১০ মার্চ ২০২০

একটা সময় ছিল, সেই ছোট বেলার কথা আর কি, যখন স্কুল ছুটি দিত, কি খুশিটাই না হতাম! মনে মনে কত কিছুর প্ল্যান করতাম। এই করবো, সেই করবো, যদিও আদতে তার তেমন কিছুই করা হত না। ছুটি গুলো কিভাবে কিভাবে যেন কেটে যেত। কিন্তু তাতে কি, নানা রকম পরিকল্পনাতেই সময়গুলো ভাল কেটে যেত। আমরা যখন স্কুলে পড়ি, তখন হরতাল, ধর্মঘট এসবের কথা শুনলেই মনে হত স্কুল ছুটি! এতে যে আসলে কি হয় তখন সেটা বোঝার বয়স কথায়? হরতাল বা দেশে কোন জরুরী অবস্থা মানেই হল স্কুল ছুটি। আমাদের আর পায় কে? স্কুলে যেতে হবে না এটা চিন্তা করতেই ভাল লাগতো। আমার বাসা থেকে আমার স্কুল কিন্তু অনেক দূরের পথ ছিল। কোথায় মিরপুর আর কোথায় সেই প্রায় নিউ মার্কেট! যা হোক, স্কুলের গন্ডি তো পার হয়ে এসেছি সেই কবেই! ২১ বছর হয়ে গেল প্রায়। কিন্তু ছুটির কথা চিন্তা করলে মনে মনে এখনও তেমনই ভাল লাগাটা কাজ করে যদিও বহিঃপ্রকাশের ধরণটা পালটে গেছে।

 

যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হল। সেই ১৯৯৮ সালে। সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ায় ঢাকা নিরাপদ ছিল। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমাদের স্কুল বন্ধ ছিল অনেক দিন। যেহেতু সরকারী স্কুল ছিল, তাই ওখান থেকে ত্রাণ সামগ্রী নেয়ার ব্যবস্থা করা হত সরকারী উদ্যোগে। তখন তো আর এত বুঝতাম না। বাসা থেকে পড়ালেখার জন্য লাগাতার চাপ দেয়া হত, কারণ তার কয়েক মাস পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। তখন একটা হুজুগ উঠলো, যেহেতু সদ্য বন্যা হয়ে গেল এত বড় মাপের, সেহেতু এবার বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ‘রচনা’ আসবে ‘বাংলাদেশের বন্যা’ অথবা ‘বন্যা সমস্যা এবং তার প্রতিকার’। অনেকে এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে স্যার ম্যাডামদের বিখ্যাত সব রচনা সংগ্রহ করে মুখস্ত করতে লাগলো রচনা।

 

আমাদের সেই সময়টাতে, আমাদের দিয়ে সব কিছু মুখস্ত করানো হত। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কে কত রচনা মুখস্ত করতে পারে। কার রচনায় পয়েন্ট কত বেশী, কে কত পৃষ্টা লিখতে পারে! যে যত পৃষ্ঠা, পয়েন্ট, কোটেশন, টেবিল এসব ব্যবহার করতে পারবে, তার রচনা তত বেশী ভারী। রচনার জন্য নাম্বার বরাদ্দ থাকতো ২০। বাংলা দ্বিতীয় মানেই হল ‘ব্যকরণ’ আর ‘রচনা’। দুই ঘন্টার পরীক্ষা হলে কমপক্ষে এক ঘন্টা বরাদ্দ রাখতাম শুধু রচনা লেখার জন্যই।

 

আমার বাসার ঠিক পাশেই আমার এক প্রতিবেশী শান্ত’র (ছদ্মনাম) বাসা। আমাদের বাসার বারান্দা থেকে ওদের বারান্দা দেখা যেত। আমরা দুইজনই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী।

