** সস্তা জনপ্রিয়তা এবং কদর্যতা
এই লেখার শুরুতেই আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এজন্য যে আমার এই লেখা অনেকের কাছে খারাপ লাগতে পারে যদিও কাউকে আক্রমন করা কাউকে হেয় বা তুচ্ছ করার জন্য আমার এই পোস্ট না। কাজেই আমাকে ভুল বুঝবেন না আশাকরি। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমন করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। বর্তমানে যেসব সোস্যাল মিডিয়া আমরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি সেগুলোতে একটা শব্দ প্রায় শোনা যায়, সেটা হল ‘ভাইরাল’ হওয়া। এটা সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষা হলেও, সাধারণ অর্থে Critiqued বা সমালোচিত, অথবা ভিন্নার্থে লোকপ্রিয়তা অর্জনকেই বোঝায়। এই ভাইরাল হওয়া আবার দুই ধরণের। এক শ্রেণীর মানুষ জনপ্রিয়তার মাধ্যমে লোকের গোচরে আসতে চায়, আর এক শ্রেণীর আছে ‘লোকনিন্দার’ মাধ্যমে আসে। দুই দলের উদ্দেশ্যই একই, সেটা হল মানুষ তাদের চিনুক, জানুক, তাদের নিয়ে আলোচনা, করুক, সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠুক, লাইক-কমেন্টের বন্যায় সবাই প্লাবিত হয়ে যাক ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এগুলো পেতে গিয়ে অনেকেই তাদের বুদ্ধি, বিচার, বিবেচনা, বিবেক এমনভাবে বিলুপ্ত করে বসে যে সেটা তারা টেরই পায় না। অনেকটা Painless Tumor এর মত তাদের মনের ভেতর এই ব্যাধির বিস্তার চলতে থাকে। মনোবিজ্ঞান বিশ্লেষণ আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্য না। আমার কিছু ভাল লাগা আর খারাপ লাগার উল্লেখ করার জন্য আসা।
গত বছরের মাঝামাঝিতে আমার পরিচয় হয় আমাদের ১৯৯৯ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের গ্রুপের সাথে। তখন শুরু। আমি একটা গ্রুপের আমন্ত্রন পেয়ে সেটায় জয়েন করি। সেখান থেকে অনের সাথে পরিচয় হয়। অনেক ভাল লাগা কাজ করতে থাকে। ২৬ বছর পর খুঁজে পাই অনেক পুরানো একটা স্কুল ফ্রেন্ডকে এবং সেই সাথে পরিচয় হতে থাকে সমমনা আরো অনেক অনেক ভাল ভাল বন্ধুর সাথে। আমার কাছে বন্ধুর সংজ্ঞা শুধুই বন্ধুতে। এখানে ছেলে-মেয়ের কোন পার্থক্য আমার কাছে নেই। আমার কাছে ‘বান্ধবী’ এই শব্দটার কোন অস্তিত্ত্ব নেই। সেটার কোন প্রয়োজন আমি আমার জীবনে দেখি না। বন্ধুবৎসল সবাই আমার কাছে বন্ধুই। এদের সাথে আলোচনা, ঝগড়া, মতানৈক্য, মনের কথা বলাই যায় কারণ আমি এদের আমার মতই মনে করি। আর যে বয়সে আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন উন্নীত হয়েছি তাতে আমরা সবাই এখন অনেক অনেক পরিপক্ক বা ম্যাচিউরড হব সেটাই আশা করা যায়।
আমাদের ব্যাচের প্রথম গ্রুপে জয়েন করার পর আমার মনে হয় এখনও এক বছরও হয় নাই কিন্তু এই ১৯৯৯ সালকে কাজে লাগিয়ে এরপরে আরো কত কত যে গ্রুপের আনাগোনা দেখা গেছে তার ইয়ত্তা নাই। কয়েকদিন পরপরই দেখি একটা নতুন নতুন গ্রুপে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কে খুলছে, কেনই বা খুলছে, সে আমার কাছে এক বিরাট রহস্য। কারো কারো কাছে জানতে চেয়েও কোন সদুত্তর না পাওয়াতে আমি এসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। এত খুঁজে দেখার সময় কই? আমাকে আমন্ত্রন জানালে জয়েন করে বসে থাকি, আবার মন না চাইলে বের হয়ে আসি। সাম্প্রতিক কালে কয়েকটা গ্রুপ থেকে বেরিয়েও গিয়েছি।
