কাক নিয়ে লিখছি দেখে কি বিরক্তিতে আপনার ভ্রু কুঁচকে গেল? যেতেই পারে। তবে শুধু যে কাক নিয়ে লিখবো তাও কিন্তু না। কাকের মত কিছু মানুষ আছে, তারাও আমার আজকে লেখার উপজীব্য। কাককে অন্তত কেউ পাখি হিসেবে খুব একটা যে পছন্দ করে না সেটা আমি জানি। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি কাক খুব পছন্দ করি। কাকের সবকিছুই আমার ভাল লাগে। কাকের গায়ের যে কুচকুচে কালো রঙ, সেটারও একটা মাধুর্য আমার চোখে পড়ে।খুব কাছ থেকেও ভালও করে লক্ষ্য করেছি, কাকের গায়ে যখন সূর্য্যের আলো পড়ে, তখন ঐ কালো রঙের উপরেও রংধনুর সাত রঙের ঝিলিক দেখা যায়। কাক ময়লা জাতীয় জিনিস খায় সেটা তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু কাকের গায়ে কখনও একটু ময়লার ছিটে ফোঁটাও দেখেছেন? কাক নিজে কিন্তু অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পাখি। আমার খুব আফসোস লাগে, এখন আর আগের মত কাক দেখি না। কতদিন যে দেখি না তাও মনেও নেই। ঢাকায় আগে অনেক কাক দেখতাম কিন্তু এখন আর দেখি না। আমাদের দূষণের মাত্রা এত বেড়ে গেছে যে শুধু কাক কেন, অন্য কোন পাখিও এখন আর চোখে পড়ে না। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য আর পরিবেশ বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কাকের তারস্বরে চিৎকারে অনেকেই বিরক্ত হন কিন্তু আমার খারাপ লাগে না কখনই।
শৈশব থেকেই আমাদের বাসার সামনের ইলেক্ট্রিক ক্যাবলের উপরে বসে থাকা কাকদের দেখতাম। ওরা খুব নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকতো। মাঝে মাঝে ডাকাডাকি করতো। একবার ট্রান্সফর্মারের ফেজ চেঞ্জ করার সময় তড়িতাহত হয়ে একটা কাক মারা গেল। এরপর কোথা থেকে যেন শত শত কাল এসে হাজির হল আমাদের বাসার সামনে। স্বজনের এই করূণ মৃত্যু ওরা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। মৃত কাকটার দেখ ওখান থেকে সরিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে না দেয়া পর্যন্ত কাকগুলোর আহাজারি করছিলোই না। তখন বুঝেছিলাম স্বজাতির জন্য ওদের কত মায়া। কাককে যারা খুব ঘৃণা করেণ, সবিনয়ে তাদের কাছেই জানতে চাই, স্বজাতির বিপদের সময় এভাবে ‘দরদ দিয়ে’ ছুটে আসতে কয়টা মানুষকে বা কয়টা আত্মীয়কে দেখেছেন? দরদ দিয়ে কথাটা একটু ঘৃণা মিশ্রিত কষ্ট নিয়েই লিখতে হল। কারণ কেউ যখন বিপদে পড়ে তখন ‘তামাশা’ দেখার লোকের অভাব হয় না কিন্তু সত্যিকারের উপকারী মানুষের কিন্তু আসলেই অপ্রতুল থাকে। আর আত্মীয় স্বজন? বিপদে পড়ে দেখুন কিংবা অর্থকষ্টে পড়ে দেখুন না একবার, আমাকে কিছু বলতে হবে না। যাদের জন্য এতদিন নিজের কলিজা পর্যন্ত কেটে দিয়েছেন, তারা আপনাদে কি দেয় আর কতটুকু দেয় নিজেই দেখতে পাবেন। আপনার যদি এমন অভিজ্ঞতা না হয়ে থাকে, তাহলে আপনি সৌভাগ্যবান।
