১৩ মে ২০২০

**নানা রকমের মেধা এবং আমাদের অতীত


**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-৫

 

শৈশবের কিংবা কৈশোরের কথা কি কিছু মনে পড়ে আপনাদের? বিশেষ করে যাদের শৈশব কৈশোর কেটে গিয়েছে সেই ৮০র দশক বা ৯০র দশকে? কেন বলছি? কারণ আমি সেই সময়ের মানুষ যে। তখনই কেটেছে আমার শৈশব আর কৈশোর। এখন আমার বাচ্চাদের শৈশবকাল চলছে। যখন ওদের জীবন নিয়ে ভাবি, তখন বারংবার নিজের শৈশব কৈশোরের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায়, স্কুল ভ্যানে করে স্কুলে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা, পরীক্ষার কথা, লেখাপড়ার কথা। যেহেতু আমার শৈশবে খেলাধুলার সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না, সেহেতু আমার লেখায় খেলাধুলা অনুপস্থিত যদি দেখেন, ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন আশাকরি। আমি নিজে ঘরকুনো (Introvert Nature) এর ছিলাম, আর এটাকে সুকৌশকে কাজে লাগিয়ে আমার পরিপার্শ্বের মানুষগুলো আমাকে বই খাতা আর লেখাপড়ার চৌহদ্দিতে বন্দী করে ফেলেছিল। এজন্য আমার ভেতর খেলাধুলা করার আর কোন তাড়না কখনও তৈরীই হয় নাই। যেহেতু আমাকে ওইদিকে Motivate করা হয়নি, কাজেই আমার ভেতরে এর মধ্যে কোন ভাললাগা তৈরী হয়নি। বই খাতা কলম, আর পরীক্ষার পর পরীক্ষার সাথেই কেটে গেছে আমার শৈশব কৈশোর থেকে শুরু করে প্রায় ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত।

 

এখন যখন আমি আমার সন্তানদের কথা ভাবি, আমি সর্বদা চিন্তা করি, কোন অবস্থাতেই আমার পূর্ব জীবনের সূত্রপাত যেন আমার সন্তানদের না হয়। ওদের শৈশব কৈশোর যেন ভীতিমুক্ত এবং আনন্দের হয়। ওরা যেন স্বনির্ভর হতে শেখে শৈশব থেকেই। Decision Making এর জন্য ওরা যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে শেখে এখন থেকেই। আমি চাই, আমার সন্তানের জীবনে লেখাপড়া যেন আনন্দ বয়ে নিয়ে আসুক। আনন্দের সাথে ওরা পড়তে শিখুক। আমার মেয়েটাকে খেলার মধ্যে, খাবার খাওয়ানোর মধ্যে মুখে বলে বলেই কোরানের কিছু সুরা মুখস্ত করে ফেলেছি।

 

আমি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আরিফ-রাফিয়ার সন্তানকে কাছে থেকে দেখেছি। বাচ্চাটা তার নানী-দাদীর কাছে শুনে শুনে অনেক সূরা এমনকি আয়াতুর কুরসী পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলেছে। মাসজিদের ভেসে আসা আযানের ধ্বনি সে আমনভাবে আত্মস্থ করেছে যে, বাচ্চাটা খেলার সময়ও সমানে আযান দিতে থাকে, ঠিক মাসদিজের মোয়াজ্জিনের মত করেই। আমি ওদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে, বাচ্চাটার কন্ঠে আযান শুনে বিস্মিত এবং যুগপৎ বিমোহিত হয়েছি। খেলতে খেলতে বাচ্চাটা এগুলো শিখে নিয়েছি। আমি সেখান থেকেও শিক্ষা নিয়েছি। আমার বাচ্চাদের, আমাদের বাচ্চাগুলোর শৈশবের প্রতিটি শেখা আনন্দের সাথে হোক, যেটা আমাদের শৈশবে আমরা অনেকটাই পাইনি।

 