যেটা বলছিলাম, এইসব গ্রুপগুলাতে সারাদিন নানা রকমের পোষ্ট আসতেই থাকে এবং আমাও ওয়াল, নিউজফিড এগুলো দিয়েই ভর্তি থাকে। এদের মধ্যে যে সকল পোস্ট আসে তার সিংহভাগই বা তার চেয়েও অনেক বেশী মাত্রায় যেগুলো আসে তা হল Fun-Post, Troll, Meme, কৌতুক এসব। এগুলো এত বেশী মাত্রায় আসতে থাকে, যেন মনে হয় আমাদের সবার জীবনে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। আনন্দ, কৌতুক আর অন্যকে তামাশার বস্তু বানানো ছাড়া যেন আমাদের আর কোন কাজই নেই! এসব গ্রুপে এই জাতীয় পোস্ট দিয়ে অনেক বন্ধু ইতিমধ্যেই তুমুল জনপ্রিয়তার একদম শীর্ষে। পোষ্ট দিতে না দিতেই কমেন্ট, লাইকের বন্যায় নিউজফিড প্লাবিত হতে থাকে। এসব বন্ধুদের এই জাতীয় ‘মহার্ঘ্য’ পোস্ট এ সবসময় জোয়ারের তেজ-কটাল চলতে থাকে। এই প্লাবনে ভাঁটা বলে কিছু নেই। তা বেশ! এদের এসব পোস্টের তোড়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট যেগুলাতে চিন্তার খোরাক ছিল, দর্শন ছিল, সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সাড়া না পাওয়ায় বুদ্ধিদীপ্ত পোষ্ট যারা করে, তাদের একসময় বিরক্ত আসা স্বাভাবিক। এটা আমার ক্ষেত্রেও হয় এবং আমি অকপটে আমার বন্ধুদের কাছে গিয়ে রাগ ঝেড়ে আসি! কি করবো, বন্ধু যে! ওদের না বললে আর কাকে বলবো?
ইদানিং কালে আমাদের গ্রুপগুলোতে যে সমস্ত পোষ্ট আমাকে রীতিমত মানসিক পীড়া দিচ্ছে তার দুই একটা মাত্র স্যাম্পল আমি উল্লেখ করবো। এই জাতীয় ‘ছ্যাবলামি’ পোষ্ট আমার ব্যাচমেট কেউ দিতে পারে সেটা চিন্তা করা আমার জন্য কিঞ্চিত কষ্টকর হলেও মেনে নিয়েছি। কারণ সবার চিন্তাধারা আর মেন্টাল ম্যাচিউরিটি এক হয় না। কিন্তু পোষ্ট দাতার চাইতেও আমার বেশী দুঃখ লাগে তাদের জন্য যারা খেয়ে, না খেয়ে সেইসব পোস্টে লাইক, কমেন্ট করার জন্য ঝাপিয়ে পড়ে তাদের জন্য। কেন রে ভাই, তোমাদের কি বিচার বিবেচনা নেই?
এক বন্ধুর পোষ্ট এমন, “আয় আমরা পিকনিক করি। আমি লবণ দিমু, তোরা কে কি দিবি বল”। ব্যাস আর যায় কোথায়! শুরু হয়ে গেল। এই পোস্টের রমাদান ভার্সন ও পেলাম গ্রুপে। “আমি ইফতারি বানামু গ্রুপে। তোরা কে কি দিবি বল”। এবার আসুন শুনি কিছু ধর্মীয় ভার্সন। “আরবীতে হরফ আছে ২৯ টা। আমি একটা বলছি, তোরা একটা একটা বল। আমি বললাম আলিফ”। এর একটু আপগ্রেড ভার্সান একটা দেখলাম, “পবিত্র কোরানে সূরা আছে ১১৪ টা। সবাই একটা একটা করে নাম বলে যা”। বাহ ভাই বাহ! এই ইন্টারনেট এর যুগে, আঙ্গুলের স্পর্শে যেখানে ঢাউস ঢাউস বই নেমে যাচ্ছে মুহুর্তে সেখানে সবাই মেতে আছে সূরার ইন্ডেক্স নিয়ে? কোরান নিয়েই যদি ধাঁধা ধরতে হয়, তাহলে কি ধাঁধার অভাব আছে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমরা কি ধাঁধা ধরছি, নাকি নিজের ছ্যাবলামি প্রকাশ করছি এই মধ্য বয়সে? কোরান নিয়েই একটা ধাঁধা দেই বলতো দেখি, প্রবিত্র কোরানে আরবী দুটা হরফ ذ এবং ش এ মাত্র একবার করে তানবীন চিহ্ন ‘দুইপেশ’ আছে। কোন কোন সূরা এবং আয়াতে?
