২১ অক্টোবর ২০২০

‘হিকারি ওয়ে’ এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা


হার না মানা এক যোদ্ধার গল্প

= = = = = = = = = = = = = =


কাকে দিয়ে শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না। ছেলেকে দিয়ে নাকি বাবাকে দিয়ে? দুইজনই যে এই লেখায় সমান গুরুত্বের দাবীদার। হিকারি ওয়েকে নিয়ে এই আর্টিকেলটা লেখার ইচ্ছা অনেক দিন ধরে মানসপটে ভাসমান থাকলেও, আমার আলসেমির জন্য হয়ে ওঠেনি। আজ লিখতে বসলাম, আমার জানা এই জীবন্ত অনুপ্রেরণা হিকারি ওয়ে এবং তার বাবা কেঞ্জাবুরো ওয়ে। দুইজনই বিখ্যাত। একে অন্যকে উপজীব্য করে দুইজনই বিখ্যাত দুই মানুষ। জাপানের অধিবাসী কিন্তু এই পিতা-পুত্রের পারষ্পারিক সম্পর্কের মাধুর্য বিশ্বকে আলোড়িত করেছে সন্দেহ নেই। আমার দুর্বল লেখনিতে কিছুটা ধরে রাখছি উনাদের কথা। ধরে নিন আমি আসলে নিজেকেই অনুপ্রাণিত করতে চাচ্ছি আমার এই লেখনীর মাধ্যমে।

 

হিকারি একজন জাপানিজ যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী। মূলত চেম্বার মিউজিক কম্পোজ করতে সে পছন্দ করে এবং ইতিমধ্যে তার কাজের উপরে কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। হিকারি’র কম্পোজিশনে করা প্রথম মিউজিক অ্যালবামটি এক মিলিয়ন বা দশ লক্ষাধিকের বেশী বিক্রি হয়েছিল। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তার চারটি যন্ত্রসঙ্গীতের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো অনেক জনপ্রিয় হয়েছে বিশ্বব্যাপী। হিকারি’র জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৩ই জুন। পিতা সাহিত্যিত কেঞ্জাবুরো ওয়ে এবং মাতা ইউকারি ইকেউচি। হিকারি জন্মেছিল একাধিক শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে। তার শারীরিক বিকাশে জন্মগতভাবে এতটাই বেশী ত্রুটি  পরিলক্ষিত হয়েছিল যে চিকিৎসকরা সব রকমের আশা ছেড়ে দিয়ে ওয়ে দম্পতিকে জানিয়ে দিয়েছিল তাদের প্রথম এই সন্তানটি হয়ত বাঁচবেই না। অটিজম ছাড়াও, দৃষ্টিতে মারাত্মক সমস্যা এবং মৃগীরোগও তার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছিলো।

 

ওয়ে দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে হিকারি প্রথম। বাবা কেঞ্জাবুরো ওয়ে কখনোই হতাশ হননি এবং হাল ছেড়ে দেননি। প্রথম সন্তানের জন্মের কয়েক বছর আগেই ১৯৫৭ সাল থেকে সাহিত্যের জগতে নিজের অবস্থান করে নেন এবং সেভাবেই চলছিল। হিকারির জন্মের পর কেঞ্জাবুরো ওয়ে’র জীবনে নেমে আসে এক দুর্বিসহ পরীক্ষা। এই অসুস্থ শিশুটির পরিচর্যা এবং তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ওয়ে দম্পতির যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে সেটা কেঞ্জাবুরো’র কিছু উপন্যাসে অনেক প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। হিকারির জন্মের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে কেঞ্জাবুরো লেখেন উপন্যাস A personal Matter এরপরে আরো লেখেন Teach us to outgrow madness (1969), My deluged soul (1973), Rouse up, O  young men of the new age (1983) ইত্যাদি। এগুলো কেঞ্জাবুরো’র অনেক খ্যাতনামা লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা যেগুলোতে উনি নিজের জীবনের প্রতিফলন দিয়ে লিখেছেন, ছেলেকে নিয়ে তার অনির্বান যুদ্ধের কথা। উনার লেখা A healing family এর প্রচ্ছদে তার ছেলে হিকারির ছবি দেয়া আছে, ইংলিশ ভার্সানে। এটিও উনার পরিবারেরই টিকে থাকার কাহিনি।

