**পরস্পর তুলনা ও বৈষম্যমূলক আচরণ
**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-৬
বিষয়টা যথেষ্ট Sensitive একটা ব্যাপার। নিজের পরিবার এবং আশপাশে চোখ রাখলেই ব্যাপারটা বেশ প্রকট আমারে দেখা যাবে। নাটক সিনেমা এবং অনেক আবেগ তাড়িত দর্শনে এই জাতীয় কথা হর হামেশা শুনে থাকি বাপ-মায়ের নিকট নাকি সব সন্তানই এক। কথাটা শুনতে যতখানি মধুর লাগে, বাস্তবে এর তিক্ততার মাত্রা শ্রাব্য মধুরতার চাইতে অনেকগুন বেশী। কারণ কানের শ্রাব্যতার রেশ কিছুক্ষণের জন্য কাজ করে কিন্তু যে তিক্ততার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয় সেটার রেশ এক জীবনে মেটে না। সেই তিক্ততা শুধু মনে নয় বরং মন থেকে শরীর এবং শরীর থেকে গোটা পরিবারের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। খুব কাছে থেকে দেখা কিছু উদাহরণ আছে।
এক পরিবারের কথা জানি। সেখানে মা নিজেই, সজ্ঞানে হোক আর ছোট সন্তানদের ফুসলানির প্রভাবে হোক, আর অন্য যে কারনেই হোক, বড় ছেলেকে একটা জমি থেকে বেমালুম গায়েব করে দিয়েছে। অথচ বাকী দুই ভাইয়ের সাথে তারও সেই জমিতে সমান ভাগ ছিল। এর কোন উত্তর পরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক বাবা মা ইচ্ছাকৃত এই বৈষম্যের পেছনে সুন্দর একটা যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলেন। একজনকে বলা হয়, তোমার তো অনেক আছে, তুমি তো প্রতিষ্ঠিত, ওর তো নাই, এজন্য ওকে একটু বেশী দেই।
এবার যদি প্রশ্ন করি, যে ছেলেটা বা মেয়েটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, (১) সে কি এই প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য অক্লান্ত কষ্ট করেনি? (২) ধরে নিলাম, তার পিতা মাতা প্রভাব প্রতিপত্তি খাঁটিয়ে প্রথম জনকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। আসুন এবার একটু পর্যালোচনা করে দেখি। নাম্বার ১- যদি প্রথম সন্তান নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে থাকে বা আয় উন্নতি করে থাকে, তাহলে সেই পরিশ্রম করতে ছোটগুলারে মানা করছিলো কে? সমান না হলেও, খেয়ে পরে সন্মানের সাথে বাঁচার জন্য যোগ্য মানুষের কি কাজের খুব বেশী অভাব? নাকি ছোটোটার গায়ে বাতাস দিয়ে ঘোরা দেখতে বাবা মায়ের অনেক ভাল লাগতো? একটু গভীরে গিয়ে দেখেন, পিতামাতার অন্যায় প্রশ্রয় অনেক ফ্যামিলিতে ছোটগুলাকে উদাসীন করে দিয়েছে। আগেই বলেছি, সিনেমার আবেগ দিয়ে বাস্তব জীবন বিচার করলে চলবে না। সিনেমায় গান গাইতে গাইতে ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যায়। বাস্তবে সেটা হয় না। নাম্বার ২- যদি পিতা মাতা প্রভাব খাটিয়ে চাকরী যোগাড় করে প্রথম সন্তানকে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিতে পারে, তাহলে ছোটগুলার ক্ষেত্রেও সেটা করা যেত। তাহলে ছোটগুলাকে সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা গেল না কেন? কারণ এখানেও বৈষম্য আর সমন্বয়ের অভাব ছিল। পিতা মাতার একপেশে আচরণ ছিল।
