খাট

শোবার ঘরে শিমুল আর নাবিলা ওদের পাঁচ মাসের মেয়েটাকে নিয়ে খেলছিল। মেয়েটাও হয়েছে ভারী দুষ্টু। প্রথম দেখাতেই সবার নজর কেড়ে নিতে পারে ওদের পাঁচ মাসের মেয়েটা, জেরিন। শিমুল জেরিন কে পেটের উপরে নিয়ে খেলা করছিল। জেরিন মুখ দিয়ে থুতু ছিটানো নতুন শিখেছে। মুখ সরু করে বুজবুজ করে শব্দ করছে আর ওর বাবার মুখের উপর থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছে। ভীষণ মজা পাচ্ছে মেয়েটা। নাবিলা পাশে শুয়ে শুয়ে মোবাইলের মেসেঞ্জারে আসা মেসেজগুলো পড়ছিলো আর মাঝে মাঝে শিমুলের সাথে টুকটাক কথা বলছিল। শিমুল ওর মেয়েটার পেটে নাক ঘষে দিচ্ছিলো আর এতে সুড়সুড়ি লেগে মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠছিল। হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর কন্ঠের কাশির শব্দ শুনে শিমুল মেয়েকে তার আর নাবিলার মাঝে শুইয়ে দিল। শিমুলের বাবা হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব, ঘরের দরজায় দাঁড়ানো। ততোক্ষণে নাবিলা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, ‘বাবা ঘরে আসেন। কিছু বলবেন?’

‘হুম! তোমাদের সাথে একটু কথা ছিল’। বলেই হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব একটু থামলেন। উনার কথা বলার ধরণ এটাই। কোন কথা বলার আগে একটু বিশেষ কায়দায় উপস্থাপনা করেন। সেটা ঘরে নিজের ছেলে মেয়ের সাথে হলেও। নাবিলা প্রথম প্রথম একটু হতচকিত হলেও বিয়ের এই পাঁচ বছরের মধ্যে শ্বশুর সাহেবের কথা বলার ধরণ বুঝে ফেলেছেন। শিমুল যথারীতি চুপ করে খাটে বসে রইলো। মনে মনে প্রস্তুনি নিচ্ছে বাবার কথা শোনার।

‘জ্বী বাবা বলেন’। নাবিলা ম্রিয়মান কন্ঠে শ্বশুর কে বললো। জেরিন ততক্ষনে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল মুখে পুরে দিয়ে একমনে চুষে চলেছে। চোখ অল্প অল্প খোলা। ঘুমের আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে বাচ্চাটা।

‘আসলে, কিভাবে যে কথাটা তোমাদের বলি, আবার না বলেও পারছিনা’। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব আবার থামলেন। নাবিলা স্বামীর মুখের দিকে খেয়াল করে দেখলো তার কোন ভাবান্তর নেই। ভাবলেশহীন মুখে আরেকদিকে তাকিয়ে আছে। উনি আবার বলা শুরু করলেন, ‘জানোই তো তোমরা! কি অবস্থায় সুমির বিয়ে দিলাম। হাত একেবারেই খালি। আজ নাকি সাহেদ আসবে বাসায়। জামাই মানুষ, আমাদের তো বলা উচিত ওকে বাসায় থাকতে বলা’।

‘জ্বী বাবা। অবশ্যই বলা উচিত যেন সাহেদ থাকে। ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে। আমি আম্মাকেও বলেছি কথাটা’। নাবিলা কথাগুলো বলে শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে। শিমুল তার চোখ থেকে চশমা খুলে নাড়াচাড়া করছে। এমন ভাব যেন বাপের কথা শুনছে না।

‘সুমির ঘরের খাট টা তো তোমরা দেখেছো। জামাই মানুষ যদি রাখি বাসায়, ঐ খাটে কিভাবে শুইতে দেই বল? আমার হাতের এমন অবস্থা, আমি যে আজকে কালকের মধ্যে একটা ভালও দেখে খাট কিনে আনবো, সেটাও সম্ভব না। কি করা যায় বলতো? তোমরা আমাকে একটু মাশোয়ারা দাও’। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব কথাগুলো বলে নাবিলার দিকে তাকালেন। এটা উনার কথা বলার একটা বিশেষ ধরণ। সরাসরি কিছু না বলে, উনি পরামর্শ বা এর আরবী শব্দ মাশোয়ারা কথাটা উচ্চারণ করেন।

‘আমাদের খাটটা নিয়ে দাও’। এবার শিমুল খুব সংক্ষেপে তার বাবাকে বলে। শুনে হাজী জহিরুদ্দিন সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মনে হল, উনি ভীষণ একটা দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেলেন। বললেন, ‘তোমাদের অসুবিধা হবে না? বাচ্চা নিয়ে কিভাবে থাকবা তোমরা?’

