বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলো একরকম কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরের মতই কেটে গেছে। কত বন্ধু, কত আড্ডা আর কত লেখাপড়ার চাপ, কত স্মৃতি আমাদের। সেগুলো একটু একটু করে সবই মনে পড়ে। মনে পড়ে একসাথে পড়া বন্ধুগুলোকে। সবাই যে যার জীবনে ভাল আছে, ব্যস্ত আছে। সবাই প্রায় ঘর সংসারী হয়ে গেছে। জীবনের নানা চক্র আমরা পার করছি। জীবনের শেষ প্রান্তের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি ততই যেন পেছন ফিরে ফেলে আসা অতীতগুলোকে বার বার দেখতে ভাল লাগে। অ্যালবাম খুলে পুরনো ছবিগুলো যখন দেখি, তখন যেন চোখ মানতেই চায় না, এমন ছিলাম আমরা দেখতে? এখন বন্ধুরা সবাই দেশেও থাকে না। চাইলেই সবাইকে দেখতেও পারি না। কিন্তু মনে পড়ে সবারই কথা। বাংলাদেশেও এক একজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বন্ধুদের সাথে কতই না মজার মজার স্মৃতি রয়ে গেছে। এগুলো এখনও আমরা একসাথে হলে আলাপ করি, এখনও হাসাহাসি করি। এখনও যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই, তখন মনে হয় না যা যে সেই কত বছর আগে ভার্সিটি পাস করে এসেছি। এখনও মনে হয় সেই আগের মতই আছে। কথাটি কিন্তু ভুল নয়। শরীরের বয়স যাই হোক না কেন, মনটা আগের মতই আছে। একদম আগের মত। আজকে আমার মনে পড়ছে ক্লাসে কাঁঠাল খাওয়ার স্মৃতি। সেই ঘটনাই বলছি।
তখন আমরা দ্বিতীয় বর্ষে দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ি। ২০০৪ সালের ঘটনা। গরম কাল। কাঁঠাল পাকার সময়! আমাদের Old Academic Building এর পাশেই ছিল কাঁঠাল গাছ। আমাদের ক্লাসরুমের জানালা দিয়েও দেখা যেত। বারান্দার একেবারে পাশেই। গাছে সুন্দর সুন্দর কাঁঠাল ধরেছিল। হলে যেসব বন্ধুরা ছিল, ওরা প্ল্যান করলো কাঁঠাল পেড়ে পাকিয়ে খাওয়াবে আমাদের। একদিন ক্লাস দুপুর বেলাতেই শেষ হয়ে গেল। ব্যাগ গুছিয়ে উঠতে যাব, বন্ধু রানা বললো, আজকে এখনই যাইস না। কাজ আছে। বলেই চোখ দিয়ে একটা ইশারা করলো। কয়েকজন কে এই ইশারা দেয়া হল। সর্ব সাকুল্যে ৪-৫ জন হব আমরা। ক্লাসের সবাই যখন বের হয়ে গেল, তখন বেঞ্চের নিচের থেকে বের করা হল খবরের কাগজে মোড়া দুইটা মাঝারি সাইজের কাঁঠাল! দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেল! রানা বললো, গাছ থেকে পেড়ে হলে নিয়ে পাকাইছি। আজকে আমরা খাব এইটা! শুধু কর্মচারীরাই খাবে কেন? আমাদের বিল্ডিং এর গাছ আমরাও খাব। অকাট্য যুক্তি একেবারে! আমাদের এই নিয়ে তর্ক করার কোন প্রশ্নই আসে না। হলের বন্ধুরাই মূহুর্তের মধ্যে কাঁঠালের খোসা খুলে ফেলল। বেশ ভালভাবেই পেকে গিয়েছিল। ব্যস হয়ে গেল! শুরু হয়ে গেল পাল্লা-পাল্লি! মাত্র তিন কি চার মিনিটের মাথায় দুইটা কাঁঠালের শুধু খোসা, বীজ আর মাঝখানের দন্ডটা পড়ে রইলো। সরিষার তেল যে দরকার ছিল সেটা কারো মাথায় ছিল না। সারা হাত যে কাঁঠালের আঠায় মাখামাখি তখন! তাতে কি? কাঁঠাল খাওয়া হইসে সেটাই বড় কথা। খেয়ে আমরা কয়জন পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগলাম।
ততক্ষণে আমাদের ছেলেদের দিকের একটা হাইবেঞ্চ কাঁঠালের আঠায় মাখামাখি অবস্থা! পরিস্থিতি ভয়াবহ! এবার কি করা যায়? সবাই মিলে ঠিক করলাম, বেঞ্চটাকে সরায়ে মেয়েদের বসার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। ব্যস যেই কথা সেই কাজ। মুহূর্তের মধ্যে ধরাধরি করে হাই বেঞ্চ জায়গা বদল করে ফেলল। আমরা কাঁঠালের খোসাগুলা খবরের কাগজে মুড়ে বিন্দাস বঙ্গিতে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলাম! সবাই ভুলে গেলাম কি হল এতক্ষণ ধরে। পরদিন সকালে ক্লাসে এসে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা মেয়েরা বলাবলি করছিল, একি, টেবিলে এইসব কি? আঠা আঠা লাগে কেন? আমিও ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম। তাকিয়ে বললাম তাই নাকি? আঠা হতে যাবে কিজন্য? কাগজ বিছায়ে বস। ওরা বেঞ্চ পরিবর্তন করে দ্বিতীয়টায় চলে গেল। আমরাও ভুলে গেলাম কি হয়েছিল গতকাল।