‘তীর্থের কাক’ নামে একট বাগধারা পড়তাম বাংলা ব্যকরণে। যার অর্থ হল দীর্ঘ প্রতীক্ষা নিয়ে বসে থাকা বা আশায় আশায় বসে থাকা। মানুষ কখনও কখনও একটু ভালোবাসা পাবার জন্য তীর্থের কাকের মত হয়ে যায়। আমি বরাবরই তীর্থের কাক। কাছের মানুষ বা পছন্দের মানুষের সাথে একটু কথা বলার জন্য বা তাদের সঙ্গ পাবার জন্য মনটা সবসময়ই যেন কেমন কেমন করে। facebook যখন ছিল না তখন yahoo messenger এ চ্যাটিং করতাম খুব। এরপর এল ফেসবুক! সেখানেও আমি পছন্দের মানুষগুলো জিজ্ঞাসা করি, জানতে চাই কে কেমন আছে। আমার কথা বলতে ভাল লাগে। মানুষটাকে কাছে দেখতে পাই না কিন্তু কথা তো বলতে পারি। এটাই সান্ত্বনা। আর যদি উল্টা করে বলি, আমাকে কয়জন আগে জিজ্ঞাসা করেছে, তাহলে সেউ শতকরার পাল্লা এতটাই কমে যাবে যে সেটা অনুল্লেখই থাক।
“আমি কেন অনলাইনে এত বেশী সময় থাকি? কিভাবে সম্ভব? আমার কি খেয়ে দেয়ে কোন কাজ কাম নাই? ভাই তোর না হয় কামকাজ নাই, আমাদের তো কাজ কাম আছে”—এই হল সেই সমস্ত মন্তব্য যেগুলো আমাকে অনলাইনে সেই সব মানুষদের কাছ থেকেই মাঝে মাঝে শুনতে হয়, যাদের সাথে কথা বলার জন্য আমি কাঙ্গালের মত ছুটে আসতাম অনলাইনে। না রে ভাই! কাজ আমারো আছে। তবে ছোট বেলা থেকেই একটা জিনিস আমার খুব ভাল ভাবে আয়ত্ত করা আছে। তা হল, আমার হাতে যে কাজ নিয়ে আমি বসি, সেটা আমার টার্গেট থাকে কত দ্রুত আমি ঠিকভাবে শেষ করে ফেলতে পারবো। আর যখন আমি হাতের কাজটা খুব দ্রুত শেষ করে ফেলি, তখন বসি মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। আমার কাছে আমার চাকরী আর কাজ যাই বলি না কেন, আমার মূল্যবোধ বা Ethics এর সাথে আমি সারাজীবন আপোষ করতে পারিনি। কখনও করবোও না। আমার সহকর্মীরা যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছেন, আমি হাতে নেয়া কাজ খুব দ্রুততার সাথে শেষ করে ফেলি। কাজ তো করতেই হয় রে ভাই। আমাকে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে! কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাই সময় হলেই ছুটে আসি। এজন্যই নিজেকে আমার তীর্থের কাকের মতই মনে হয়। প্রিয় মানুষগুলোর সাথে কখন একটু কথা বলতে পারবো, সেজন্য মন চঞ্চল হয়ে থাকে। কিন্তু যেটা হয়, ফলাফল হয় উল্টো। আমি মানুষের কাছে নিতান্তই অকেজো হয়ে যাই। অতি নিকটবর্তী কারো কারো কাছে তো আমি ‘অচল মূদ্রা’। সে প্রসঙ্গে না হয় অন্য কোনদিন বলবো।
অন্যদের কাজই শুধু কাজ, আর আমারগুলো সব অকাজ, কারণ আমি নেটে প্রিয় মানুষগুলোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি যে। কিন্তু ঐ যে বললাম, মানুষ অন্য সব কিছুর মত পরিবর্তন হয়ে যায়। আমিও হয়ে যাচ্ছি এবং গিয়েছিও কিছুটা। এখন নিজেকে অন্যভাবে ব্যস্ত রাখি। কারো জন্য অপেক্ষা করি না। আমার অপেক্ষাগুলো আর সেগুলোর পেছনের ভালবাসাগুলোর অন্ত্যজ সীমারেখায় আমি নিয়ে এসেছি। এখন আর কারো কাছ থেকে কিছু আশা রাখি না। যেহেতু আর আশা রাখি না, সেহেতু আর কষ্ট বোধও আগের মত হয় না। কেউ একজন আমাকে একবার বলেছিল, পত্রমিতা বন্ধুর ছবি কখনও দেখতে নেই, কিংবা সরাসরি সাক্ষাৎ করাও উচিত না। কারণ মনে মনে বন্ধুর যে ছবি আঁকা থাকে, তাকে কল্পনায় রাখতেই নাকি বেশী ভাল লাগে। ছবি দেখে ফেললে কিংবা সরাসরি দেখা হয়ে গেলে আশা ভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। উনার এই কথার মর্ম বহুবার বুঝেছি। এখনও বুঝে চলেছি। কিন্তু তীর্থের কাকরা মনে হয় বারবার ভুল করতেই থাকে। ভুল করাই মনে হয় তাদের পরিণতি হয়ে যায়। আমিও ভুল করেছি। বারবার ভুল করেছি। এখন মনে হয় ভুল শোধরানোর সময় এসে গেছে। এখন আমি কাক থেকে মানুষে রুপান্তরিত হচ্ছি।