আমার সন্তানের বয়স কত হয়ে গেল, এই বয়সে তো ওর এই ক্লাসে পড়া উচিত ছিল, এই জাতীয় কোন মন্তব্য আমার মনে এখন আর বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে না। ডাক্তার হতে হবে, এঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এসব কথা আমরা আমাদের শৈশবে যে শুনে এসেছি, এগুলোও আমার মনে এখন আর প্রভাব বিস্তার করে না। ওদের বয়স হোক, নিজেদের ভাল নিজেরা বুঝতে শিখুক, তখন নিজেরাই বুঝে যাবে তাদের কি হওয়া উচিত। যে ভবিষ্যতের কোন নিশ্চয়তা নেই, সেই ভবিষ্যতের কাল্পনিকে সোনার হরিণের পিছে দৌড়ে আমি বর্তমানের আনন্দকে মাটি করার মোটেও পক্ষপাতী নই। আমি নিজে প্রতিযোগিতার যে ইঁদুর দৌড়ে নিজের শৈশব কৈশোরের আনন্দকে মাটি করে দিয়েছি, আমি আমার সন্তানের ব্যাপারে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি কখনই চাইবো না। বয়স যা হয় হোক, শিখুক, শিখতে থাকুক, আনন্দের সাথে শিখতে থাকুক। দরকার হয় প্রাইভেটে পরীক্ষা দিবে, নিজের যোগ্যতা নিয়েই বিচার করবে। এজন্য আমি ভীত নই চিন্তিত নই। কোথায় পড়বে? আমার যেমন সামর্থ্য থাকবে সেখানেই পড়বে! পাব্লিক, প্রাইভেট যেখানে সামর্থ্য হয় সেখানেই পড়ুক। আমি এসব নিয়ে চিন্তিত নই।

 

আমি এখন চিন্তা করি আমার সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি আর কি কি করাতে পারি সেগুলো নিয়ে। যেগুলো আমার জীবনে আমি পাইনি আমি চাই, যদি সম্ভব হয় সেগুলো ওরা করুক। আমার ইচ্ছা আছে আমার সন্তানরা, মার্শাল আর্ট, সাঁতার, স্কেটিং, আউটডোর গেমস এগুলো খেলুক শিখুক। আমি আমার মেয়েটাকে, মাথা গুজে টেবিলে বসে পড়ার চাইতে, মার্শাল আর্টের গাউন পরে কসরত শিখুক সেটা দেখতে বেশী পছন্দ করবো। বাইরের জগতটা দেখে দেখে শিখুক। আনন্দের সাথে কাটাক শৈশবটা। বাবা হিসেবে অন্তত আমার উপরে ওর মনে কোন ক্ষোভ যেন না থাকে, আমার ঐকান্তিক চেষ্টা এখানেই। শৈশবে আমার অনেকবার মার্শাল আর্ট শেখার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। শেখা আর হল কই? আজ এ পরীক্ষা, কাল ঐ ভর্তি কোচিং, সন্ধ্যায় বাসার টিউটর এমন হরেক সাতকাহন। আমার স্বপ্ন অঙ্কুরিত হবার আগেই নিজের হাতে নিজের মনের ভেতর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছি আমি নিজেই। আমাকে যে ভাল রেজাল্ট নামক সোনার অলৌকিক হরিণের পেছনে দৌড়াতে হবে!

 

