১৫ জানুয়ারী ২০২০

প্রিয় টিপু,

তোর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসে। এরপর বৃত্তি পরীক্ষার জন্য চলে গেলাম গ্রামের বাড়ীতে। বৃত্তি পরীক্ষা শেষে ভর্তি হয়ে গেলাম অন্য আরেক স্কুলে। দোস্ত, এরপর থেকে তোর সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখা হয়নি। তখনকার দিনে তুই তো জানিসই, যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভাল ছিল না। সেই T&T ফোনের যুগে ইচ্ছা হলেও আমরা ছোটরা ফোন করে পারতাম না। ফোন থাকতো লক করা। কাকে করবো, কোথায় করবো, বিল উঠবে, ইত্যাদি কত কথা শুনতে হত! ফোন তেমন করতামও না। স্কুলে গেলেই তোর সাথে দেখা হত। তখন কখনও ভাবিনি যে, স্কুল পরিবর্তন করার পরে তোর সাথে হয়তো আর দেখা নাও হতে পারে সহসা। তাই তো হল রে! তুই এখন যে কোথায় আছিস, কি করিস না করিস, কিছুই আর জানি না। আজ কিছুদিন তোকে খুব মনে পড়ছে। তোর কি মনে আছে বন্ধু তুই যে আমার খুব কাছের একজন ছিলি? ক্লাস ফাইভের শেষের দিনগুলো যে কোচিং ক্লাসগুলোতে আমি বেশীরভাগ সময় তোর সাথেই বসতাম? তোর সেই হাসিমুখ আমার চোখে ভাসছে কিন্তু তোকে তো দেখতে পাচ্ছি না চাইলেও। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তোকে টিপু নামেই তো ডাকতাম! তোর পুরো নামটাও মনে পড়েছে না। টিপু সুলতান টা কি ফাজলামি করে বলতাম? মনে পড়ছে না রে! মাঝে মাঝে তো টুপি বলতাম!

 

ফজলে এলাহী সুজন এর কথা মনে আছে? ওর সাথে একবার দেখা হয়েছিল ফার্মেগেটে। কোন সালে মনে নেই। তখন জেনেছিলাম ও ‘ল’ পড়ছে। ফজলে এলাহী তোকে ঠাট্টা করে টেম্পু বলে ডাকতো। তোর মনে আছে? তুই শুনে শুধু হাসতি, একটুও রাগ করতি না। তোর সেই হাসিমুখ! বন্ধু সত্যিই আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর কোন ঠিকানা, ফেসবুক আইডি কিছুই জানি না রে। আমাদের ব্যাচের যতগুলা গ্রুপ আছে তোকে খুঁজে পোষ্ট দিয়েছি। জানিনা তোর কোন সন্ধান পাব কি না! তুই যে নিজের হাতে এটা ওটা বানায়ে আমাকে দিতি সেটা কি তোর মনে আছে? তোর বানায়ে দেয়া সেই তীর ধনুক! ওহ ওটার কথা আমি কখনই ভুলতে পারবো না। বেশ শক্তিশালী একটা ধনুক হয়েছিল। তুই ওটা দিয়ে আমাকে নিশানা করা শিখায়ে দিলি। এরপর আমাকে দিয়ে দিলি তোর সেই তীর ধনুক। আমি খুশিতে একাকার হয়ে গেছিলাম সেদিন। বাসায় গিয়ে সে কত দাগাবাজি করলাম সেটা দিয়ে। বারবার আব্বুর ধমক খেতে লাগলাম, কারো দিকে যেন তাক না করি আমি। আরেকবার দিয়েছিলি একট মাটির ঘন্টা! আমার জীবনে দেখা প্রথম মাটির ঘন্টা! কি শব্দ করে বাজে! আমার এর আগে ধারনাই ছিল না যে মাটির ঘন্টাও এভাবে বাজতে পারে। এরপর আড়ং এ কতবার গিয়েছি। ওদের ওখানে পাওয়া যায় সেই মাটির ঘন্টা। আমি প্রায়ই আড়ং থেকে মাটির ঘন্টা কিনে আনি। তোর কথা মনে পড়ে সেজন্যই কিনি। আমার মেয়ে কিছুদিন আগেও খেলতে খেলতে একটা ঘন্টা ভেঙ্গে ফেলেছে। মনে হয় আবার কিনতে হবে। আজও একটু আগে আড়ং এ গিয়েছিলাম। খুজলাম তেমন একটা ঘন্টা! পাইনি! আজকে ঘন্টাটা ছিল না সেই শো রুমে। ঘন্টা পাইনি কিন্তু তোকে ভুলিনি দোস্ত!