এতো গেল পোষ্ট এ। এরপর তো কয়দিন পর পর আরেক বিপদ সঙ্কেত শুনতে পাই। অভিযোগ নামা। মেয়েদের কে উত্যক্ত করার পোষ্ট। সেই পোস্ট গুলোর উপরে সিড্র, সাইক্লোন, আয়লা, কাট্রিনা, টাইফুন, আরো যদি কিছু থাকে সেগুলো চলতে থাকে। আমার কথা হচ্ছে, কেন রে ভাই? এই মধ্য বয়সে এসে একটা মেয়ে দেখলেই এমন ছোক ছোক করতে হবে কেন? মান সন্মান বলে কি তোমাদের কিছু নাই ভাই? এই বয়সে এসেই যদি এসব করতে মন চায়, তাহলে স্কুল কলেজে থাকাকালীন কি করেছো তোমরা সেটা তো সহজেই প্রতিপন্ন হচ্ছে। এক বন্ধুর স্ত্রীকে একজন মেসেজ পাঠানোর জন্য কয় মাস আগে তুলকালাম কান্ড হয়ে গেছে। গ্রুপের মেয়ে বন্ধু যারা আছে তাদের কাছ থেকে প্রায়শ অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। এগুলো আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং মানহানিকর। স্থান, কাল পাত্র বলে একটা কথা আছে। সেটা বুঝে, ভদ্রভাবে তো বন্ধু থাকা যায় সারাজীবন। কারো সাথে কথা বলা, বা তাকে কল দেয়া বা তাকে বন্ধু তালিকায় যোগ করার আগে যে তার অনুমতি নিয়ে নেয়া উচতি, সেই স্বাভাবিক বিবেচবা বোধ আমাদের কোথায় গেছে। যা আমাকে চেনেই না, তাকে অ্যাড করার দরকার হলে যে আগে নিজের পরিচয় সবিস্তারের বলা দরকার সেটা আমরা ভুলে যাই কেন? আমাদের ১৯৯৯ সালের মাধ্যমিকের অর্জিত সেই শিক্ষা কোথায় গেছে? নাকি যুগের প্ররিক্রমায় ধুয়ে গেছে ‘সমুদ্র সৈকতে নির্মিত বালির দুর্গ’র মত?
আরেক শ্রেণীর কথা বা বললে কি চলে? এরা ওত পেতে থাকেই শুধু মেয়েদের ছবি আর পোস্টে কমেন্ট করার জন্য। আর সে কি প্রশংসার ফুলঝুরি! আহারে! এখানে উনারা একটা সুবিধা তো পেয়েই যান। যেহেতু গ্রুপের ছেলেদের সিংহভাগের স্ত্রীরাই আমাদের ব্যাচের গ্রুপে থাকে না, তাই তারা অনেকটা বিন্দাস স্টাইলে এসব করতে পারেন! এটা নিছক আমার ধারণা মাত্র। যে যা করছে সেটা তাদের অভিরুচিরই বহিঃপ্রকাশ। নারীপ্রেমী(!) সেইসব বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলি, মেয়েদের অনেক ভাল লাগে তাই না? তাহলে তো মেয়েদের সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল খবরও তোমরা রাখো তাই তো? সেটাই তো হওয়া উচিত। আমি নিচে কয়েকটা মেয়ে(!) দের নাম উল্লেখ করছি। গত একশ বছরের মধ্যেই তাদের অস্তিত্ব ছিল। গুগলে ব্রাউজ না করে বল তো দেখি, এই সমস্ত মেয়ে(!)দের কয় জন কে তোমরা চেন!
Undset Sigrid
Barbara McClintock
Elinor Ostrom
Dorothy Crowfoot Hodkin
Tawakkol Karman
Maria Geoppert Mayer
আমাদের নিজেদের মান সন্মান আমাদের কাছে। নিজের গ্রহন যোগ্যতা আসলে নিজেকেই বাড়াতে হবে। আমি এই কথাগুলো কাউকে উপদেশ দিচ্ছি না। আমি নিজেই নিজেকে বলছি যেন আমি আমার দোষত্রুটিগুলো শুধরে নিতে পারি। থাকুক না আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন কিছু কীর্তি যেগুলো মানুষ মনে রাখবে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে! এমন কিছু করার দরকার আছে কি, যার কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণার সাথে কিংবা অবজ্ঞার সাথে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে?