অর্ধেক মুরগী (মেক্সিকান লোকজ গল্প অনুবাদ)

 

ইংলিশ থেকে অনুবাদঃ ডঃ জায়েদ বিন জাকির (শাওন)

 

 

বাসার উপরে বাতাসের গতি নির্দেশিকা দেখেছেন কখনও? খেয়াল করেছেন যে সেটার উপরে অনেক সময় একটা ছোট মুরগীর আকৃতি রাখা হয় যা সেই নির্দেশিকার সাথে ঘুরতে থাকে আর বাতাসের গতিবিধি নির্দেশ করতে থাকে? এখানে আপনাদের কে এখন সেই গল্পটাই শোনানো হবে। এটা একটা পুরানো লোকজ গল্প। সেই কবে নানী দাদীদের মুখে মুখে শোনা যেত এই গল্প। আসুন তাহলে আমরা সেই গল্পটাই পড়ে নেই একবার।  

সেই কবেকার কথা। এক মেক্সিকান খামারে একটা মুরগী কতগুলো ডিমে তা দিচ্ছিলো। যখন তা দেয়ার সময় শেষ হয়ে এলো প্রায়, তখন ডিমের খোসাগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে সেখান থেকে একে একে ছানাগুলো বের হয়ে এল। তেরটা ডিম ছিল। একে একে বারটা ছানা বের হয়ে এলো কিন্তু একটা ডিম থেকে ছানা বের হলো না। মুরগীটা ভীষণ এক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ফুটে বের হওয়া বারটা ছানা এদিক সেদিকে ছোটাছুটি করতে লাগলো, কিন্তু মা মুরগীটা কোথাও যেতে পারছিলো না ওই বাকী ডিমটার জন্য। সে তখনও ওটার উপরে বসে বসে তা দিতে লাগলো। এটা দেখে খামারের অন্য সব পশু পাখি বলাবলি করতে লাগলো, এই ডিমটা থেকে নিশ্চই কোন এক বিশেষ ধরণের ছানা বের হবে। তা না হলে এত দেরী কেন হচ্ছে? 

অবশেষে আরও কয়দিন পরে সেই ডিম থেকে খোসা ভাঙ্গার একটা মৃদু শব্দ পাওয়া গেল। ভেতর থেকে ছানাটা সেটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিলো। মুরগীটা সাহায্যের জন্য। সবশেষে খোসাটা ভেঙ্গে গেল এবং তা থেকে ১৩ নং ছানাটি বের হয়ে আলোর মুখ দেখলো। ছানাটি আসলেই অসাধারণ ছিল। কারণ এটি মোটেও অন্যদের মত ছিল না। এর সব কিছুই ছিল একটা করে। একটা চোখ, একটা ডানা, একটা পা! আর গায়ের পালকের পরিমানও অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ঠিক অর্ধেকই ছিল। খামারের ভেতরে যত হাস, টার্কি ছিল সবার মুখে মুখে এই কথা সারা খামারে ছড়িয়ে পড়লো। একে একে সবাই সেই ছানাটাকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ছড়াতে ছড়াতে সেই গল্প দূরের মাঠে চরতে থাকা গরুর কান পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। ঘোড়া, গাধা কেউই বাদ যায়নি। সবাই জেনে গেল মুরগীর সেই অদ্ভুত ছানাটার কথা। সবাই দেখতে এলো আর নানা রকম কথা বলাবলি করতে লাগলো।

একটা হাস বললো, ‘আরে এটার দেখি একটা মাত্র ডানা!’

