পা ধুয়ে পানি খা

অতীতে তো আর ফিরে যেতে পারব না, কিন্তু বর্তমানে যারা আছেন, বিশেষ করে সন্তানের পিতা-মাতা যারা আছেন, তাদের সবাইকে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। নিজের সন্তানকে, অন্য কারো সন্তানের সাথে তুলনা করা কি খুব জরুরী কিছু? নিজের সন্তানকে অন্যের সন্তানের সাথে তুলনা করে ছোট করে, তাদের কে মানসিক ভাবে দমিয়ে দিয়ে, পঙ্গু করে, দুর্বল করে দিয়ে কি মজা পান? আমি সবাইকে বলছিনা। যারা এই কাজ করেন তাদেরকে বলছি। অথচ, আপনারাই বলেন, বিশ্বাস করেন যে আল্লাহ সবাইকে সমান যোগ্যতা দিয়ে পাঠান না। আপনার সন্তানকে আপনার ইচ্ছা মত ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার হতেই হবে? এমনটা কি হওয়া জরুরী? যে বাচ্চা অঙ্কে আগ্রহ পায় না, হয়ত খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে সে, অন্য কোন বিষয়ে পারদর্শী! সেই বাচ্চাকে যদি তার বন্ধু বা অন্য কোন আত্মীয়ের বাচ্চার সাথে খোঁটা দিয়ে বলা হয়, ওমুকে অঙ্কে ৯৮ পায়, আর সেখানে তুমি ৭০ ও পাও না! পালটা উত্তরে যদি সেই বাচ্চাটা বলে, আমিও তো লিটেরাচারে ভাল করেছি, ও তো করেনি, তখন? তখন কি নিজের বাচ্চাটার সাহিত্যের জ্ঞান প্রশংসিত হয় আপনাদের কাছে? একটু ভেবে দেখবেন কি বিষয়টা? অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার কারণে ‘বেয়াদব’ উপাধি, মুখে মুখে তর্ক করবে না, আর সেই সাথে শারীরিক প্রহার তো আছেই।   

 

নিজের বাচ্চাকে অন্যের বাচ্চার সাথে তুলনা করে হেয় করা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বন্ধ হোক! আমাদের সমাজে পরিবর্তন আসুক। আমাদের উচিত স্বীয় বাচ্চার মধ্যে কি প্রতিভা আছে সেটা যথাযত ভাবে আবিষ্কার করা। সবাইকে এক কাতারে ফেলে বিচার করা উচিত নয়। প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু প্রতিভা আছে। সেই প্রতিভার বিকাশ হওয়া উচিৎ। তুলনা করে, ছোট করে কখনই মানসিক উৎকর্ষ সাধন করা সম্ভব হয় না। এই তুলনার খোঁটা সহ্য করতে না পেরে অনেক বাচ্চাই বিপথগামী হয়ে যায় আর অনেকেই পরবর্তী জীবনে অবাধ্যও হয়ে যায়। আবার অনেকেই আত্মহননের মত ভুল পথ বেছে নেয়। এই উদাহরণও আমাদের সমাজে কম নয় কিন্তু।  

 

কথাগুলো আমি আশপাশ থেকে যেমন শুনি, আমার জীবন থেকেও বলছি। জীবনে আমি নিজে বহুবার আমার অভিভাবকের দ্বারা বিশেষ করে আমার পিতা মাতার দ্বারা তুলনার স্বীকার হয়েছি। নিজের মনের মধ্যে নিজেই শামুকের মত গুটিয়ে গেছি। অন্যের চেয়ে সামান্য কম নাম্বার পেয়েও ঘরে মুখ লুকিয়ে থেকেছি। কারণ সামান্য কম নাম্বার পাওয়ার কারণে, আর উনাদের কথা শোনার কারণে আমি নিজেকে বারবার অথর্ব মনে করেছি। কি নিদারুণ কষ্টে কাটিয়েছি দিনের পর দিন। বেড়াতে গিয়েও রেহাই পাইনি। মেহমানের মধ্যেও রেহাই পাই নি। দুই বাচ্চার বাপ হয়েও, মেহমানের সামনে আমার ফিরিস্তি শুনতে হয়েছে ক্লাস এইটে সরকারী বৃত্তি কেন পাইনি! পিতা মাতার মুখে উৎসাহ এর চাইতে তুলনার কথা শুনেছি অনেক অনেক বেশী। আমার মনের মধ্যে হীনমন্যতা আর ভয় এমন ঢুকে গেছিলো যে, ক্লাস সিক্সে ভর্তি পরীক্ষায়, ১০০ এর মধ্যে ৯৪ এর নিশ্চিত উত্তর দিয়েও আমি কাঁদতে কাঁদতে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েছিলাম। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায় একটা অঙ্ক না পারার কারণে আমার সারা শীতের ছুটি মাটি হয়ে গিয়েছিল মনের কষ্টে! কি লাভ হয়েছিল এসব করে? কি লাভ হয়েছিল?

 

আমাকে মাত্র ৬ বছর বয়সে আমার জনৈক ‘তো’ ভাইয়ের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছিল, তার ‘পা ধুয়ে পানি খেতে’। আমরা একই বয়সের ছিলাম। কথাটার অর্থ আমি সেই বয়সে ঠিকঠাক না বুঝলেও আমাকে যে ওর থেকে ছোট করা হয়েছে সেটা আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। কারণ আমি অঙ্ক ওর মত ভাল পারতাম না। আমার অপরাধ সেটাই ছিল। আমার সেই ‘তো’ ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি কিভাবে পেরিয়েছিল বা আদৌ ভালভাবে পেরোতে পেরেছিল কিনা জানি না, কারণ তার জীবনের আর কোন ফলাফলই আমার জানা নেই। আর অঙ্ক না পারার কারণে ‘পা ধোয়া পানি খাওয়া’ সেই আমি, স্রষ্টার অপার কৃপায়, এঞ্জিনিয়ার হয়েছি, জীবনের প্রথম শিক্ষকতা শুরুই করেছিলাম অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে! এখন যদিও অঙ্কের নই, তবুও শিক্ষকতা পেশাতেই আছি।

Author's Notes/Comments: 

৩ মে ২০২১ 

View shawon1982's Full Portfolio