নবনীতা (নদীর মৃত্যু)

তোমাকে প্রিয়তমেষু,

 

তুমি কখনও নদীর থেমে যাওয়া দেখেছো? ‘নদী’ মানেই মনে হয় যেন গতি। শুধু চলতে থাকা। উৎস থেকে নেমে এসে একে বেকে চলতে চলতে সেই যেন সাগরের সাথে মিশে যাওয়া। কিন্তু নদীর কি কখনও থেমে যেতে ইচ্ছে করে না? কখনও চায় না সে স্থবিরতার মৌনতাকে উপভোগ করতে? নদী মানেই কি শুধু বয়ে চলা? নদীর থেমে যাওয়া আমি দেখেছি। আমি দেখেছি কিভাবে খরস্রোতা নদী মরে গেছে। ঠিক যেন দূরারোগ্য কোন রোগে ভুগতে ভুগতে তা একসময় মৃত্যু গহ্বরে পতিত হয়েছে। তেমনি নদীটাও মরে গেছে নবনীতা। একদম শুকিয়ে গেছে চিরতরে। সেখানে এখন আর কোন স্রোত আসে না। রঙ পরিবর্তন হয়ে গেছে। নদীর তীরে এখন আগাছার আবাস। নাম না জানা কতগুলো কীটের আস্ফালন সেখানে দেখা যায় শুধু। দুই এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেলে, গাল থেকে মুছে না ফেললে, গালের উপরে যেমন দুটো দাগ দেখা যায়, তেমন নদীর পানির শুকিয়ে যাওয়ায় মাটির উপরে তেমন কিছুর আভাস শুধু পাওয়া যায়। যৎকিঞ্চিত যাও একটু গোড়ালী সমান পানি জমে আছে এখানে সেখানে, সেটুকুও তৃষিতের মত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে আরো আরো একটু উত্তাপের প্রত্যাশায়। শেষ সম্বলটুকুও কখন শুকিয়ে যাবে, সেই প্রতীক্ষায় থাকে এক নদী।

 

এভাবেই একটা নদীর মৃত্যু হতে থাকে। কেউ হয়ত কখনও জানবে, মনে করবে, এখানে অমুক নামের একটা নদী ছিল। এরপর কেউ মনে রাখবে না।  মানুষের স্মৃতি থেকেও মুছে যাবে একেবারেই। এমনটা হওয়া কিন্তু অবধারিত। নদী যেমন পারেনি বহমান থাকতে, তেমনি হয়ত তুমি আমিও বিলীন হয়ে যাব কালের গর্ভে। শুধু ক্ষণিকের অতিথি হয়ে আমাদের আসা। কেউ মনে রাখে কেউ মনে রাখে না। যাদের মনে ছিল তারাও মুছেই ফেলবে মন থেকে। এটাই কি নদীর মত বেঁচে থাকা? আমি জানি না, থেমে থাকার নাম জীবন কিনা? তবে থেমে থাকাও জীবনের একটা অংশ।

 

তোমাকে নিয়ে আমি আবার যেতে চেয়েছিলাম সেই নদীটার পাড়ে। সেই সুযোগ আর পেলাম কই? এখন তো চাইলেও আর তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো না। একটা কারণ ত তুমি জানই, নদীটা এখন মৃত। আর অন্য কারণটা? ওটা উহ্য থাক। সেটা না হয় শুধু তোমার আর আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।

 

প্রথম যেবার তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম নদীটার পাড়ে, তখন সূর্যের তেজ কিছুটা কমে এসেছিল। বিকেলের শুরু। নদীর পাড়ে তেমন কোন মানুষের আনাগোনা ছিল না। তুমি আর আমি কিছুটা সময় পেয়েছিলাম আমাদের মত, একান্তই আমাদের মত করে। সেই ভাললাগা অনুভুতিগুলো এখনও আমার মধ্যে কাজ করে। লেখনি দিয়ে কি আর তার সবটা আসে? কিছুই আসে না। নদীটার পাড় ধরে তুমি আমি হেঁটে চলে গিয়েছিলাম বেশ খানিকটা পথ। নদীতে তখন সামান্য স্রোত ছিল বৈকি! তুমি বায়না ধরেছিলে, নৌকায় চড়বে। কিন্তু কি করবো, আশেপাশে যে তখন একটা নৌকাও ছিল না। আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিলে, পরের বার এলে তোমাকে নৌকা চড়াতেই হবে। আমি কিছুমাত্র কালক্ষেপণ না করেই কথা দিয়েছিলাম তোমাকে। আমি আমার কথা রেখেছিলাম নবনীতা। এরপরেও আমি বার কয়েক গিয়েছি নদীটার পাড়ে। কিন্তু তুমি ছিলেনা আমার সাথে। আমার সাথে কেউই ছিল না। শুধু আমার দুর্বোধ্য একাকীত্বটুকু সাথে করে আমি একাই ছিলাম।

 

