**শৈশব ও কৈশোর যেভাবে গিয়েছে-২
ইগো Ego শব্দটার সাথে পরিচিত আমি বড় হয়ে ওঠার পর। ভার্সিটি লাইফ থেকে খুব সম্ভবত। ওর ইগো সমস্যা, তার হেন সমস্যা এজন্য মিশতে পারে না, এই জাতীয় কথা শুনতে শুনতে বুঝছিলাম ইগো কি জিনিস। বেশী বেশী ইগো ধারণ করা যে আসলে এক ধরণের অহঙ্কার আর Power Practice এরই নামান্তর সেটা পরে বুঝেছিলাম। সংসারে যারা হর্তাকর্তা তারা চাইলেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের ইগো খাটিয়ে অন্যদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে ফেলতে পারে অনায়াসে। আর তাদের এই আচরণের জন্য অন্যদের মধ্যে কি ইফেক্ট পড়ে সেটা নিয়ে ইগোধারীরা মাথা ব্যথা করে না। আজ শুনুন আমার তেমনই একটা অভিজ্ঞতার কথা।
সেই ১৯৯২ সালের কথা। তখন আমি মাত্র ক্লাস ফোরের ছাত্র। চোখে চশমা তখনো লাগেনি। স্কুল ভ্যানে করে স্কুলে যেতাম অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সাথে। পড়তাম একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। আমার রোল তখন দুই! আমি এই মুহুর্তে রেজাল্ট এর প্যাচাল নিয়ে আসিনি। তবে আমার জীবনে যেহেতু ভাল রেজাল্ট এর টার্গেট ছাড়া আর কিছুই থাকতো না, সেহেতু আমার লেখায় বারবার এই বিরক্তিকর প্রসঙ্গ যদি এসেই যায়, তাহলে আপনারা সেটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশাকরি।
সেই ক্লাস ফোরে যখন পড়ি, ১৯৯২ সালে, তখন আমার মেঝো মামার তৃতীয় মেয়ে, সোনিরা রহমান, যাকে আমরা সবসময় তার ডাক নামে সিম্মি আপু বলে ডাকি, তার বিয়ের অনুষ্ঠান। আমার মামাবাড়ী খুলনা দৌলতপুর হলেও সিম্মি আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ঢাকার শ্যামলীতে, আমার বড় খালার বাসায়। আমার ছোট খালা এই অনুষ্ঠানের সার্বিক ত্তত্বাবধান তথা ম্যানেজমেন্টে ছিলেন। তখন তো টি&টি ফোনের যুগ। ফোনে ফোনে আলাপ হত শুনতাম! সিম্মি আপুর বিয়ে! সেই সময়ে ক্লাস ফোর পড়ুয়া একটা ছেলের কারছে তার আপন মামাতো বোনের বিয়ে তো অনেক বড় একটা আনন্দের ব্যাপার। কিন্তু আমার জন্য আনন্দের সুযোগ কই? প্রথম দিকে আমার বাবা এসব বিষয়ে শুনেও না শোনার ভান করে গেছেন। কিন্তু যখনই বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় কাছিয়ে এল, উনি উনার স্বরুপে আবির্ভুত হলেন। উনি উনার ট্রেডমার্ক এক রাজ্যের ইগো নিয়ে হাজির হলেন। সেই ক্লাস ফোরে ইগো কি জিনিস আমার জানা ছিল না।
আশির দশকে, যখন আমার জন্ম হয়েছে কি হয় নাই, তখন আমার এই মেঝো মামার সাথে আমার বাবার কোন এক বিষয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছিল বলে শুনেছি। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ আমার জানা নেই। তবে কোন বিষয়ে দ্বন্দ্ব ছিল এটা নিশ্চিত। এখন সেই মামারই মেয়ের বিয়ে! আমার বাবা সেই কথা কে সামনে নিয়ে আসলেন ফলাও করে। যেহেতু আমার মামার সাথে তার দ্বন্দ্ব সেহেতু তিনি কোন ভাবেই এই বিয়েতে যাবেন না এবং ছেলে মেয়েকেও যেতে দেবে না। উল্লেখ্য যে আমার বাবার তিন সন্তানের মধ্যে আমি সবার বড় আর আমার একমাত্র বোনের বয়স ১৯৯২ সালে তখনও এক বছর হয়নি! আর আমার বাবার যে আরেকটা ছেলে আছে, তার বয়স তখন কত আড়াই বা তিন বছর হবে। ওরা তখন নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য শিশু। ওরা না এসবের কিছু বোঝে আর না বোঝার কথা! সব বুঝি তো আমি! কারণ তখন আমার বয়স ৯ বছর কয়েক মাস! দশ ও পূর্ণ হয় নাই।
