়স তিরিশ এর পরেও এর বিরুপ প্রভাব প্রকট ভাবে শারিরীক এবং মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে।

 

আমার এসব কথা বলার পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটি হল, আমি আমার পরবর্তী জীবনে, বেঁচে থাকি আর নাই বা থাকি, আমার সন্তানের দোয়া পেতে চাই। আমি ওদের জন্য এমন বাবা হতে চাই, যেন ওরা মন থেকে আমার জন্য দোয়া করে। কোরান আমাদেরকে শিখিয়েছে সুন্দর একটা দোয়া। সূরা বনী-ইস্রাইলে দোয়াটির উল্লেখ আছে যা আমরা সবাই জানি। “রব্বিরহাম হুমা কামা রব্বায়ানি সগিরা” অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের (পিতা-মাতার) উভয়ের উপর আপনি সেরূপ অনুকম্পা করুণ যেরুপে শৈশবে তারা আমার প্রতিপালন করেছেন”। গত কিছুদিন ধরে এই আয়াতটা আমার মনকে খুব বেশী ভাবিত করে তুলেছে কারণ আমি যে একজন পিতা!

 

উল্লেখিত এই আয়াতে যদি শুধু এতটুকু বলা হত “রব্বিরহাম হুমা” তাহলে পিতা-মাতা যেমনই হোক না যেন, যেভাবেই আচরণ করুণ না কেন, সর্বত ভাবে তাদের উপরে আল্লাহর রহমত চাওয়া হতো! শৈশবে যে বাচ্চাকে ‘জারজ’ আখ্যা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে যত্রতত্র, সেও যদি কোনও ভাবে বেঁচে উঠে বড় হয়ে এই শব্দটুকু উচ্চারণ করে, তাহলে তার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী যেমনই হোক না কেন, তাদের জন্যও আল্লাহর রহমত বা দয়া-ই চাওয়া হত! কিন্তু মহা বিচারক আল্লাহ কি কারও উপরে অবিচার করতে পারেন? অসীম দয়ালু আল্লাহ কি কাউকে ভুলে যেতে পারেন? কারও অধিকার কে খর্ব করতে পারেন? উত্তর একটাই, কখনই না! আল্লাহ কারো উপর অবিচার করেন না! আয়াতের মধ্যে অতি সুন্দর ভাবে একটা বাক্যাংশ জুড়ে দেয়া হয়েছে, “কামা রব্বায়ানি সগিরা” অর্থাৎ কামা- যেরুপে, রব্বায়ানি-আমাকে প্রতিপালন করেছে, সগিরা- শৈশবে!

 

সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন যারা পিতা মাতা হয়েছি তাদের! সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, বাচ্চাকে শৈশবে যেমন আচরণ দিয়ে, যেমন ব্যবহার দিয়ে প্রতিপালন করা হবে, আমার সাথে আল্লাহর অনুকম্পা বা প্রতিদানও অনুরুপ হবে! এই আয়াতটা নিয়ে যত ভাবছি, তত বেশী সন্তানের হক বা অধিকারের ব্যাপারে আল্লাহ কে ভয় করছি! আমি যেন আমার সন্তানকে এমন ভাবে পালন না করি যার পরিপ্রেক্ষিতে, ওদের অন্তর থেকে উচ্চারিত এই দোয়া আমার জন্য অভিশাপ হয়! আমার বাবার দৃষ্টিতেই বলছি, সন্তানকে প্রতিপালনের ব্যাপারে এবং তাদের হকের ব্যাপারে আমি আল্লাহকে ভয় করি!  

Author's Notes/Comments: 

১১ মে ২০২১ 

View shawon1982's Full Portfolio