আমার দাদা শশুর জনাব আলী হোসেন সাহেব মিরপুর ১৩ অঞ্চলের একজন নামকরা, প্রতাপশালী, খানদানী লোক ছিলেন। পিতা-মাতা উভয়সূত্রেই বিপুল ধনৈশ্বর্যের উত্তরাধিকারী হন। উনি মারা গেছেন ২০১৪ সালের মে মাসে আমার মেয়েটার জন্মের কিছুদিন পরেই। আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, আমার মেয়েটার জন্মের পরও উনি কিছুদিন জীবিত ছিলেন কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি মেয়েটার সাথে তার সাক্ষাৎ করানোর। আমার মেয়েটার জন্মের কিছুদিন পরেই উনি উমরাহ করার উদ্দেশ্যে সৌদি-আরবে গমন করেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। উনাকে মক্কাতেই দাফন করা হয়েছে। আমার খুব ভাল লাগা কাজ করে পরিবারের মুরুব্বী শ্রেণীর মানুষের সাথে গল্প জুড়ে দেয়া। গল্পের ছলে ছলে আমি উনাদের পুরানো দিনের কথা শুনে খুব ভালবাসি। সেটা উনাদের ছোটবেলার কথাই হোক অথবা উনাদের পূর্বপুরুষদের কথাই হোক না কেন। আমার ভাল লাগে উনাদের মুখ থেকেই উনাদের সেই পুরানো দিনের কথাগুলো শুনতে। আমার একবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার দাদা শশুর আলি হোসেন সাহেবের সাথে একান্ত বৈঠকে কিছু আলাপচারিতা করার। উনার সাথে আলাপের মাঝে উনার জীবনের অনেক কথাই জানতে পারি যা এতদিন আমার স্ত্রী বা শশুর শাশুড়ী তেমন জানতেন না বললেই চলে। আমার দাদাশশুর বেঁচে নেই কিন্তু মিরপুর ১৩ নাম্বার জুড়ে উনার কর্মময় জীবনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। উনার হেবা করে দেয়া জমিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘হাজী আলী হোসেন উচ্চ বিদ্যালয়’। উনি নিজে একজন বিদ্যানুরাগী ছিলেন।
আমার মেয়ের জন্মের আগের বছর সম্ভবত, আমি আর আমার স্ত্রী আমার দাদা শশুরের সাথে দেখা করতে যাই। দাদা খাটে শুয়ে ছিলেন। আমরা গেছি শুনে খুশী হলেন। পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে আমাদের কুশলাদি বিনিময় করতে থাকলেন। আমিও সুযোগ পেয়ে জুড়ে দিলাম উনার সাথে নানা রকমের গল্প। উনিও আমার সাথে গল্পে মেতে উঠলেন। দাদারা ভাই ছিলেন সাত জন আর উনি সম্ভবত ভাইদের মধ্যে চার কিংবা পাঁচ নাম্বার ছিলেন। দাদার মায়ের নাম ছিল ‘আয়না বিবি’ যার নামেই মিরপুর ১৪ নাম্বার বাইশটেকীতে একটা মাসজিদই আছে। উনি জাহাজে করে এবং পদব্রজে হজ্জে গমন করেন বহু আগেই। যা হোক, দাদা বললেন উনার শৈশবের কথা। উনার সাত ভাই আর কয়েকটা বোন ছিল। ভাইরা প্রত্যেকে কলেরার মহামারীতে মারা গিয়েছেন শৈশবেই। কেউই বিবাহিত ছিলেন না। ভাগ্যক্রমে মহামারীর ছোবল থেকে আয়না বিবির ছেলে ‘আলী হোসেন’ই শুধু বেঁচে গেলেন। আয়না বিবির বিপুল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী হন আলী হোসেন।
দাদা এমনও বলেছেন, এক ভাইকে কবরে দাফন করে ঘরে এসে দেখেন আরেক ভাই খাটে মরে পরে আছে। দাদা এই কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। এটা কতখানি মর্মবিদারক হতে পারে সেটা আমাদের জন্য কল্পনা করাও দুরূহ ব্যাপার। বললাম, দাদা আপনার বোনদের কথা বলুন। উনার সম্ভবত তিন বোন ছিল। এর মধ্যে একজন বোন এখনও জীবিত আছেন। দাদা বিশেষ করে তার এক বোনের নাম উল্লেখ করেন ‘দুধ মেহের’। দুধ শব্দটা শুনে একটু অবাক লাগায় দাদাকে আবার উনার কথা বিশেষ করে জিজ্ঞাসা করলাম। দাদা বললো, তার সেই বোনটা অনেক সুন্দরী আর ফর্সা ছিলেন। গায়ের রঙ অনেক ফর্সা ছিল বিধায় তার গায়ের রংকে দুধের সাথে উপমা দিতে দিতে তার নামই হয়ে যায়, দুধ-মেহের। উনার নাম আমার ধারণা মেহেরজান বা মেহের বানু এই জাতীয় কিছু ছিল। উনি দাদার পিঠাপিঠি বোন ছিলেন। এই বোনটাও অনেক অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। দাদা আবার তার এই বোনের সাথে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। দুধ-মেহের তার ভাই আলী হোসেনের সাথে খেলাধুলা করতো। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও দাদা তার বোন দুধমেহেরের কথা ভুলতে পারেননি। আমার স্ত্রীর মুখায়ববের সাথে উনি উনার প্রয়াত বোন দুধমেহেরের চেহারার মিল খুঁজে পেতেন।
