কয়েকমাস আগেই ফেসবুকে একটা ভিডিও পোস্ট দেখলাম, যেখানে দেখানো হল একটি মাসজিদে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়েছে। আর সেটা ভাইরাল হয়ে তুলকালাম মন্তব্যের তুবড়ি ছুটিয়েছেন কত মানুষ। এখানে সমস্যা কোথায় হয়ে গিয়েছে? মাসজিদ? না রবীন্দ্র সঙ্গীত না একজন হিন্দু/ব্রাহ্ম সাহিত্যিকের লেখা গান? মাসজিদে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে যে এত তুলকালাম হয়ে গেল, এখানে অধর্মের কি হল আমি বুঝলাম না। যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের কাছে সবিনয়ে জানতে চাই, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে আদৌ কোন ধর্ম বা আকিদা বিরোধী কথা আছে কি কোথাও?
এই বছর ঈদুল আদহার দিন, সকাল সকাল মাসজিদে চলে গেলাম ঈদের নামাজ পড়ার জন্য। ভিড় হয়ে যেতে পারে, আগে ভাগে সামনে বসার জন্য আগেই চলে গিয়েছিলাম মাসজিদে। এক লোক ভুল করে নফল নামাজ পড়া শুরু করেছিল, তাকে মাসজিদের মিম্বর থেকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করে দিলেন মুয়াজ্জিন সাহেব। ‘মাসআলা’ বললেন যে, ঈদের নামাজের আগে আর কোন নফল নামাজ নেই। ভাল কথা। খতিবের বয়ান শুরু হত আরো বেশ কিছুক্ষণ বাকী। এবার মুয়াজ্জিন সাহেব দরাজ গলায় শুরু করলেন, একখান গজল(!!)।
আমি আশা করেছিলাম, হামদ নাত জাতীয় কিছু হবে। কোরান পাঠ করছিলাম। উনার গানের কারনে পাঠ বিঘ্নিত হচ্ছিল। মনোঃসংযোগ নষ্ট হচ্ছিল। অগত্যা পাঠ বন্ধ করে উনার খালি গলার গান শুনতে লাগলাম। আমি উনার গান, যেটা মাসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন, কোথাও আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম, বা ধর্মের মহিমা জাতীয় কিছুই শুনতে পেলাম না। গানটা উনি গাইছিলেন ‘মা’ কে নিয়ে। মা অনেক কষ্ট করেছেন, জন্ম দিয়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো গানটা ছিল মা কে নিয়ে। এবার আমাকে আপনারা বলুন তো, মুয়াজ্জিন সাহেবের গাওয়া সম্পূর্ণ গানটা যদি ‘মা’ কে উপজীব্য করে গাওয়াতে কোন দোষ না হয়, তাহলে দেশকে ‘মা’ উল্লেখ করে গাওয়া জাতীয় সঙ্গীতে দোষ কোথায় হল? জাতীয় সঙ্গীতে যদি ইসলাম না থাকে, তাহলে আমার শোনা মাসজিদের ঐ গানেও কোন ইসলাম ছিল না। ঈদের নামাজের আগে যদি অন্য কোন নামাজ না পড়া যায়ও, তাহলেও মুসল্লিদের কোরান, তাসবিহ, জিকর, দুরুদ এসব পাঠের জন্য নির্দেশনা দেয়া যেত। ‘মা’ এর গুনকীর্তন করে গান গাওয়ার কি দরকার ছিল?
গতকাল আমি বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। এখন ডিসেম্বর মাসে আপনারা তো জানেনই পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ-মাহফিল হয়। ওয়াজ মাহফিলে কি জাতীয় কথা বার্তা হয় সেগুলো সকলেরই জানা আছে। সেগুলো আমার আজকের আলোচ্য না। ওয়াজ মাহফিল আমি যতগুলো দেখেছি সবগুলাতেই আসর থেকে মাগরিবের সময়টুকু লাউড স্পিকারে তারস্বরে কতগুলো মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলেদের দিয়ে গজল(!) গাওয়ানো হয়। মাগরিব পর্যন্ত পুরো সময় এগুলোই চলতে থাকে। শুরু হয় কোরান তেলাওয়াত দিয়ে। বাসটা যখন মিরপুর দশ নাম্বার ক্রস করছিল তখন মাইকের আওয়াজ কানে আসছিল। ঘোষনা করে হল, এখন ওমুক হাফেজ আপনাদের গজল(!) শোনাবেন! আমিও অনিচ্ছাতেই শুনতে লাগলাম। এবার গানের ভেতর অবশ্য আল্লাহ, রাসুল এই জাতীয় শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু গানের গায়কি বা সুরটা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল।
খানিক শুনেই স্পষ্টই বুঝলাম এটা অতি লোকপ্রিয়, একটা হিন্দি ফিল্মের গানের সুরের নকলে গাওয়া হচ্ছে। মূল হিন্দি গানটা হল হিন্দি ফিল্মঃ খানদান (১৯৬৫) এর গান “তুমহি মেরে মন্দির তুমহি মেরি পূজা, তুমহি দেবতা হো...” এই গানটা। লতা মঙ্গেশকর এই গানটার জন্য ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন। এই গানের সুরকার হলেন, রবি শঙ্কর শর্মা আর গানের লেখন হলেন, রাজেন্দ্র কৃষাণ। এই গানের গায়িকা, কলা কুশলী, গীতিকার, সুরকার কেউ কি ইসলাম ধর্মের অনুসারী? আমার কথা হল, ইসলামী হামদ নাত যদি বানাতেই হয়, মৌলিক সুরে বানান। যেমন পল্লীকবি জসিমুদ্দিনের গান “রাসূল নামে, কে এলো মদিনায়” কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে”, কি অসাধারণ সুর আর গানের কথা। কেন অন্য সুরকারের গানের সুরের উপর হামদ নাত বানাতে হবে? যখন সেই গজল(!) শুনলে, সেটার চেয়ে বেশী মূল গানটার দিকেই মন চলে যায়? এটা একটা উদাহরণ দিলাম। এমন ভুরি ভুরি আমি নিজের কানে শুনেছি। একবার শুনেছিলাম ম্যাডাম রুনা লায়লার একটা জনপ্রিয় গানের সুরের নকলে।