৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০

‘মুড়ি খা’ এই কথাটা এখনকার যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে বহুল প্রচলিত ‘বাঁশ’ দেয়া টাইপ কথা। আমরা যখন ভার্সিটি ছিলাম, তখন কেউ কাউকে ‘না বুঝলে মুড়ি খা’ এই জাতীয় কথা বলেছে বা শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। এটা আধুনিক ট্রেন্ড বলা চলে। ইদানিং কয়েক বছর যাবত শুনছি এই মুড়ি খাওয়া। এত গো-বেচারা টাইপ একটা খাবার যাকে ইংলিশে খুব কায়দা করে Puffed-Rice বলা হয় সেটা কেন এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে একটা ‘হাইস্যকর’ টাইপ কথা হয়ে গেল সেটা আমার বোধগম্য না। তবে কথাটা শুনে এবং ইদানিং বলে আমিও মজা পাই। আমাকে কেউ মুড়ি খেতে বললে আমি বলি তুই ‘খৈ’ খা! কিয়েক্টাবস্থা!! (কি+একটা+অবস্থা এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ, এটাও এ যুগের পোলাপানের কাছ থেকেই শিখেছি)।

 

মুড়ি নিয়ে অনেক আউল-ফাউল টাইপ কথা বলে ফেললাম। আসলে মুড়ি আমার খুব প্রিয় একটা খাবার। যেসব বন্ধুরা একজন আরেকজনকে মুড়ি খেতে বলে, ওরা নিজেরাও মুড়ি খায় অর্থাৎ ভক্ষণ করে। আমি তো মুড়ি পেলেই খাই। সেটা বাসায় হোক কিংবা রাস্তায়! রাস্তার ঘাটের যত আজেবাজে Junk-food আছে তার সবই কেন জানি আমার কাছে অমৃতের মত লাগে। সেটা ফুচকাই হোক কিংবা লাল রঙ(!) দিয়ে ভাজা গলদা চিংড়ির মাথাই হোক না কেন! তবে রাস্তা ঘাটের খাবারের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশী ভাল লাগে ঝাল-মুড়ি! বেশী করে কাঁচামরিচ দিয়ে, ঘুগনি দিয়ে মেখে, সাথে একটু টমেটো, চানাচুর, আদাকুচি, লেবুর খোসা কুচিকুচি করে দিয়ে মুড়ি মাখা! আহ! লিখতে গিয়েও আমার জিবে পানি চলে আসলো!

 

মুড়ি মাখা সেটা সেটা বাসাতেই হোক কিংবা রাস্তায়, নাস্তা হিসেবে বা বিকালের স্ন্যাক্স আইটেম হিসেবে এর জুড়ি নেই। রাস্তার বানানো ঝালমুড়ি তো এখন প্রায় শৈল্পিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কত রকমের মুড়ি মাখা যে আছে। কিছু রকমভেদ যেমন- নরমাল মুড়ি, ডিম মুড়ি, আলু মুড়ি, কলিজা মুড়ি, লটপটি মুড়ি, চুই ঝাল মুড়ি... ইত্যাদি ইত্যাদি। মাংসের টুকরা দিয়ে মুড়ির আবার কত রকম ফের। গরু মুড়ি, মুরগি মুড়ি, কোয়েলের মাংসের মুড়ি...! আমি সবই খাই। যেটা পাব হাতের সামনে সেটাই খাব। তবে আমার মুড়ি খাওয়ার বৈশিষ্ট্য অবশ্যই মরিচ-কেন্দ্রিক। অস্বাভাবিক মাত্রায় মরিচ না খেলে আর ঝালমুড়ি কিসে! এটা আমার নিজস্ব দর্শন। পাঠক আবার না বুঝে আমার মত করে ঝাল দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিয়েন না। যাদের অভ্যাস নেই, তাদের অতিরিক্ত ঝাল খেলে upload-download দুইটাতেই ঝামেলা হয়ে যেতে পারে। আমাকে এক প্রফেসর ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘ঝাল কি জিনিস দেখেছ? জ্বলতে জ্বলতে ঢুকে আর জ্বলতে জ্বলতে বের হয়!’ কাঁচামরিচ অবশ্য আমার কাছে নির্জলা ভেজিটেবল টাইপ মনে হয়। সাধারণ মানুষ যেখানে এক প্লেট ভাতের সাথে একটি সর্বোচ্চ দুটি কাঁচামরিচ খায়, সেখানে আমি কমপক্ষে ১০-১৫ টা তো খাবই। রাস্তার বানানো ঝালমুড়িতে আমার জন্য (যারা পরিচিত) তারা কমপক্ষে ১২-১৫ টা কাঁচামরিচ দেয়! ধরুণ, আমি এই মাত্রার ঝাল দিয়ে মুড়ি খাচ্ছি নির্বিকার ভাবে, আমার আসে পাশে যারা খাচ্ছিলো তারা খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বলে, আগে উনার ঝাল খাওয়া দেখে নেই! আমি তাদের দিকে তাকিয়ে একটা ‘মোনালিসা’ টাইপ রহস্যের হাসি হেসে মুড়ি খাই আর বলি, দেখেন! এ আর এমন কি ঝাল!