তা দেখে একটা টার্কি বললো, ‘আহারে! এটা দেখি একটা অর্ধেক মুরগী ছানা!’ টার্কির মুখ থেকে শোনা সেই অর্ধেক মুরগীছানা শোনার পর থেকে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো নামটা। সবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলো সেই ছানাটা।

একদিন দূর থেকে উড়ে আসা একটা ছোট পাখির মুখে সে নিজের তারিফ শুনতে পেলো। পাখিটি বলেছিল, ‘মেক্সিকোর ভাইসরয়ের কোর্টেও তো এমন অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাওয়া যায় নাএটা দেখে ছানাটির মনে আগ্রহ জেগে উঠলো। নিজে নিজে ঠিক করলো যে সে কোর্টে গিয়েই দেখবে, ভাইসরয়ের কোর্টে আসলে কি কি আছে। ততদিনে ছানাটি কিন্তু বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে। একদিন সকালে সে সবাইকে বিদায় জানিয়ে মেক্সিকোর কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিলো। যেহেতু একটি মাত্র পা ছিল, তাই যাত্রা তো এত সহজ ছিল না। সে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে লাগলো।  

খুব বেশী দূরে তখনও যেতে পারেনি সে। একটা ঝর্ণার ধারে এলো। দেখলো তার পানি প্রবাহিত হতে পারছে না ঠিকমত। কারণ ওর ভেতরে গাছের ডালপালা এসে ভরে গেছে একেবারে। ঝর্ণাটি মিনতি করে ওকে বললো, ‘সুপ্রভাত হে অর্ধেক মুরগী! তুমি কি আমার ভেতর থেকে এই ডালপালা গুলো একটু সরিয়ে দেবে ভাই? দেখো না, আমি যে ঠিক মত প্রবাহিত হতে পারছি নাঅর্ধেক মুরগী দ্রুত ডালগুলো সরিয়ে দিলো। পানি সুন্দর প্রবাহিত হতে লাগলো এবার। ঝর্ণা তাকে অনুরোধ করল, ‘এসো ভাই! একটু সাঁতার কেটে আনন্দ করে যাও। কিন্তু ওর যে অনেক তাড়া ছিল। দ্রুত চলে যেতে যেতে বললো, ‘আমার হাতে যে সময় নেই ভাই! আমাকে দ্রুত মেক্সিকোর কোর্টে যেতে হবে

 

আবার কিছুদূর যাবার পরে দেখলো, কয়েকটা পাথরে টুকরার মাঝে নিভু নিভু হয়ে একটু সামান্য আগুন জ্বলছে। নিভে যায় যায় অবস্থা। আগুন ওকে অনুরোধ করে বললো, ‘সুপ্রভাত হে অর্ধেক মুরগী! তোমার ডানাটি দিয়ে আমাকে একটু বাতাস করো না ভাই! আমি তো প্রায় মরতে বসেছি!’ অর্ধেক মুরগীটি ডানা ঝাপটে বাতাস দিয়ে আগুন উস্কে দিলো। আগুন অনুরোধ করলো, ‘একটু বসে যাও না ভাই। আমার থেকে একটু ওম নিয়ে আরাম করে বসোএবারো সেই একই উত্তর দিলো অর্ধেক মুরগীটা, ‘আমার হাতে যে সময় নেই ভাই! আমাকে দ্রুত মেক্সিকোর কোর্টে যেতে হবে

এক পা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগলো আবার অর্ধেক মুরগীটা। কিছুদূর গিয়ে দেখলো, খানিকটা বাতাস আটকা পড়েছে একটা ঘন ঝোপের মধ্যে। বের হতে পারছে না। বাতাসও তাকে অনুনয় করে বললো, ‘সুপ্রভাত অর্ধেক মুরগী! তুমি কি আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করবে? আমি যে বের হতে পারছি না’। এটা শুনে অর্ধেক মুরগীটা বাতাসকে সাহায্য করলো সেখানে থেকে বের হতে। তখন বাতাস কৃতজ্ঞতার সাথে তাকে বললো, ‘কিছুক্ষণ থেকে যাও না ভাই। আমি তোমাকে হালকা একটা পালকের মত এখানে সেখানে উড়িয়ে নিয়ে বেড়াবো’এবারও সেই অর্ধেক মুরগীটার সেই একই উত্তর, আমার হাতে যে সময় নেই ভাই! আমাকে দ্রুত মেক্সিকোর কোর্টে যেতে হবেআবার সে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগলো। এক সময় এসে পৌছালো মেক্সিকো শহরে।