একদিন বারান্দায় ওর সাথে দেখা। তখন আমাকে বললো, তুমি কি ‘বাংলাদেশের বন্যা’ রচনাটা পড়ছো? এবার কিন্তু এসে যেতে পারে। তখন আমি বললাম, না আমি এটা এখনও পড়িনি তবে একটু হালকা পাতলা পড়ে রাখবো। যদি কাজে লাগে। তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো আমি কোনটা জোর দিয়ে পড়ছি? আমি বললাম, ‘কম্পিউটার’। শান্ত বললো ও কম্পিউটার রচনা পড়ছে না। পরে কি হল জানেন? যেদিন বাংলা ২য় পত্র পরীক্ষা হচ্ছে, তখন আমাদের খাতা দেয়া হয়ে গেছে। প্রশ্ন দেখনো দেয়া হয় নাই। এক ম্যাডাম হাতে ধরে প্রশ্ন উলটে পালটে দেখছেন আর ঘন্টা পড়ার অপেক্ষা করছেন। আমার আর তর সইছে না। বললাম, ম্যাডাম ‘বাংলাদেশের বন্যা’ রচনাটা কি এসেছে? উনি মুচকি হেসে না বললেন। আমি আরেকটু সাহস করে বললাম, ‘কম্পিউটার’? উনি সম্মতি জানালেন! সাথে সাথে ঘণ্টা পড়ে গেল। আমি ২য় সারিতে বসেছিলাম। প্রশ্ন হাতে পেয়ে সবার আগে রচনা সেকশনে গিয়ে দেখি বন্যা রচনার খবর নাই, কিন্তু প্রথম রচনাটাই হল ‘কম্পিউটারঃ বিজ্ঞানের বিস্ময়’। ধড়ে পানি পেলাম। আহ! রচনা কমন পড়েছে। আর চিন্তা কি? শান্তর হথা মনে হল। আহা বেচারা! একটু উল্লেখ করে রাখি, আমি কিন্তু মাধ্যমিকে বাংলাতে ‘লেটার’ পেয়েছিলাম। প্রথম পত্রে ৭৮ আর দ্বিতীয় পত্রে ৮২ পেয়ে বাংলায় লেটার ছিল!

 

কি কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। ২০০৪ এ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ২য় বর্ষে পড়ি তখন দ্বিতীয় সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষার সময় আবার দেশে ভয়াবহ বন্যা হল। সেবারও আমাদের পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে দুইবার। সেবারও ঢাকা রক্ষা পেয়েছিল। আমদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাফেটেরিয়াতে দেখেছিলাম, রুটি বানিয়ে বানিয়ে বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করছে। তখন ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠানেই এমনটা করতে দেখেছি। প্রধানমন্ত্রী নিয়ে একটা টেবিলে রুটি বানিয়ে দেখিয়েছেন। সেবার ফাইনাল পরীক্ষা দিতে দিতে সেপ্টেম্বর মাস হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার সেই সেমিস্টারের ফলাফলই সবচেয়ে ভাল হয়েছিল।

 

আর এখন, ‘করোনা’ ভাইরাসের জন্য বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য। অনেক ফ্লাইট বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশেও কয়েকজনের মধ্যে এই ভাইরাসের খবর পাওয়া গেছে। আমাদের মেইলেও দেখলাম, জরুরী অবস্থা হয়ে গেলে যদি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয় তাহলে তার কিছু নির্দেশনা। কি করতে হবে না হবে সেসব! এখন আর এগুলা শুনে মোটেই আনন্দ হচ্ছে না। বরং অনাগত দিনের কথা চিন্তা করে কিছুটা দুশ্চিন্তাই হচ্ছে। কারণ সময় পার হয়ে গেছে। এখন আমি বাস্তবতা অনেকটাই বুঝি। তখন ছাত্র ছিলাম আর এখন আমি শিক্ষক। এখন আমি জানি, একটা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তার পরিণতি ভাল হয় না। অনেক ভুগতে হয় সংস্লিষ্ট সকলকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে সনির্বন্ধ প্রার্থনা, আমাদের এই করুণ পরিণতি থেকে উনি যেন সকলকে রক্ষা করেণ।

View shawon1982's Full Portfolio