 

এইত আর কিছুদিন পরেই মুড়ি খাওয়ার দিন চলে আসছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। ইফতারের একটা অপরিহার্য বাংলাদেশী ট্রেডিসনাল খাবার হল মুড়ি। আর কিছু হোক না না হোক, মুড়ি থাকতেই হবে টেবিলে। এরপর সেগুলাকে ছোলাবুট, পিঁয়াজি, বেগুনি, আলুরচপ, টমেটো সবকিছু দিয়ে বড় একটা গামলায় সরিষার তেল দিয়ে মেখে মুঠ ভরে ভরে না খেলে ইফতারের ঠিক পরিতৃপ্তি যেন আসে না। আমি তো বাসায় যেদিন হালিম রান্না হয় সেদিন হালিম দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খাই। অনবদ্য খাবার। তবে মুড়ি খাওয়ার ব্যাপারে আমার স্ত্রী আমার চেয়ে কয়েক কাঠি উপরে। ওর ভাতের সাথে মুড়ি, পান্তার সাথে মুড়ি, পোলাওর সাথে মুড়ি, মাংসের সাথে মুড়ি, বিরিয়ানির সাথে মুড়ি...! পোলাওর সাথে মুড়ি না খেলে নাকি ওর খাওয়াটাই মাটি হয়ে যায় টাইপ অবস্থা হয়! আমি অবশ্য পোলাওর সাথে মুড়ি খাই না!

 

সিঙ্গাপুরে যখন ছিলাম তখন মুড়ি খাওয়ার জন্য সে কি মন আকুলি বিকুলি করতো। ফ্যারার পার্কে যখন গেলাম ঘুরতে, ওখানে রবিবারে বাঙ্গালী, ভারতীয়, পাকিস্তানিদের মিলনমেলা বসে যায়। সবাই ওখানে জড়ো হয়। আড্ডা দেয়, খায় দায়, কেনাকাটা করে। এভাবেই উনারা রবিবারের ছুটি উপভোগ করে। পুরো ফ্যারার পার্ক লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আমি আমার আমার বন্ধু সুদীপা প্রথম যেবার ফ্যারার পার্ক গেলাম ঘুরতে, ওখানে মোস্তফা সেন্টারের সংলগ্ন একটা বড় বটগাছ টাইপ আছে। ওখানে দেখি এক লোক মুড়ি মাখিয়ে বিক্রি করছে। আর পায় কে আমাকে? সুদীপাকে বললাম, দোস্ত চল খাই। কতদিন খাই না। গিয়ে কথা হল বিক্রেতার সাথে। বাংলাদেশী। উনার নাম সুকান্ত। সিঙ্গাপুরে ভাত খাওয়ার জন্য যে ওয়ান-টাইম পেপারগুলা ব্যাবহার করে, সেগুলার একেকটা কে চোঙের মত বানিয়ে তার ভেতর সুকান্তদা আমাদের মুড়ি মাখিয়ে দিল। পরিমানে অনেক। কারণ দাম ছিল এক ডলার করে।

 

মুড়ি মাখার কথা মনে হলেই নস্টালজিক হয়ে যাই। নানুবাড়িতে যখন যেতাম, তখন কাজিনরা দল বেধে বোরাক-ম্যানশনের সামনে গিয়ে মুড়ি মাখা আর আখের রস খেতাম। অনেকটা প্রতিযোগিতা লাগত, কে কয় গ্লাস খেতে পারে! খুলনার দৌলতপুর বাসস্ট্যান্ড এ নামলেই আপনি দেখতে পাবেন বোরাক-ম্যানশনের বিল্ডিংটা। ওখানে প্রতিদিন বিকালে এক ইয়ং-ম্যান মুড়ি মাখাতো। তার ছোট্ট আয়োজনের সামনে সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। তার মুড়ির বৈশিষ্ট্য হল চুই ঝাল দেয়া মুড়ি। চুই ঝাল খুলনা অঞ্চলের বিশেষত্ব। তবে এখন অনেকেই চেনেন। চুই গাছের কান্ডটাকেই খাওয়া হয় রান্না করে। এক বিশেষ ধরণের ঝাল স্বাদ পাওয়া যায় যা এককথায় অনবদ্য। সেই চুই ঝাল দেয়া মুড়ি খেতাম আমরা। ঢাকায় এখনও আমার চোখে চুই ঝাল দেয়া মুড়ি মাখা আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু খুব খেতে ইচ্ছে করে। সামান্য একটু মুড়ি মাখা কে কেন্দ্র করে কত কিছুই না বলে ফেললাম। আসলে, মুড়ি মাখা তো খেতেই পারি, কিন্তু এর সাথে জড়িত স্মৃতিকাতর করে দেয়া ঘটনাগুলো চাইলেই কি আর ফেরত আনতে পারবো?

View shawon1982's Full Portfolio