২৮ ডিসেম্বর ২০১৯

‘সাহিত্য’ আর ‘সমুদ্র’ আমার কাছে একই। দু’টোরই বিস্তৃতি সসীমে শুরু হলেও সীমান্ত গিয়ে ঠেকে অসীমে। মানুষের বসবাসের পৃথিবীতে সমুদ্র আছে। মানুষ কতটা জানতে পেরেছে তাঁর গভীরতা? ঠিক তেমনি মানুষের হাত দিয়ে রচিত হয় সাহিত্য। কিন্তু এর উৎস কি আদৌ মানুষ? সাহিত্যের উৎস কখনও মানুষ হতে পারে না। সাহিত্যের উৎস অনেক গভীরে, অসীম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই...’।  যারা সু-সাহিত্যিক কিংবা সাহিত্য বোদ্ধা তাদের প্রতি আমার বরাবরই শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। কারণ আমি ঐকান্তিক ভাবে বিশ্বাস করি, পরম করুণাময় সত্ত্বা শুধুমাত্র তাঁর প্রিয়ভাজনদেরকেই সাহিত্যের সমঝদার করেন। ইসলাম ধর্মের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ কোরানের প্রতিছত্রই ভাবগম্ভীর সাহিত্যের অমোঘ এবং অকাট্য নিদর্শন। রামায়ন, মহাভারতের দিকে দেখুন। দুইটাই মহাকাব্য। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সাহিত্যের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক হয়েছে। যে সাহিত্যকে ভালবাসে না, যার সাহিত্যের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ নেই সে, ধার্মিক কিভাবে হবে? ধর্মের অমোঘ বাণীর প্রতিছত্রেই যেখানে সাহিত্য বিদ্যমান?

 

সাহিত্য সম্পূর্ণই উপলব্ধির বিষয়। শুধু সাহিত্য বিষয়ে লেখাপড়া করে কেই সাহিত্যিক হতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস। সাহিত্য রচনার জন্য ভেতর থেকে সেই গুন উৎসারিত হতে হবে যা একান্তই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। সাহিত্যে লেখাপড়া করে কেউ সাহিত্য সমালোচক হলেও হতে পারে, কিন্তু প্রকৃত সাহিত্যিক হতে হলে তাকে অবশ্যই ইশ্বরপ্রদত্ত সেই গুণের অধিরকারী হতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, নৃত্য, বিতর্ক করা এগুলোর কোনটাই কি শুধুমাত্র ‘ট্রেনিং’ নিয়ে করা সম্ভব যদি এগুলো ভেতর থেকে না আসে? কখনই সম্ভব নয়। ‘কলা’ বা Arts এমন একটা জিনিস, যা সরাসরি মানুষের আত্মার খোরাক হয়ে যায়। জোর করে কখনও সাহিত্যিক যেমন হওয়া যায় না তেমনি সাহিত্য বোদ্ধাও হওয়া চলে না।

 

সাহিত্য যে কত উচুস্তরের আর উচ্চমার্গীয় আরাধনা সেটার একটা নমুনা আমরা দেখতে পাই মহান ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে  (Jean Paul Sartre) এর কাছ থেকে। ১৯৬৪ সালে উনাকে সাহিত্যে অনন্য কৃতিত্বের জন্য নোবেল পুরস্কারের ভূষিত করা হয়। নোবেল জয়ের সাইটেশনে বলা হয়েছে "for his work which, rich in ideas and filled with the spirit of freedom and the quest for truth, has exerted a far-reaching influence on our age." উনি উনার পুরষ্কার প্রত্যাখান করেছিলেন। উনিই একমাত্র নোবেলজয়ী সাহিত্যিক যিনি এই সন্মাননা প্রত্যাখান করেছেন। এজন্য কারণ হিসেবে উনি উল্লেখ করেছেন, ‘সাহিত্যিক কখনও সীমাবদ্ধ গন্ডিতে আবদ্ধ হতে পারে না’। নিজের সাহিত্যকে একমুখী প্রবাহে দিকাঙ্কিত করতে চাননি বলেই উনি এত বড় সন্মান প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন। পুরষ্কার নেননি, কিন্তু পুরো পৃথিবী তাকে রকই রকম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে যাচ্ছে। সাহিত্যের সূত্রপাত হয়ত কোন একজন নশ্বর মানুষের কলম দিয়ে শুরু হয়, কিন্তু সেই সাহিত্য আমাদের অনায়াসে নিয়ে যেতে পারে অসীমে। খুলে দিতে পারে আমাদের জন্য একের পর এক উন্নত মন-মানসিকতা সম্পন্ন মনুষ্যত্বের দ্বার।  

 

আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হলেন সাহিত্যিকরা। না থাকতে পারে তাদের টাকা পয়সা না থাকতে পারে তাদের বাহ্যিক চাকচিক্য। সাহিত্যিকের কাছে যা আছে, তা তো সেইসব ঐশ্বর্যবানদের কাছে নেই যাদের কাছে গোটা পৃথিবীটাই হল শুধু চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সুখাধার। মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটা বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য আর তা হল, ‘সর্বোত্তম ঐশ্বর্য হল মনের ঐশ্বর্য’। উনি নিজেও সুসাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। উনার অনুসারী (সাহাবী)দের ভেতর যারা কবি ছিলেন, উনি তাদের কবিতা মন দিয়ে শুনতেন এবং গঠনমূলক সমালোচনা করে তাদের উৎসাহ দিতেন। প্রতিবাদী কবিতা রচনার জন্য সাহাবী হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) কে উনি বলেছিলেন, ‘হাসসান জিহ্বা দিয়ে যুদ্ধ করে’। উনি আরো বলেছেন, ‘কোন কোন কবিতা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকে’। ব্যক্তিজীবনে, নিজেকে লেখক বা কবি বলার কোন ধৃষ্টটা আমার অতীতেও ছিল না এখনও নেই। সাহিত্যিক হবার কোন যোগ্যতা আমার নেই কিন্তু পরমকরুণাময়ের নিকট সর্বতভাবে কৃতার্থ থাকবো যে উনি আমাকে সাহিত্য ভালবাসার মত একটা মন দিয়েছেন। আমি সাহিত্য ভালবাসি। আমি নিজেকে তাই ঐশ্বর্যবান বলে মনে করি।

View shawon1982's Full Portfolio