দাদা আপনারা কি খেতেন ঐ সময়ে? এটা জিজ্ঞাসা করে বিচিত্র কিছু কথা শুনলাম। দাদা বললেন, উনি বিস্কুট খেটে পছন্দ করতেন। ততকালীন সময়ে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানী করা বিস্কুট অনেক দূর দূরান্ত থেকে কিনে নিয়ে এসে খেতেন। যাতায়াতের মাধ্যম বলতে ছিল গরুর গাড়ী। ভারতের বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) থেকে নারিকেল তেল, কাগজ, এসব আমদানী করে এনে ব্যবহার করতেন। কাগজের কথা শুনে খুব অবাক হলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম, দাদা নিজে শুধু শিক্ষিতই ছিলেন না বরং লেখাপড়া ঠিকমত চালিয়ে নেয়ার জন্য উনি উনার বাবার চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে কুমিল্লা চলে যান। সেখানে কোন এক ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারে জাইগীর থেকে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে থাকেন। উনার বাবা উনাকে মাঝে মাঝে ক্ষেতে খামারিতে ব্যস্ত রাখায় উনার লেখাপড়া বিঘ্নিত হত বিধায় উনি পালিয়ে চলে যান। এমন সময় ঘুরে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তোর বাবা (অর্থাৎ আমার শশুর) লেখাপড়া করতে চাইতো না, হের লাইগা কত মাইর খাইসে আমার হাতে! শুনে আমরা হেসে ফেললাম!
কথায় কথায় দাদা জানালেন, উনি ডায়রী লিখতে পছন্দ করতেন। বোম্বে থেকে আনা এক বিশেষ ধরণের কাগজ বাধাঁই করে ডায়রী বানাতেন। কাগজটা কত উন্নত ছিল সেটা বোঝাতে উনি বললেন, দোয়াতের কালি পুরো উপুড় করে দিলেও অন্যপাশে কালি দেখা যেত না! প্রথমে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলম বানিয়ে কালিতে ডুবিয়ে লিখতেন, এরপরে লিখতেন ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেন দিয়ে। সেই ডায়রী কোথায়? জিজ্ঞাসা করে হতাশ হলাম, কারণ সেই ব্রিটিশ পিরিয়ডে লেখা ডায়রীর আর কোন অস্তিত্ব সম্পর্কে উনি আর বলতে পারলেন না। কোরাণ শরীফ সেই আমলে দেখেছেন কিনা বা মুসলমানরা জানতো কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি জানালেন, উনি কোলকাতা থেকে কোরাণ একটা আনিয়েছিলেন। ঐসময়ের বেশীরভাগ মানুষ কোরাণের নাম শুনলেও চোখে দেখার সৌভাগ্যও অনেকের হয়নি। আরো জানতে পারলাম, উনি গরুর গাড়ীতে করে মাঝে মাঝে সদরঘাট গিয়ে কমলা, আপেল, ডালিম এসব ফল এনে খেতেন এবং নিজের মায়ের জন্য নিয়ে আসতেন।
এরপর দাদার কাছে জানতে চাইলাম উনাদের বংশধারা সম্পর্কে। দেখলাম দাদা উনার সাধ্যমত এই ব্যাপারে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন এবং কয়েক উর্ধ্বপুরুষের নাম ধাম উনি খুঁজে রেখেছেন। উনার উর্ধ্বপুরুষরা ব্যাপারী বলে খ্যাত ছিলেন। তারা ছিল চালের আড়ৎদার। এমতাবস্থায় আমার স্ত্রী কাগজ কলম নিয়ে বসলো লিখে রাখবে বলে। দাদা বলতে লাগলেন আর আমরা লিখে রাখতে লাগলাম আমার শশুরকূলের উর্ধ্বপুরুষের ধারাগুলো। পাঠকের সুবিধার্থে আমার বড় সম্বন্ধীর সন্তান থেকে শুরু করে যে পর্যন্ত আমরা জেনেছি উর্ধ্বসিঁড়ি পুর্বপুরুষের ধাপে, আপনাদের একবার নিয়ে যাই। ক্রমটা এরকমঃ
সামি → আবু সাঈদ → রফিকুল ইসলাম → আলী হোসেন → বকসে আলী মুন্সী → আকবর আলী মুন্সী → আব্দুল ব্যাপারী → ফজু ব্যাপারী →……