নদীটার ওপাশের ধানক্ষেতগুলোর কথা মনে আছে তোমার? সূর্য যখন ডুবে যাবার উপক্রম হয়েছিল, তুমি বায়না ধরেছিলে ধানক্ষেতের ওপাশে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখবে। আমি বলেছিলাম, ধানক্ষেত কি সমুদ্র নাকি? সূর্য ডোবা দেখতে তো মানুষ সমুদ্রসৈকতে যায়। এখানে কি? তুমি কিছুটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে বলেছিলে, ধানক্ষেতের উপরে বয়ে যাওয়া বাতাসের আনাগোনা, সবুজ পাতায় ওঠা এই উচ্ছ্বাস দেখেও তোমার মনে হল না এটাও একটা সমূদ্র হতে পারে? তোমার কল্পনা শক্তির কাছে সেদিন আমাকে হার মানতে হয়েছিল নবনীতা। আমি আজও ভেবে পাইনি, ধানক্ষেত যার কাছে সমুদ্রের মত মনে হতে পারে, সে কি কখনও আমার এই চিঠি পড়ে দেখবে?

 

ধানক্ষেতের ওপাশ থেকে উড়ে আসা বাতাসে তোমার মাথার সামনের একগোছা চুল যখন মুখের সামনে চলে আসছিল, তখন কথা বলার মাঝে, আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিয়ে আড়চোখে যখন আমার দিয়ে তাকাচ্ছিলে আর হাসছিলে, তখন আমার মনে হয়েছিল, শুধু এই ক্ষণটুকু আমাকে দেয়ার জন্য আমি আরো হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারবো ক্লান্তিহীন ভাবে। তুমি তখন আরো কিছু  একটা বলেছিলে আমাকে, জানো, তার কোন কিছুই আমার মনে নেই। থাকবে কি করে, আমি যে ভাল করে শুনতেই পাই নি। চোখ যখন মনের উপরে বিস্তার লাভ করেই ফেলেছে, তখন সেখানে শ্রবনের কি ক্ষমতা নিজের আধিপত্য বিস্তার করে? অবশ্য আমি তোমার কাছে ধরা পড়ে গেছিলাম তার কিছুটা পরেই। তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, আচ্ছা বলতো, আমি এতক্ষণ ধরে কি বলেছি তোমাকে? আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কোন উত্তর দিতে পারিনি। পারতাম ও না। ইচ্ছে করে হেরে যাবার মধ্যে যে কি এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি কাজ করে নবনীতা, সেটা কাউকে আমি বোঝাতে পারি না। আমি ইচ্ছে করেই হেরে যেতাম তোমার কাছে মাঝে মাঝে। তুমি বুঝতে ঠিকই, কিন্তু আমাকে দিয়ে গেছ প্রচ্ছন্ন আশকারা।

 

মাথার পাশের জানালাটা বন্ধ ছিল কয়েকদিন ধরে। বৃষ্টির ছাঁট আসে বলে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি জানালাটা কোন একসময় বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কি অদ্ভুত তাই না? আগে যেখানে বৃষ্টি আসলে দরজা খুলে বাইরে চলে যেতাম জ্বর সর্দির কোন ভয় না করেই, আজ সেখানে জানলা কবে বন্ধ করেছিলাম সেটাও মনে পড়ছে না। সময়ের সাথে সাথে মনে হয় মনের চিন্তা ধারাও স্থবির হয়ে গেছে। দিন তারিখের সাথে সাথে সবকিছুই হিসেবের গন্ডির বাইরে চলে গেছে। আজ যখন জানালাটা খুলতে চাইলাম, তখন কিছুটা মরচেপড়া কলকব্জাগুলো আর্তনাদের সুরে প্রতিবাদ করে উঠলো। ঠেলেঠুলে তাও কোন রকম জানালা খুললাম। এমন কিছুই ছিল না জানালার বাইরে যা চোখে নতুন লাগে। শুধু নতুন লাগে সময়টা। কারো জন্য কালক্ষেপণ করেনি। রাতের আকাশের দিকে তাকালাম। গুটিকয়েক তারা জ্বলে আছে। কোন মিল নেই জানি, তবুও তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেন জানি আমার সেই নদীটার কথা মনে পড়ে গেল। কোন সামঞ্জস্য নেই জানি, তবুও মনে পড়ে গেল সেই ধানক্ষেত, সেই সূর্যডুবে যাওয়ার মুহুর্ত! একে একে সব একটু একটু করে মনে পড়তে থাকে। তোমারও কি মনে পড়ে এসবের কিয়দংশ?  

 

ইতি,

বহুদিন পরে খোলা জানালায় তাকানো

আমি

 

পুনশ্চঃ জিজ্ঞাসা করা হয়নি, কেমন আছ! কেমন আছ তুমি? নদীটার কথা কি মনে পড়ে তোমার এখনও?  

Author's Notes/Comments: 

৩০ এপ্রিল ২০২০

View shawon1982's Full Portfolio