এই বিয়েকে কেন্দ্র করে বাসায় আমার বাবা মায়ের মধ্যে তুলকালাম কান্ড, প্রচন্ড ঝগড়া বেধে গেল বাবা মায়ের মধ্যে। আমার মায়ের যেহেতু ভাতিজি, তিনি তো বয়েতে যাবেনই। ছোটো দুইটাই দুধ খাওয়া। কাজেই ওদের থাকার তো প্রশ্ন আসে না! আর আমি? আমি ত, ভাত খাই। সাথে ঘাস, কাঁঠাল পাতা এগুলাও যদি দেয়া হত, তাহলে সেগুলাও খেতাম। আমি ছিলাম, বা আমাকে বানানো হচ্ছিল একটা কুশপুত্তলিকা! মেধাবী কুশপুত্তলিকা, যে তার পিতা মাতার ইচ্ছামত, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তাদের ফরমায়েশ মত রেজাল্ট নিয়ে আসতে নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে দিবে! হ্যা এটাই হলাম আমি! ঝগড়া করে আমার মা তার ছোট দুই সন্তান নিয়ে চলে গেলেন শ্যামলীতে সিম্মি আপুর বিয়েতে যোগদান করতে। যাওয়া হল না আমার। আমার মহান পিতা তার ইগো কে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মামার মুখে ঝামা ঘষা দিতে, নিজে দাওয়াত প্রত্যাখান করে আমাকেও যেতে দিলেন না। সেদিন আমার মনের অবস্থা কি ছিল, কান্নাকাটি করেছিলাম কিনা, আমার ঠিক মনে পড়ে না। আসলেই মনে নেই, মনে থাকলে অকপটে সবই বলে দিতাম।
একা একা ঘরে রইলাম। ক্ষণে ক্ষণে আমার বাবার মুখাগ্নিবর্ষণ ও চলতে থাকলো। আমি সময় কাটিয়েছিলাম কিভাবে মনে পড়ে না। আমাদের বাসায় তখন আমার নোয়া ফুফুর এক মেয়ে হোসনে আপাও ছিল। উনি তখন ক্লাস টেনে পড়তেন। আমাদের বাসা থেকে পড়াশোনা করতেন। হোসনে আপার সাথে গল্পগুজব করতাম। সময়ে সময়ে এই আপাই আমাকে খাবার দাবার দিত। রান্নাও করতো। যেদিন সিম্মি আপুর বিয়ে, সেদিন সন্ধ্যার সময় আব্বু ঘরে এসে বললেন, রেডী হও। নিজের ভাগ্নি হোসনেকেও রেডী হতে বললেন। বললাম কেন? মনে মনে আশা ছিল, তাহলে কি আমাকে সিম্মি আপুর বিয়েতে নিয়ে যাবেন? উনি গম্ভীর মুখে বললেন, যা বলছি কর। আমি আর কি, রেডী হতে কি লাগে? আমি আর হোসনে আপা পোষাক পাল্টে নিলাম। উনি আমাদের নিয়ে বের হলেন।
সন্ধ্যার সময় উনি আমাদের নিয়ে কোন একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে গেলেন। এ যুগের কোন ছেলে মেয়ের কাছহে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট কোন আহামরি কিছু না হলেও সেও ১৯৯২ সালে আমাদের কাছে অনেক বড় কিছুই ছিল। বিশেষ দিন ব্যতিরেকে কেউ সেসময় চাইনিজ খাওয়ার কথা চিন্তাও করতোনা। চাইনিজে যাওয়া তখন একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল। আর একটা কুশপুত্তলিকার জন্য অনেক আনন্দ তো বটেই। উনি উনার মর্জিমাফিক অর্ডার ডিলেন সাধারণত যা খাওয়া হয় তাই। খাবার আসলে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। থাই স্যুপ চামচে করে একটু একটূ খাচ্ছিলাম। তখন আমার বাবা বার দুয়েক গলা খাকারি দিলেন। এটা উনার একটা স্টাইল। কোন বিশেষ কথা অবতারণা করার আগে উনি এমন গলা খারাকি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেবারও তাই করলেন। উনার গলা খাকারিতে আমাদের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, আর উনি এই সুযোগে দুই চামচ স্যুপ খেয়ে কথা গুছিয়ে ফেললেন। তোমাদের আজ এখানে কেন এনেছি জান? আমি বললাম, না জানিনা। তখন উনি বললেন, তোমার মামাতো বোনের বিয়েতে যেতে পারলে না, ভাল ভাল খাবার খেতে পারলে না, সেজন্য যেন মন খারাপ না কর। একথা বলে উনি আমাকে বললেন, খাও! ফ্রায়েড রাইস খাও। আমি চাবি দেয়া পুতুলের মত ফ্রায়েড রাইস তুলে নিলাম। বাকী খাবার যেভাবে খেতে হয় খেয়ে উনার সাথে বাসায় চলে আসলাম। বিয়ের Substitute এ চাইনিজ খেয়ে আসলাম।
সিম্মি আপু, এখন দুই ছেলেমেয়ের মা। ওর ছেলে ভার্সিটির পাঠ তো প্রায় শেষ করেই ফেলেছে। কোনদিন এই কথাগুলা তাকে জানানো হয় নি। আমার এই লেখা পড়বে কিনা তাও জানি না। লিখে ফেললাম। যদি পড়ে তো পড়ুক। জানবে কি হয়েছিল আমার সাথে ওর বিয়ের দিনে। কেন আমার যাওয়া হল না।