 

তোর আরেকটা কথা আমার মনে পড়ে। একবার খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে তোর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বইয়ের মলাট বের করে দেখালি। মলাটে একজন শেতাঙ্গ মহিলার ‘স্তন’ উন্মুক্ত করা ছিল। সম্ভবত ব্রেস্ট ক্যান্সার বা মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজনীয়তা এর কোন একটা ব্যাপারের উপরে ছিল। সময়টা আমাদের বয়সন্ধিকালের প্রায় সমসাময়িক কালের ঘটনা ছিল। কাজেই ব্যাপারটায় আমরা কিছুটা উৎসাহ দেখালেও, স্যার দেখে ফেললে মার খেতে হতে পারে সেই ভেবে আমরা বললাম টিপু কলম দিয়ে ছবিটা নষ্ট করে দে। তুই এক মূহুর্ত দেরী না করে আমাদের চোখের সামনেই মহিলার উন্মুক্ত অংশটাকে সম্পুর্ণ কালো করে কেটে দিলি। এরপর সেখানে আসলে কি ছিল বোঝার আর উপায় রইলো না। এই ঘটনা তোর মনে আছে কিনা জানিনা, তবে তোর সেই লজ্জা পাওয়া মুখটা আমার ভীষণ মনে আছে।

 

বন্ধু, ছোটবেলার আমাদের সেই সময়কালটা আমাদের জীবনে আর কখনও ফিরে আসবে না জানি কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে সেই শৈশবেই যেতে ইচ্ছে করে। শৈশবের সেই ফেলে আসা বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। তখনকার দিনের আমাদের সেই বন্ধুত্ব কত নিঃস্বার্থ ছিল। কি সুন্দর দুই তরফা বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু এখনকার দিনে এক তরফা সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের অস্তিত্ত্ব দেখতে পাচ্ছি। একজন হয়ত বন্ধু মনে করছে, কিন্তু অন্যজন নয়। অন্যজন হয়ত নিছক মিশেছে বা ভদ্রতা দেখিয়েছে। একজনের হয়ত বন্ধুসুলভ মায়া ছিল, অন্যজনের ছিল অন্য কারো জন্য মায়া! ব্যাপারগুলা আমরা আমাদের ছোটবেলায় কি কখনও ভাবতে পেরেছি তুই বল? কখনই না। আমি সেই দিনগুলো কখনই ভুলবো না রে, তুই অনেক মায়া করেই আমার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলি। আমাকে তুই ভালবাসতি। দোস্ত তোকে আমিও ভালবাসি রে! হয়ত তখন প্রকাশ করতে পারিনি, বুঝিনি! এখন তো বুঝি! তাই তোকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।

 

ইতি,

তোর সেই স্কুলের বন্ধু জায়েদ!

 

পুনশ্চঃ সায়েম বললো, তোকে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত দেখে মিরপুর বাংলা স্কুলে। কিন্তু আর নতুন কোন অথ্য দিতে পারলো না। আমি অপেক্ষায় আছি, তোর সাথে হয়ত দেখা হয়ে যাবে আমার। মানুষ আশা নিয়ে বাঁচে। আমি আশায় আশায় এখনও আছি, হয়ত হঠাৎ করেই তোর দেখা পেয়ে যাব।

View shawon1982's Full Portfolio