৭ মে ২০২০

** প্রথম বাবা হওয়া

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর এর ১৭ তারিখ। আমার স্ত্রীর বড় ভাগ্নীর আকদ অনুষ্ঠান হবে। ওর বড় বোনের বাসায় বিয়ের তোড়জোড় চলছে। এমন সময় আমার স্ত্রী ঘরোয়া পরীক্ষার মাধ্যমে জানালো সুসংবাদটা। বেশী নিশ্চিত হবার জন্য ওকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেলাম টেস্ট করানোর জন্য। সন্ধ্যার দিকে রেজাল্ট দিবে। শরীর খারাপ লাগায় ওকে বাসায় নিয়ে চলে আসলাম। বিকালে আমি নিজেই গেলাম ফলাফল আনতে। কাঁপা কাঁপা হাতে যখন খাম খুলে টেস্ট রেজাল্ট দেখার জন্য রিপোর্ট পেপারটা খুললাম তখন বোল্ড হরফে Pregnancy Test: Positive কথাটা দেখার সাথে সাথে মনে হল আমার সারা শরীর দিয়ে বিদ্যুত খেলে গেল। খুশির একটা দমকে আমার মনে হল আমার গলার কাছে কি যেন একটা আটকে আছে। হাত পা কেমন যেন কাঁপছিল। ডায়গন্সটিক সেন্টার থেকে বের হয়েই প্রথমে আমার বোনকে ফোন করে সুসংবাদটা দিলাম।

 

বাসায় এসে দেখি, আব্বু কোথায় যেন বের হবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আব্বুকে খামটা দিয়ে বললাম, এটা দেখো। উনি বললেন, এটা কি? আমি বললাম, নিজেই দেখো, এই বলে আমার ঘরে দ্রুত চলে আসলাম! দেখি নাইমা তার ভাগ্নির বিয়েতে যাবার জন্য হালকা প্রসাধন লাগাচ্ছে। এমন সময় আমার আব্বু আম্মু ও নাঈমা, ও নাঈমা করে প্রায় তারস্বরে চিৎকার করতে করতে আমাদের ঘরে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে Congratulations জানায়।

 

কিন্তু বিধিবাম! নাঈমা চোখে কাজল দিচ্ছিলো, হঠাত মুখ বিকৃত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার যেন কেমন লাগছে। আমি ভাবলাম, এটা তো স্বাভাবিক। এমন হতেই পারে। ও দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর চোখে পানি নিয়ে বের হয়ে এসে আমাকে যেটা ও বললো সেটা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ও বললো, ওর ব্লিডিং শুরু হয়েছে। আমি শুনেও যেন কিছুই বুঝলাম না! যন্ত্রের মত বললাম, কিছু হবে না, চিন্তা করো না। মাথা ফাঁকা হয়ে গেছিল। পজিটিভ রিপোর্ট এনেছি বাসায় আধা ঘন্টাও হয় নাই। আম্মুকে বললাম। আমাকে সাথে সাথে বললো, বাসার কাছে একজন গাইনী ডাক্তার বসেন তার কাছে নিয়ে যেতে। বাসার কাছেই ছিল। ভয়ে ভয়ে দুরু দুরু বুকে নিয়ে গেলাম। ডক্তার দেখে শুনে যা বললেন, তাতে মন ভেঙ্গে গেলেও সৃষ্টিকর্তার অপার করুণা রাশি থেকে মন একটুও হটে নি। উনি বললেন, আপনাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। সব বাচ্চা তো দুনিয়ার মুখ দেখে না। কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে মারাত্মক কড়াকড়ি ভাবে বলে দিলেন, কমপ্লিট বেড রেস্ট। একটুও নড়াচড়া করা যাবে না।

 

আমরা ভয়ে ভয়ে বাসায় ফেরত এসে নাইমাকে শুইয়ে দিলাম। আমার আব্বু শুনে বললো, আমার মন বলছে কিছুই হবে না। টেনশন ফ্রি থাকো। আল্লাহ ভরসা। নাঈমার তো আর ভাগ্নির বিয়েতে যাবার প্রশ্নই আসে না। সেই রাতেই বধূর বেশে নবদম্পতি সায়মা আর আসিফ এসে আমাদের বাসাতেই নাঈমার সাথে দেখা করে যায়।

 

এরপরে এভাবেই চলতে লাগলো এক একটা দিন। নাঈমাকে তার বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হল। আমার তখন কোন চাকরী বাকরী কিছুই ছিল না। আমিও ওকে রোজই দেখতে যেতাম। দিনের বেশীরভাগ সময়ই ওর সাথে থাকতাম। ও সারাক্ষণ খাটে শুয়ে শুয়ে কাঁদত আর আল্লাহকে ডাকতে থাকে। ব্লিডিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা আশায় বুক বাঁধলাম। হয়তো ঠিক হয়ে যাবে সেই ভেবে। এক আত্মীয়ের পরামর্শে নাইমাকে সপ্তাহ খানেক পরে চেকাপের জন্য নিয়ে গেলাম ধানমন্ডি ইবনে সিনা তে ডাঃ রাশিদা খানম ঋতু আপার কাছে। অত্যন্ত যত্নের সাথে পরীক্ষা করলেন। আমাদের বললেন, আগেই আশাহত হবার কিছু নেই। দেখিই না কি হয়। নাঈমার সিম্পটম দেখে জানালো, এই পরিস্থিতিকে বলা হয় “থ্রেটেন্ড অ্যাবর্শন” অর্থাৎ বাচ্চা বের হয়ে আসতে চায়! এটা বিপজ্জনক বটে কিন্তু চেষ্টা করে যেতে হবে। কমপ্লিট বেড রেস্ট। এক সপ্তাহ পরে আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে বললেন। আল্ট্রাসনোগ্রাম করে আমাদের কিছুটা স্বস্তি লাগলো। কার্ডিয়াক অ্যাকটিভিটি অর্থাৎ জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আশায় আশায় বুক বেধে আমার আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। নাঈমার মুক্তি নেই কমপ্লিট বেডরেস্ট থেকে।  এভাবেই চলতে লাগলো।