প্রতিটি শিশুই এক ধরণের নিজস্বতা নিয়ে জন্মায়। আমরা এই ব্যাপারে একেবারেই ওয়াকেবহাল না বললেই চলে। আমাদের ধারণা ছিল, বা আমাদের পিতামাতাদের ধারণা ছিল, লেখাপড়ায় ভাল করে রেজাল্ট ভাল করে মানেই মেধাবী, ভাল ছাত্র। আর কেউ যদি ছবি আঁকে, ভাল গান করে, ভাল অভিনয় করে, এগুলোকে কোন প্রতিভার ভেতরেই ধরা হত না। এগুলোকে শুধু নিছক ‘শখ’ বা বড়জোর গালভরা একটা নাম Extra Curricular Activities এমন একটা নাম দেয়া হত। কিন্তু এগুলা দিয়েও যে প্রতিভার বিকাশ হতে পারে সেটা যেন আমাদের অনেকের বোধগম্য হতেই চায় না। আর এখানেই সেযুগ আর এযুগের পার্থক্য সূচিত হয়ে গেছে অনেকটাই প্রকটভাবে। আমাদের সময়ে কেউ যদি, নাচ, গান, অভিনয়, ছবি আঁকা এসবে বেশী সময় দিত, তাহলে নির্ঘাত তাকে ‘নষ্ট হয়ে যাচ্ছে’ বলে ধরা হত। পাঠ্য বইয়ের বাইরে যে মেধা বিকাশের সুযোগ আছে সেটা যেন কেউ মানতেই চাইতো না। অর্থাৎ এটাকে কোন প্রতিভার পর্যায়ে ধরা হত না। অথচ শিশুরা একেকজন একেক ধরণের প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। অভিভাবক হিসেবে আমাদের কাজ হল, বাচ্চার ভেতরে কোন ধরণের প্রতিভা প্রকট সেটাকে খুঁজে বের করে এবং সেদিকে বাচ্চার মেধা বিকাশে সহায়তা করা। এবং সেগুলোকে উপজীব্য করেও যেন বাচ্চাটা তার দৈনন্দিন পাঠ তৈরী করতে পারে সেদিকে উৎসাহ দেয়া।  

 

শিশুদের শেখার ধরণও একেকজনের একেক রকম। কেউ পড়তে ভালবাসে, কেউ লিখে লিখে পাঠাভ্যাস করতে পছন্দ করে, কেউ হাতে কলমে কাজের মাধ্যমে শিখতে পছন্দ করে। সব শিশুকে একই পদ্ধতির গন্ডির ভেতর ফেলে দিয়ে শেখানোর চেষ্টা করলে হীতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সময়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো সেই এক গৎবাঁধা নিয়মের গন্ডিতে সবাইকে আবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। সন্ধ্যা হতেই বই নিয়ে বস, হাতের লেখা লিখো, হোম ওয়ার্ক তৈরী কর, তোমার স্যার এসেছেন বই নিয়ে বস ইত্যাদি। আমি যদি আমার নিজের জীবনের দিকে তাকাই এর চেয়ে বেশী কিছু তো আর খুঁজে পাই না। আমি নিজে পড়ে পড়ে শিখতে পছন্দ করতাম, ব্যস ওটাই মনে হয় আমার জগত হয়ে গেল। এর বাইরে আমার যেন আর কিছু থাকতে নেই! উঠতে বসতে শুইতে খাইতে, পড় পড় আর পড়। স্কুল থেকে ফিরে, রেস্ট নিয়ে পড়তে বস, স্যার আসবে পড়তে বস। ঘুমানোর সময়ও শুনতে হত, কাল স্কুল আছে, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। তুমি বেড়াতে যাবা কি করে, তোমার না পরীক্ষা? আচ্ছা পরীক্ষার পরে দেখা যাবে, কোথায় যাবা না যাবা। একি গল্পের বই পড়ছ কেন? তোমার কি রচনা মুখস্ত হইসে? গল্পের বই পড়ে কি রেজাল্ট খারাপ করবা নাকি?...  এগুলোই থাকতো আমাদের নিত্যদিনের শোনা কথাগুলা আমাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে। এগুলো কি আমাদের জীবনে বড় কোন কল্যান বয়ে নিয়ে এসেছে নাকি এখন মধ্যবয়সে এসেও আমার হারানো শৈশব কৈশোর নিয়ে স্থায়ী একটা দুঃখ রয়ে গেছে? পাঠক ভেবে দেখুন।

View shawon1982's Full Portfolio