নব প্রিয়তমেষু,
অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলাম না। সারারাত প্রায় নির্ঘুমই কাটিয়েছি। সকালেও যখন ঘুম এলো না, তখন মনে হল তোমাকে লিখতে বসি কিছু একটা। আমার কোন লেখাই তো গোছান নয় ঠিকমতো। অগত্যা তোমাকেই লিখি কারণ মনে ক্ষীণ আশা আছে, তুমি হয়ত ফেলে দেবে না আমার এই দুর্বল লেখাগুলো। আমার লেখনীর হাজার ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু আমার রাতগুলো কেন নির্ঘুম কাটে, সেগুলোর কারণ কিন্তু দোদুল্যমান নয়। ললাটে আঁকা তিলক, অনুভুতির সাথে সাথে কিঞ্চিত নড়চড় হলেও হতে পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক; কিন্তু আমার মনের বাস্তব অবস্থা? একদম স্থির হয়ত! আমার কাছে তেমনই মনে হয় সবসময়। কখনও কখনো যে পরিবর্তন আসে, সেটা কিছু কল্পনা আর কিছু বাস্তবতার মিশেলে! এতক্ষণ যা বলেছি, এসবের কোন মানে নেই। এসবের কোন মানে খুঁজতে যেও না। হয়ত তোমার কাছে নির্ঘুম রাতের প্রলাপ বলেই মনে হবে। যা খুশি ভেবে নিও, তবুও আমার ভাবনাগুলোর আড়ালে আমার নিজেকেই খুঁজে নেয়ার প্রয়াসটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করে দিও না।
আমার জানালার কাছেই কোথাও একটা পাখির নীড়ের অস্তিত্ত্ব টের পাচ্ছি আজ কিছুদিন থেকে। কোথায় বাসা করেছে, কি পাখি, কিছুই জানি না। সকাল বেলা পাখি ছানাগুলোর কিচিরমিচির যখন শুনি, তখন মনের সেই স্থিরতার ভেতরেই জীবনের আভাস পাই কিছুটা। মনে হয় যেন একটু খানিক প্রানের স্পন্দন! পাখির নীড়ের কথা ভাবছিলাম যখন, তখন মনে পড়ে গেল সেই বিকেলের কথা। তুমি আর আমি যখন বসেছিলাম শাপলা পুকুরের পাশে। ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে তুমি জানতে চেয়েছিলে, পাখির বাসার মত চোখ হয় কিনা বলতো! তোমার আকস্মিক প্রশ্নে আমি কিছুক্ষণ সম্মোহিতের মত তাকিয়ে ছিলাম। আমি প্রশ্ন নয়, বরং সম্মোহিতের মত তোমার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। পাখির নীড়ের মত চোখ? সেটা কি আমার সামনেই নয়? মনে মনে বলেছিলাম!
আমাকে নিরুত্তর দেখে, তুমি বলেছিলে, কেন তুমি কি বনলতা সেন পড় নি? চকিতে বুঝে গেলাম, জীবনানন্দ দাসের সেই অনবদ্য সৃষ্টি বনলতা সেন কবিতার কথা বলছো। যেখানে বনলতা সেনের চোখকে পাখির নীড়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কবিতাটা আমি আগেও অনেকবার পড়েছি, সেদিনের মত সেই ‘পাখির নীড়ে’ কখনও তো আঁটকে যাই নি! সেদিন তবে কি হয়েছিল? পাখির নীড়ের মত চোখ কিভাবে হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর আমার এখনও জানা নেই নবনীতা। আমি শুধু দেখেছিলাম তোমার চোখ, সেখানে শুধু পাখির নীড়ই নয় বরং ছিল সহস্র পদ্মফোঁটা টলটলে এক অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির কোন বাস্তব ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। লেখনীতেও নেই, ভাষাতেও নেই, আছে শুধু অজানা অচেনা এক না পাওয়া অনুভুতির রিক্ত দাম্ভিকতায়!
সেই বিকেলগুলো কি আবার কখনো আসবে? আমরা কি চাইলেই আবার তাদের ফিরিয়ে আনতে পারবো! চোখ বন্ধ করে, বহুবার জানতে চেয়েছি নিজের মনের কাছে। কোথায় যেন শুনেছিলাম, নিজের মন নাকি নিজেকে কখনও মিথ্যে বলতে পারে না। আমি সেই উত্তর শোনার প্রতীক্ষায় আছি। প্রশ্ন করে করে এখনও আমি অক্লান্ত এক পথিক! অজানার পথে যেতে যেতে হয়ত কোনদিন শুনতে পাবো আবার উত্তর না পাওয়া সেই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি। আমি দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে যেতে থাকি আমার জীবন প্রান্তে মুহুর্মুহু ধ্বনিত হতে থাকা আরো কিছু অনাগত নির্ঘুম রাতের দিকে।
ইতি,
নির্ঘুম রাতের পথিক।