 

আল্লাহ সে যাত্রায় আমার বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে দিলেন। সে মায়ের পেটে বড় হতে লাগলো। নিয়মিত চেক আপ চলতে লাগলো। ডাক্টার সময় দিয়েছিলেন মে মাসের মাঝের দিকে। শেষের দিকে চেক-আপে ডাক্তার আপা বলে দিয়েছিলেন, প্রেসার নিয়ে আমরা চিন্তিত। নাঈমার ব্লাড প্রেসার একটু উপরের দিকে ছিল। শেষ সময়ে, শেষ চেকাপে ঋতু আপা জানালেন, প্রেসার বেশী! একটা ওষুধ দিচ্ছি, কালকের দুপুরের মধ্যে প্রেসার না কমলে অবশ্যই হসপিটালে চলে আসতে হবে। পরদিন দুপুরে, ৭ই মে ২০১৪, খাবার পরে প্রেসার মেপে দেখলাম প্রেসার উপরের দিকে। আর দেরী করা সমীচীন মনে করলাম না। নিয়ে গেলাম হসপিটাল এ। ধানমন্ডির শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালে। আমার ধারণা ছিল, ওকে হয়ত চেক করে ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু চেক করতে নিয়ে ওরা জানাল প্রেসার বেশী। ডাক্তার এর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। আজকেই অপারেশন করে ফেলতে হবে। নাঈমাকে এক কাপড়ে নিয়ে এসেছিলাম। আমি বন্ড সই দিলাম। বিকালেই হবে অপারেশন। এক এর পর এক আত্মীয় স্বজন যে জানাতে লাগলাম। সবাই বললো আমরা এখনই আসছি। আমার আম্মুকে বলে দিলাম বাচ্চার কাঁথা আর কিছু জামা কাপড় দিয়ে আসতে। ওগুলো আগে থেকেই বানানো ছিল।

 

যথা সময়ে নাঈমাকে ওটিতে নিয়ে গেল আমাদের সামনে দেই। তখন মাগরিবের আজান হয়ে গেল। ওটির বাইরে অনেক আত্মীয় স্বজন উৎকন্ঠার সাথে অপেক্ষা করছে। মাগরিবের আজান হয়ে গেল। আমি বেজমেন্টের মাসজিকে জামাতে নামাজ পড়তে গেলাম। দশ কি পনেরো নিমিট হবে মাত্র। ও.টি’র সামনে এসেই শুনি সবাই আনন্দে হই হল্লা করছে। মেয়ে হয়েছে। এইতো আমরা দেখছি। তোমার আব্বু আজান দিয়েছে। খুব সুন্দর হয়েছে। কি চিৎকার! কি গোলাপি গায়ের রঙ! সবাই একসঙ্গে এসব বলতে লাগলো। আমি যেন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না! আমি বাবা হয়েছি! আমি বাবা হয়েছি! মাথার মধ্যে কেমন যেন ঘুরপাক খাচ্ছিলো কথাগুলো। মুখ শুকনো করে কেমন যেন একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যারা যারা মোবাইলে ছবি তুলেছিল, তারা আমাকে দেখালো। ভিডিও দেখালো। বললো, এইমাত্র নিয়ে গেল। আবার আনবে। আমার মনে একটাই কথা, আহারে আমি তো দেখতে পারলাম না। প্রথম দেখাটাই দেখতে পারলাম না আমার মেয়েটাকে।

 

একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম হতবিহ্বল হয়ে। ওটির দরজা খুলে গেল। ডাঃ রাশিদা আপা নিজেই কোলে একটা তোয়ালের পুটুলি নিয়ে আমাকে দেখে আমার কোলে দিয়ে, ‘ধর এইটা’ বলেই আবার ওটিতে চলে গেলেন। আমি বুঝতেই পারলাম না আমার কোলে কি দিলেন! আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম যে এটাই আমার বাচ্চাটা। আবার সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো। আমা চোখ ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছিলো চশমার ভেতরে! এটাই আমার বাচ্চাটা! কিন্তু আমি তো ওজন টের পাচ্ছিলাম না। ওজন একটু কম ছিল। কিন্তু আল্লাহর কৃপায় বাচ্চা সুস্থ সবল ছিল। আমার দিকে একবার তাকায়, একবার চোখ বন্ধ করে, আবার তাকায়। মেয়ের প্রথম লূকোচুরি বাবার সাথে।

 

এই আমার প্রথম বাবা হওয়া। আমি প্রথম বাবা হলাম। এই পৃথিবীতে আমার আবার নতুন করে জন্ম হল। এবার বাবা হিসেবে আমি জন্ম নিলাম আমার সদ্যভুমিষ্ট মেয়ের সাথে। মেয়ের জন্মদিন আজকে। তাই আজকের স্মতিচারণ আমার মেয়ের জন্মকালীন কিছু কথা নিয়েই।    

 

View shawon1982's Full Portfolio