একা একা লাগে মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই। সবাই আশেপাশে থাকলেও মনে হয় আমি একা। কোন কিছুতেই মন ভালও লাগে না। নিজেকেই মনে হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। মনে হয় একরাশ শূন্যতা ক্রমশঃ গ্রাস করে নিচ্ছে। এক দুশ্চিন্তার চোরাবালিতে ডেবে যাচ্ছি একটু একটু করে। মনে হয়, হয়ত বই পড়লে ঠিক হয়ে যাবে। এমন সময় একটার পর একটা বই পরিবর্তন করতে থাকি, কিন্তু কোনটাতেই মন বসাতে পারি না। মানুষ দুইটা জিনিস ভুলে যায় না। একটা তার ভাললাগা, আর অন্যটা হল সেই ভাললাগা থেকে যখন খারাপ লাগার জন্ম হয়। প্রথমটা ভুলে যাওয়া সহজ কিন্তু পরেরটা না। অনেকটা অপারেশনের মত। কষ্ট একসময় দূর হয়ে যায় কিন্তু কাঁটা দাগটা শরীরে রয়ে যায়। ঐ দাগ দেখলে মনে পড়ে যায় এক সময় অসুখটা শরীরে ছিল। আমার যে কেন এমন হয় সেটা সংজ্ঞায়িত আমি নিজেই করতে পারিনি। মনে মনে খুব ছটফট করতে থাকি। একসময় ক্লান্ত হয়ে যাই। মনে হয় কোন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
সমস্যাটা আমার নতুন কিছু না। আগেও হত এখনও হয়। কিন্তু আমি কাউকে সেটা বলি না। কারণ এর কোন সমাধান নেই যে। সমাধান আমি নিজেও খুঁজি না। ব্যর্থ শ্রম। এমন সময় মাঝে মাঝে লেখালিখির চেষ্টা করে দেখেছি। কিছুই লিখতে পারিনি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত একের পর এক কবিতার লাইন আছড়ে পড়তে থাকে কিন্তু সেগুলা পঙক্তিতে রূপায়িত করতে পারিনা। এটাও মনের উপরে বাড়তি চাপ ফেলে। পরে যখন আবার পঙক্তিগুলো আবার মনে করার চেষ্টা করি, আর মনে পড়ে না। যে স্রোত একবার তীরে আছড়ে পড়ে, তাকে কি আর পূর্বরূপে ফেরত আনা যায়? এমন অবস্থা যখন মনে তৈরি হয়, আমি নিজের থেকে তখন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাই। মনে হয় কোথাও পালিয়ে যাই, যেখানে আমার চেনা সত্ত্বাটা আমার এই পার্থিব শরীরকে আর খুঁজে পাবে না। সম্ভবের পরিসীমায় পৌঁছুতে পারি কিনা জানি না, তবে আমি ঘর থেকে বের হয়ে পড়ি। এমনই একদিন ঘর থেকে বের হয়ে পড়েছিলাম। কাউকে কিছু না বলেই। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি কখনও হবে। কোন মাস ঠিক মনে নেই। তবে তখন হুটহাট করে বৃষ্টি হয়। এমনই এক দিনের কথা।
বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় যাব ঠিক করতে পারলাম না। ভাবলাম দূরে কোথাও যাই। একটা বাসে উঠে পড়লাম। সাভারের দিকের কোন একটা বাস হবে। বাসটা যত আমার পরিচিত শহর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল ততই যেন আমার মনের ভেতর থেকে গুমট ভাব কমে আসছিল। পথে যেতে যেতে ভাবলাম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় সামনেই পড়বে। ওখানেই নেমে পড়বো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রাঙ্গন আমাকে সবসময় খুব টানে। ঢাকার খুব কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা থেকে কতই না যেন আলাদা ধাঁচের! এর প্রকৃতি আর গাছপালার সমাহার নিঃসন্দেহে অনবদ্য। নেমে পড়লাম মূল ফটকে। দূপুর হয়ে গেছিলো। পেটের মধ্যে ক্ষুধাও জানান দিচ্ছিল তার স্বীয় সৌকর্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার খাবারের কথা আগেই শুনেছিলাম। ভাবলাম খেয়েই দেখি। এটাই আমার প্রথম জাহাঙ্গীর নগরের ক্যাম্পাস দেখা। মন খারাপের একটা ভাব নিয়ে গেছিলাম কিন্তু আসার পরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমার একাকীত্ব মনে হল অনেকটাই কমে গেছে। রিক্সা করে চলে গেলাম বটতলার কাছে। অনেক দোকান খাবারের পশরা সাজিয়ে রেখেছে। বটতলার কাছেই ছিল বঙ্গবন্ধু হল। হলের মসজিদে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আমার মন যখন বিক্ষিপ্ত থাকে তখন সৃষ্টিকর্তার ধ্যান মনে অপার্থিব প্রশান্তি এনে দেয়।
যখন গিয়েছিলাম, তখন ওখানে আমার পরিচিত কেউ ছিল না। আশেপাশের সবাইকে অচেনাই মনে হচ্ছিল। কাউকে চিনি না যে! কিন্তু এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আমার অনেক বেশী পরিচিতি। অনেকবার গিয়েছি এরপরে। কারণ এখানে এখন আমার অতি আদর আর ভালবাসার একঝাঁক ছোটভাই আছে। ওরা এখন ছাত্র। ওদের মায়ায়, ওদেরকে দেখতেই আমার বারবার এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মানুষের সত্যিকারের ভালবাসাকে অতিক্রম করে যাওয়া যায় না। আমিও পারি না। তাইতো আমার ছোট ছোট এই ভাইদের ভালবাসায় আটকে যাই বারবার।
মসজিদ থেকে বের হয়ে বটতলার এক দোকানে খেয়ে নিলাম। দেখলাম আকাশে কিছুটা মেঘ করেছে। একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম আর বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম। আকাশ এজন্য দেখিনি যে, বৃষ্টি এলে আমি বিপদে পড়ে যাব, ছাতা তো নেই! বরং এজন্য তাকাচ্ছিলাম যে কতক্ষণে বৃষ্টি আসবে। এসেও গেল বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টি! ঢালু রাস্তা দিয়ে পানির রীতিমত ঢল নেমে এল। আমার মনে হল বৃষ্টিতে নেমে যাই। নামলাম না। আমার হঠাৎ করে সুপ্রভার কথা মনে এল! সুপ্রভা বৃষ্টি নিয়ে বাজী ধরে জিতে গিয়েছিল। আজও সুপ্রভা জিতে গেছে। সেটাই বারবার মনে হচ্ছিল। মনে মনে একটি কবিতার কথা চিন্তা করছিলাম। সেটার কিছু পঙক্তি মাথায় একের পর এক এসেও গিয়েছিল। মনে মনে নিজেই আবৃত্তি করে চললাম। ভাবলাম বাসায় এসে লিখে ফেলবো। কতিদন পার হয়ে গেছে। সুপ্রভাকে উৎসর্গ করে মনে মনে যে কবিতাটি লিখে রেখেছিলাম, সেটা আজও অনুক্ত রয়ে গেছে।