আরেকটি পরিবারের কথা জানলাম কিছুদিন আগে। জনৈক পিতা, মহা ব্যাতিব্যস্ত হয়ে তার ফ্ল্যাটগুলো থেকে অতীত তড়িঘড়ি করে ছোট দুইজনকে লিখে দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লাগলেন। বড়টাকে বলা হল, তোমাকে পরে লিখে দেয়া হবে তোমার ভাগ। যেই ফ্ল্যাটে তারা ছিল, সেটাই নাকি বড় ছেলেকে লিখে দেয়া হবে এমন একটা কথা তাদের বাবা অনেকদিন থেকেই বলে আসছিলেন। অবশ্য যতদূর জেনেছি সেটা একটা মৌখিক কথার কথা ছিল মাত্র। বলাই সার। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বড়টা একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করে, খেয়ে পরে ভালই আছে। অন্তত কারো কাছে চেয়ে চিনতে খেতে হচ্ছিলো না তার। মনে মনে কিছু সন্দেহ ঘনীভূত হবার কারণে বাবাকে বড় ছেলেটা জিজ্ঞাসা করে কি কারণে ছোটজনকে এমন তড়িঘড়ি করে ফ্ল্যাট লিখে দেয়া হচ্ছে? উত্তরে অনেক রকম যুক্তি ইতং বিতং শোনার পরে, মোদ্দা কথা যেটা দাঁড়ালো, এর বিনিময়ে ছোটটা জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে। ছোটটার ঘর সংসার সুখের হবে, এবং নানা রকম সামাজিক অনাচার থেকে বাঁচা যাবে। এসব কথার কোনটাই বড় ছেলের বোধগম্য হচ্ছিল না। পালটা প্রশ্ন করে জানতে চাইলো, ফ্ল্যাটের বিনিময় প্রতিষ্ঠা পাইলে আমারেও লিখে দাও আমারটা, আমিও পাই কিছু প্রতিষ্ঠা। ফ্ল্যাট লিখে দিলে সবাইকে দাও। খালি ও পাবে, আমি বাদ যাব কেন? ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেসনের ফ্যাকড়া আপাতত সেইদিন মুলতুবী হয়ে গিয়েছিল। পরের ঘটনা আমার জানা নাই।
ছোটবেলা থেকেই কোন সন্তানের প্রতি অযাচিত পক্ষপাতিত্ব করে, ‘তোমার তো অনেক আছে’ এই জাতীয় কথা বলে অন্য কারো কোল টানা মনে হয় আমাদের সমাজেই বেশী আছে। পশ্চিমারা কতটা এটার ধার ধারে আমার জানা নাই। আপাতত আমি আমাদেরটা নিয়েই আছি নিজস্ব গন্ডিতে যা দেখি। পিতামাতার এমন প্রকট বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে মানসিক দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে স্থায়ী একটা ঘৃণাও তৈরী হতে দেখেছি। পিতা মাতা প্রচ্ছন্ন ভাবে সন্তানকে বঞ্চিত করে দিয়েছে, এমন উদাহরণও কম নেই আমাদের চারপাশে। এমন বৈষম্য মূলক আচরণ শুধু যে উপার্জন ক্ষম হলেই হয় তা হয়, তুলনা করা এবং সেই আলোকে খোটা দেয়া আমাদের পিতা মাতার একটা সাধারণ চিত্র।
যখন স্কুল শিক্ষক ছিলাম, একটা প্যারেন্টস মিটিং এর কথা মনে পড়ে। যেখানে সন্তান সহ পিতামাতা বা অন্তত কোন একজনকে এসে রিপোর্ট কার্ড নিতে হবে এবং শ্রেণী শিক্ষকের সাথে দরকারী কথা সেরে নেয়া যেতে পারে সন্তানের উন্নতিকল্পে। আমি ছিলাম দুইজন শ্রেণীশিক্ষকে একজন। একজন মা তার সন্তানসহ এলেন। ছেলেটা ভালই ছিল। রেজাল্ট এমন কিছু খারাপও ছিল না। দুই একটা সাব্জেক্টে গ্রেড অন্য আরেক ভাল ছাত্রীর চেয়ে কিঞ্চিত কম হয়ে গেছিল। মা টা ছেলের সামনেই আমাদের বললো অনেক আক্ষেপের সাথে, ‘ওকে তো আমি আর ভাত খাওয়াই