শিমুল বললো, ‘আমরা ম্যানেজ করে নিব। সুমির ঘরে যেটা আছে সেটা হলে আমাদের হয়ে যাবে। আমি না হয় নীচে শুবো কয়দিন’।

এটুকু শুনে হাজী সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। বলতে লাগলেন, ‘তোমাদের সিদ্ধান্ত শুনে আমি খুব খুশী হলাম। পরে একটা খাট কিনে ফেললে, তোমরা আবার তোমাদের খাট নিয়ে নিও’। একথা বলে উনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। শিমুল বা নাবিলা কেউ কিছু বললো না। র কিছুক্ষণের মধ্যেই সুমির ঘরের ছোট চৌকিটা শিমুলের ঘরে, আর শিমুলের খাটটা সুমির ঘরে চলে গেল। সুমি শিমুলের একমাত্র বোন। সদ্য বিয়ে হয়েছে ওর।

 

সুমির ঘরে খাটটা আসার পরে শিমুলের ছোট্ট ঘরটার ভেতর বেশ একটু ফাঁকা জায়গা বের হয়ে গেল। কারণ শিমুলের খাটটা ছিল বড়, আর ঘরটা ছিল অনেক ছোট! হাঁটা চলার তেমন জায়গা ছিল না বললেই চলে। তার উপর মেয়েটাকে নিয়ে ওদের তিনজনের শুতে হত। এখন ছোট খাট আসাতে ঘরে জায়গা একটু পাওয়া গেলেও তিনজনের আর শোবার উপার রইলো না। শিমুল নাবিলাকে বললো, তুমি জেরিনকে নিয়ে খাটে শুইও। আমি না হয় নিচে ফোম বিছায়ে শোব। আমার অসুবিধা নাই। নাবিলা নিরুত্তর হয়ে তার বেকার স্বামীর সিদ্ধান্ত মেনে নিল। যে স্বামীর উপার্জন থাকে না, সেই স্ত্রীর মতামতের আর কতখানি গুরুত্ব থাকে?

 

এর মধ্যে ছয় বছর পার হয়ে গেছে। পুরনো বাসা ছেড়ে শিমুলরা পাশের এলাকায় ওর বাবারই অন্য একটা ফ্ল্যাট এ ছিল দেড়টা বছর। এখন শিমুলের ছোটখাট একটা চাকরী আছে। এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষকের চাকরী পেয়েছে। এখন মেয়ে জেরিনের বয়স পাঁচ বছর। জেরিনের একটা ভাই হয়েছে। জেরিনের সারাদিন কেটে যায় তার ছোট ভাই কে নিয়ে। ঘরের যেখানেই থাকুক না কেন, ভাই কাঁদলে জেরিন ছুটে চলে আসে ভাইয়ের কাছে।

 

সংসারের নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলছিল শিমুল নাবিলার সংসার। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেবের অন্য পুত্র শোভন ও তার স্ত্রীও একই বাসাতেই ছিল। সাংসারিক নানা প্রতিকূলতায় একসাথে আর থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরে, সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায়, শিমুল আবারো অপারগ হয়ে পড়ে বাড়তি টাকা দিতে। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব অন্য মানুষের কাছে বলেছেন, ‘শিমুল তো ইচ্ছা করলে আমাকে কিছু টাকা দিলেই পারে। বাসা ভাড়া করে থাকলে কি টাকা দিতে হতো না?’। কথাটা শুনেও শিমুল কোন প্রতিবাদ করে নি। দুই তিন মাস ধরে, শিমুল দেখে তার বেতনের টাকায় খরচের ধারা সামলানো যাচ্ছে না। ছেলের জন্য একটা কাজের লোক রাখতে হয়েছে। সংসারের বাড়তি খরচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজের অপারগতার কথা বাবাকে শিমুল জানায়। তার বাবা হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। মোবাইল ফোনের ভেতরই ছেলের উদ্দেশ্যে এমন অগ্নিবান নিক্ষেপ করতে থাকেন যা কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে বেশীক্ষণ শোনা সম্ভব নয়। ফোনের মধ্যেই ছেলেকে বলে দিলেন, ‘তুই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। আমার বাসায় আসবি শুধু তোদের জিনিস নিতে। আমার টেরিটরির মধ্যে আর আসতে পারবি না’। শিমুল বলে, ঠিক আছে তাই হবে। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেব শিমুলের উদ্দেশ্যে এই অগ্নিবান নিক্ষেপ করতে থাকে শিমুলের মায়ের সামনেই। কিন্তু সমুদয় আলাপে শাহারা খানম চুপ করে ঘাকেন।

 

শিমুল আর নাবিলা, এখন নতুন বাসা খুঁজে বেড়ায়। আর চিন্তা করে কি কি ফার্নিচার কেনা লাগবে? কত টাকা ধার করতে হবে? হাতে যে টাকা নেই! শিমুলের মা নাবিলাকে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তোমাদের যা যা আছে নিয়ে যেও। এখন তো তোমাদের সবই কেনা লাগবে’। শাহারা খানম একদম সত্যি কথা বলেছেন। নতুন বাসাতেও শিমুল আর নাবিলা যে খাটে শুতো, সেটা হাজী জহুরুদ্দিন সাহেবের খাট। সেই খাট তো নেয়া যাবে না। হাজী জহিরুদ্দিন সাহেবের কিছুই যে নেয়া যাবে না। নিতে হবে শুধু সেই সব জিনিস, যেগুলো গত দেড় বছরে শিমুল আর নাবিলা মিলে কিনেছে। একরকম খালি হাতে, দুই বাচ্চা সহ ওরা নতুন বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওদের সর্বসাকুল্যে যা আছে, তা হল, কয়েকশ বই, দুটো বইয়ের আলমারি, দুইটা কাপড় রাখার আলমারি। বোনের জন্য যেই খাট শিমুল আর নাবিলা দিয়ে দিয়েছিল, সেই ওদের এখন কোন খাট নেই। ব্যাংকের কার্ডে হাত রেখে চিন্তা করছে ওরা, মাসের আর কয়দিন বাকী? যা টাকা আছে একটা খাট কিনতে পারবো তো?  

Author's Notes/Comments: 

23 february 2020

View shawon1982's Full Portfolio