উত্তরাধিকার

সেই ২০০৩ সালে যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা বুয়েটে লেভেল-১ টার্ম-২ তে পড়ি তখন আমাদের একটা সেশনাল সাব্জেক্ট ছিল ME-160 Mechanical Engineering Drawing-I যা এখনও আছে। আমি কোন কালেই ড্রইং এ ভাল ছিলাম না। ড্রইং আমার কাছে সবসময় একটা আতঙ্কের নাম ছিল। এখন এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে তো আর আমার মামদোবাজি চলবে না। যা দিয়েছে সবগুলাতেই পাস করতে হবে। আমিও ভয়ে ভয়ে ড্রইং করতাম। আমি ভাল পারতাম না। যে সব বন্ধুরা ভাল পারতো ওদের কাছ থেকে হেল্প তো অবশ্যই নিতাম। কিছু কিছু ড্রইং বাসায় এসেও করা লাগতো। আর্টপেপার গুলাকে মাস্কিন টেপ দিয়ে ডায়নিং টেবিলের সাথে আটকে করতাম। কয়েক ঘন্টা কিভাবে যেন পার হয়ে যেন। লক্ষ্য থাকতো একটাই যেন কোন নিয়ম কানুনে ভুল না হয়। দশের মধ্যে নাম্বার দেয়া হতো। আমার মত অভাগাও গড়ে ৮ করে পেতাম! আনন্দ আর ধরতো না আমার মনে। পরে কিভাবে কিভাবে যেন সেই সাবজেক্টে আমি A+ ও পেয়ে গিয়েছিলাম। এ আমার জন্য ছিল রাজ্য জয় করার মত ঘটনা! থাক সেসব পুরানো দিনের কথা।

 

ড্রইং করতে আমাদের অপরিহার্য টুল হিসেবে লাগতো টি-স্কেল আর সেট-স্কয়ার। ১৮ বছর পার হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে আর কয়েক দফা বাসা পরিবর্তনের ফলে আমার সেই সেট-স্কয়ারটির ভাগ্যে কি হয়েছিল জানি না। কারণ মাঝের ৫ বছর তো আর দেশেই ছিলাম না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে টি-স্কেলটি বহাল তবিয়তে আমার সাথে রয়ে গেছে। এখনও আমার সাথে আছে। সেটার ওপরে মাস্কিন টেপে এখনও আমার নাম আর বুয়েটের রোল নাম্বার ০১০২০১০ লেখা আছে। অনেকদিন থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল, যোগ্য কাউকে পেলে আমি নিজের হাতে তাকে এটা দিয়ে দিবো!

 

প্লাটিকের একটা স্কেল! দাম তো মোটেই বেশী কিছু না। কিন্তু ঐ যে, মনের আবেগ! আবেগটুকু দিয়েই ভাবতাম, আমার যোগ্য উত্তরাধিকার কাউকে পেলে আমি তাকে দিয়েও যাবো।

 

পেয়েও গেছিলাম আমার উত্তরাধিকার! দেয়ার জন্যও বেরও করে রেখেছিলাম। ছোটভাই তাওসিফের জন্য বরাদ্দ ছিল! গতবছর যখন ও লেভেল-১ টার্ম-১ এ পড়ত, তখনই ওকে ছবি দিয়ে বলেছিলাম, আমার এই জিনিস আমি তোমাকে দিবো! শুনে ও খুশী হয়েছিল! তখন চলছিলো লকডাউন। এখনও সেটাই চলছে। ওদের সম্পূর্ণ একটা সেমিস্টার বলতে গেলে লকডাউনে অনলাইনে হয়ে গেল। এখন সেই লেভেল-১, টার্ম-২ তে পড়ছে! এখনও শেষ হলো না লকডাউন! বরং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে! আবার ওদের করতে হচ্ছে অনলাইনে ক্লাস! সেই ড্রইং ও ওদের এঁকে অনলাইনে জমা দিতে হচ্ছে! বাসায় যেহেতু আঁকতে হচ্ছে, তাই সেট-স্কয়ার দিয়েই এঁকে ফেলছে! টি-স্কেল আর লাগছে না।

 

গত জানুয়ারীতে ছোট ভাই তাওসিফ আমার বাসায় এসেছিল টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে। তখনও আমি ওকে বলেছি, এখন নিয়ে যাবে নাকি পরে নিয়ে যাবে? কারণ ক্লাস শুরু হতে তখনও পাক্কা এক মাস বাকী ছিল! ও বলেছিল, ভাইয়া, আবার তো আসা লাগবেই হয়ত, তখন না হয় নিয়ে যাবো। আমিও রাজী হয়ে গেলাম। আমারও মনে কিঞ্চিত ইচ্ছা ছিল, হয়ত আমিও কিশোরগঙ্গে ওদের বাসায় ঘুরতে যেতে পারি। তখন না হয় আমিও নিয়ে যেতে পারি। আর না হয় কুরিয়ার সার্ভিস তো রইলোই!

 

 সব আশা ইচ্ছা আকাঙ্খা শেষ হয়ে গেল আবার করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়াতে।  তাওসিফেরও আর আসা হচ্ছে না আপাতত আর আমারও আর যাওয়া হচ্ছে না। সব অচল যে! ওদেরও অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়ে অর্ধেকের বেশী তো প্রায় শেষও হয়ে গেল। জানি না সামনের দিনগুলোতে কি অপেক্ষা করছে। তিন মাস ধরে প্রায় টি-স্কেল টাকে দেখেছি চোখের সামনে আর ভেবেছি, এইতো এবার এটাকে দিয়ে দিবো আমার উত্তরাধিকার কে! দেয়া হলো না! মনের দুঃখে আবার ওটাকে স্টোরে তুলে রাখলাম কিছুক্ষণ আগে!

 

তবুও চাই, পৃথিবীটা ভাল হয়ে যাক। আমার ছোট ভাই বোন গুলা ভাল থাকুক! ওদের শিক্ষাজীবন নিশ্চিন্ত হোক! পৃথিবীর যেখানেই আমাদের আদরের উত্তরাধিকারীরা থাকুক না কেন, ওরা ভাল থাকুক। ওদের জীবনে আর কোন অযাচিত দুশিন্তা না থাকুক। শিক্ষা বিষয়ক কোন হতাশা কোন গ্লানি না থাকুক। ভাল থাকুক তাওসিফের মত আমার সব ছোট ছোট ভাই বোন সবাই, আমার উত্তরাধিকারীরা।  

Author's Notes/Comments: 

২২ এপ্রিল ২০২১

View shawon1982's Full Portfolio