না, ওমুক ওমুকের মায়েরা ভাত খাওয়ায়। ওকে যদি ভাত খাওয়াতাম তাহলে কি ওর রেজাল্ট এমন হত’? পাঠক বুঝতে পারছেন তো? আশি আর নব্বই এর দশকের পাঠকের তো এই জাতীয় কথার অন্তর্নিহিত ভাবার্থ বুঝতে না পারার কথা না। শিক্ষকদের ঝুলিতে এমন উদাহরণ অনেক আছে। অথচ একজন ‘প্রাগোইতিহাসিক ভাবধারার’ অভিভাবককে কে বোঝাবে, আপনার সন্তান অঙ্কে অনেক ভাল হয়ত না অনেকের মত রেজাল্টের বিবেচনায়, কিন্তু বাংলাতে দেখেন, ‘ভাত খাওয়া বাচ্চাটা’ থেকেও আপনার সন্তান হয়ত ভাল। সে হয়ত ফিজিক্স ভাল পারে না, কিন্তু সোস্যাল স্টাডিজ সবার চাইতে ভাল পারে। ওমুক পারে তো ও কেন পারবে না? ওমুকও ভাত খায়, আমিও তো ওরে ভাতই খাওয়াই, তাহলে ও কেন পারবে না? এই জাতীয় মানসিকতা পরিহার না করতে পারলে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কোন কল্যানকর ইতিহাস রেখে যাচ্ছি না যেটার পদাঙ্ক তারা অনুসরণ করবে।
বাংলাদেশী বাবা মায়ের একটা খুব পছন্দের খোটা এবং তুলনা করার বাক্য হচ্ছে, ‘ওমুকের পা ধুয়ে পানি খা’। শৈশবে আমার বয়স মাত্র ছয় বছর বয়স, তখন আমাকে আমার এক জনৈক সমবয়সী কাজিনের পা ধুয়ে পানি খেতে বলা হয়েছিল। কারণ আমি অঙ্ক তার চেয়ে একটু কম বুঝতাম, এবং গার্ডিয়ানের ধারণা মতে সেই ছয় বছর বয়সেই আমি হয়ত সেই কাজিনের থেকে থেকে একটু কম(!) পড়াশোনা করতাম। যা হোক, চাকরী শুরুই হল আমার শিক্ষকতা দিয়ে এবং বাংলাদেশের একটা স্বনামধন্য বিদ্যালয়ে আমি অঙ্কের-শিক্ষক হিসেবেই আমার ক্যারিয়ার শুরু করি। আর যার পা ধুয়ে আমাকে পানি খেতে বলা হয়েছিল, সেই কাজিনের কোন শিক্ষাগত সুনাম আমরা আর পরে খুঁজে পাইনি, বরং সেটা অনেকটাই বিতর্কিত ছিল।
হয় নয় কথায়, নিজের সন্তানকে, ওমুক ওমুকের পা ধুয়ে পানি খেতে বলাটা কতটা হীন এবং নীচু মানসিকতার পরিচয় বহন করে সেটা কি পিতামাতারা বোঝেন না? নাকি তারাও তাদের জীবনে যেটা শুনে এসেছেন, সেটার প্রয়োগ ভাল হোক আর মন্দ হোক, নিজের সন্তানের উপরে করতেই হবে? নিজেদের বিবেক বুদ্ধি কোথায় থাকে তখন?
আমি আমার নিজের সন্তানকে কখনও কারো সাথে তুলনা দেই না। এই মানসিকতা ওকে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জন করতে সাহায্য করে এবং করছে। প্রতিটি সন্তানই মেধাবী আর পিতামাতার কাজ হল সেই মেধা বিকাশে সহায়তা করা। অযথা তুলনা করে নিজের সন্তানের অনাগত প্রতিভাকে ধুলিস্মাৎ করে দিয়ে, নিজেদের মনগড়া স্টিমরোলার চালানো মোটেই কল্যানকর নয়। আমার নিজের মেয়েটা পরিক্ষায় যেই নাম্বারই নিয়ে আসুক না কেন, আমি আর ওর মা মন ভরে ওকে উৎসাহ দেই। কারো কথা ওর কাছে কক্ষণোই জানতে চাই না। জিজ্ঞাসা করার কোন প্রয়োজনও বোধ করি না। যা শিখছে, নিজের মত করে শিখুক, নিজের আনন্দে শিখুক। নিজের ভাল নিজেরা বুঝতে শিখুক। আমি চাই আমার বাচ্চারা নিজেদের ব্যক্তিত্বে নিজেরা সামনের দিকে এগিয়ে যাক। কোন কিছু ওদের উপরে চাপিয়ে দিয়ে আমি ওদের মানসিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে চাই না।