 

এবার এই মহান পিতা সম্পর্কে একটু না বললেই তো নয়। জাপানের ইতিহাসে কেঞ্জাবুরো ওয়ে হলেন দ্বিতীয় জাপানী সাহিত্যিক, ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা’র পরে যিনি সাহিত্যে অনন্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৯৪ সালে রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমী কর্তৃক সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কেঞ্জাবুরো ওয়ে’র যে সকল উপন্যাস উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, সবগুলোই তাঁর বায়োগ্রাফিতে নোবেল প্রাইজের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা আছে বিশেষভাবে।

 

আবার একটু ফিরে যাই হিকারি’র কাছে। হিকারি’র বিকাশ তো আর পাঁচ দশটা শিশুর মত ছিল না। কথাও বলতো না তেমন একটা। হিকারির যখন কয়েক বছর বয়স, তখন একদিন টিভি প্রোগ্রাম দেখার সময়, পাখির ডাক শুনে ওয়ে দম্পতি তাদের ছেলের মধ্যে একটা ভাবান্তর লক্ষ্য করেন। হিকারি পাখির ডাকে মোহিত হয়ে সেটাকে নকল করার চেষ্টা করে। বাবা কেঞ্জাবুরো একটা রেকর্ড কিনে আনেন পাখির ডাকের উপরে। যেখানে একটা মহিলা কন্ঠ পাখির ডাক রেকর্ড শোনানোর পরে নাম বলতে থাকে এটা কোন পাখির ডাক। হিকারি এই রেকর্ড খুব তন্ময় হয়ে শুনতো। একদিন পিতা কেঞ্জাবুরোর সাথে বাইরে ঘুরতে বের হলে, গাছ থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক শোনা মাত্রই হিকারি অবিকল রেকর্ডে শোনা ওই মহিলার কথা নকল করে বলতে থাকে, এটা ঐ পাখি! সেখান থেকে কেঞ্জাবুরো’র মাথায় এলো ছেলেকে মিউজিকে উৎসাহী করা যায় কিনা! সেই চিন্তা থেকে হিকারির জন্য একজন মিউজিকের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হল, তাঁর নাম ছিল কুমিকো তামুরা। ওয়ে দম্পতি খেয়াল করলেন, ছেলে মুখে কথা বলে কিছু প্রকাশ করার চেয়ে মিউজিক বাজিয়ে নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে বেশী আগ্রহী। সেখান থেকেই হিকারির মিউজিকের জগতে একটু একটু করে পুনর্জন্ম লাভ হলো।

 

এই পিতা-পুত্রের গল্প অনেকটাই সংক্ষিপ্ত। খুব বেশী করে লেখার কিছু নেই কিন্তু তথাপি কেঞ্জাবুরো ওয়ে যেভাবে ভালবাসা দিয়ে তাঁর এই প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আর এটা করতে গিয়ে যে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে তাকে, সেটি আমি মনে করি পিতা হিসেবে আমার জন্য অনেক বড় শিক্ষা। সন্তানের বিকাশে পিতার ভুমিকা যে কত বড় হতে পারে এবং একটা সন্তান, সে যেমনই হোক না কেন, পিতার জন্য যে কত বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে, সেটা এই পিতা পুত্রের গল্প থেকে সহজেই অনুমেয়। এইটুকু বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না, কেঞ্জাবুরো ওয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়ে অনেক আনন্দিত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা কি তাঁর চেয়েও বেশী যখন কেঞ্জাবুরো ওয়ে তাঁর ছেলে হিকারির মিউজিক কম্পোজিশন গুলো শুনেন?    

 

View shawon1982's Full Portfolio