শহর দিয়ে যাওয়ার সময় সে কত কিছু দেখতে লাগলো যা কখনও কল্পনাও করেনি। কর বড় বড় দালান কোঠা, বাজার, ফলমূল শাক সবজি আরও কত নাম না জানা জিনিসপত্র। এসব দেখতে দেখতে একসময় সে ভাইসরয়ের প্রাসাদের কাছে এসে গেলো।

‘শুভ অপরাহ্ন! আমি একটু ভাইসরয়ের সাথে দেখা করতে চাই ভাই’, বললো অর্ধেক মুরগীটা, প্রাসাদের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা উইনিফর্ম পরা জাঁদরেল এক দারোয়ানকে। এ কথা শুনে আরেক দারোয়ান ভারী একচোট হেসে নিলো। আরেকজন ব্যাঙ্গ করে বললো, ‘তুমি তার চেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকোগে যাও’।

 

সহজ সরল অর্ধেক মুরগীটা সেই কথার মর্মার্থ না বুঝে সরল অর্থ ধরে নিয়ে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ওকে দেখেই বাবুর্চি বলে উঠলো, ‘আরে আরে! কি সৌভাগ্য আমার! ম্যাডামের জন্য তো স্যুপ বানাবো বলে আমি এমন একটা মুরগীই খুঁজছিলাম’! সে ওই অর্ধেক মুরগীটাকে ধরে একটা ডেগচিতে পানি দিয়ে বসিয়ে দিল চুলার উপর। যখন প্রচন্ড গরমে অর্ধেক মুরগীটার প্রানান্ত অবস্থা, তখন সে আগুনকে স্মরণ করলো, ‘ওহে আগুন! আমাকে সাহায্য করো। আমাকে পুড়ে যেতে দিও না’।  

আগুন উত্তর দিলো, ‘তুমি আমাকে তখন সাহায্য করেছিলে যখন আমার সাহায্যের দরকার ছিল। এখন আমার পালা তোমাকে উপকার করার। তুমি পানিকে বলো আমার উপরে এসে পড়ুক, আমি নিভে যাবো তাহলে’। তখন অর্ধেক মুরগীটা পানিকে বললো, ‘পানি আমাকে সাহায্য করো। তুমি আগুনের উপরে এসে পড় যেন আমি পুড়ে না যাই’। পানিও তাকে বললো, ‘তুমি আমাকে তখন সাহায্য করেছিলে যখন আমার সাহায্যের দরকার ছিল’। একথা বলেই পানি আগুনের উপরে এসে পড়লো, আর আগুন নিভে গেল।

 

এরপর বাবুর্চি যখন এলো, তখন দেখলো আগুন নিভে গেছে। বিস্ময়ের সাথে বললো, ‘একে যেমন দেখা গেছে, তার চেয়ে তো এ দেখি ঝামেলা অনেক বেশী করে’! এদিকে এক আয়া এসে বলে গেছে, ম্যাডাম নাকি আজকে স্যুপ খাবেন না। শুধু স্যালাড খাবেন। এবার বাবুর্চিটা অর্ধেক মুরগীর ঠ্যাং টা ধরে ওকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।   

যখন বাতাসের মধ্যে হুটোপুটি খাচ্ছিলো, তখন সে বাতাসকে বললো, ‘আমাকে সাহায্য করোএবার বাতাস তাকে বললো, ‘তুমি আমাকে তখন সাহায্য করেছিলে যখন আমার সাহায্যের দরকার ছিল’। বাতাস তাকে অনেক উঁচুতে উড়িয়ে নিয়ে চললো। বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে অনেক বড় দালানের টাওয়ারের একেবারে উপরে নিয়ে রাখলো। বাতাস বললো, ‘এখান থেকে তুমি সবকিছু দেখতে পাবে, তোমার আর কোন বিপদ নেই ভাই’। 

 

এরপর থেকে সেই জনশ্রুতি অনুসারে, আবহাওয়ার নির্দেশিকা মুরগীটা একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়ির একেবারে উপরে এবং নির্দেশ করে তার বন্ধু বাতাস এখন কোন দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে।

Author's Notes/Comments: 

১৭ই ফেব্রুয়ারী ২০২১ গল্প সংগ্রহঃ উম্মে রিফাত আরা (রিনতি)

View shawon1982's Full Portfolio