২৬ নভেম্বর ২০১৯

ড্রয়িং বা ছবি আঁকা ব্যাপারটা আমার কাছে বরাবরই ভীষণ ভীতিকর একটা ব্যাপার ছিল। আমি কখনই ভাল করে ছবি আঁকতে পারি না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সব প্র্যাকটিক্যালের ছবি আমাকে আব্বু এঁকে দিত। কিছুটা ছবি আঁকার ভয়ে এবং কিছুটা অদম্য এঞ্জিনিয়ার হবার বাসনায় উচ্চ মাধ্যমিকে আর বায়োলজি নিলাম না। কারণ বায়োলজিতে তে প্রচুর ছবি আঁকতে হয়। কিন্তু সেই ক্লাস টু থেকে ক্লাস এইট অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ছবি আঁকা থেকে আমার মুক্তি ছিল না। কারণ ড্রয়িং একটা বাধ্যতামূলক সাবজেক্ট ছিল প্রতি ক্লাসেই। আঁকতে ভাল লাগতো না, রঙ করতে তো একদমই না। নিজে পারতাম না ঠিক, কিন্তু অন্যের আঁকা ছবি দেখতে কিন্তু ভালই লাগতো।

 

ক্লাস সিক্সে আমি গবর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরী হাই স্কুল (ঢাকা) তে ভর্তি হই ১৯৯৪ সালে। কি ফ্যাসাদ! এখানেও দেখি ড্রয়িং! আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম কবে ক্লাস নাইনে উঠবো! কারণ ড্রয়িং ছিল ক্লাস এইট পর্যন্তই। ড্রইং ক্লাসে স্কুলে আমার মনে পড়ে না, ড্রয়িং স্যার কোনদিন কোনকিছু শিখিয়েছিলেন। ক্লাসে ঢুকেই উনি কোন না কোন কিছু এটা ওটা আঁকতে বলতেন। এরপর হয় বসে থাকতেন না হয় ক্লাসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতেন। একসময় ঘন্টা পড়ে যেত, স্যার চলে যেতেন। সিলেবাস বুকলেটে তো দেয়াই থাকতো কি কি জিনিস আঁকতে হবে। ড্রয়িং এর টপিক গুলোর মধ্যে খুব কমন আইটেম যা আমি সবগুলো ক্লাসেই করেছি তা হল ‘টেক্সটাইলের নকশা’ আর ‘ফুলদানি সহ ফুল’। একবার ছিল ‘বনভোজনের দৃশ্য’, কোন এক পরীক্ষায়। আমার পছন্দের বিষয় ছিল, টেক্সটাইলের নকশা। স্কেল দিয়ে দাগ টেনে কতগুলো বর্গক্ষেত্র এঁকে, কর্ণ বরাবর আর বাহুর মধ্যবিন্দুগুলো যোগ করে প্রত্যেক বর্গক্ষেত্রকে সমান ক্ষেত্রফলের ৮ টা ত্রিভুজে ভাগ করে এরপর এক এক ঘরে এক একটা রঙের পেন্সিল ঘসে দিতাম। ব্যস হয়ে গেল আমার অনবদ্য টেক্সটাইলের নকশা। চারু ও কারু বিভাগ থেকে আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর লিখতে হত। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন একবার ফ্রান্সে গিয়ে কি বিপদে পড়েছিলেন তার বিষদ বিবরণ। রেস্তোরার বেয়ারারা কেউ ইংরেজী বোঝে না আর শিল্পাচার্য বোঝেন না ফরাসী। পরে উনি কাগজে ছবি এঁকে মুরগী, ডিম এঁকে বুঝিয়েছিলেন কি খাবেন। আর গরু, শুকর এঁকে কেঁটে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন সেটা খাবেন না। এরপর থেকে শিল্পাচার্যের খাবারের ঝামেলা মিটে গিয়েছিল। আর গুহা মানবরা যে তাদের গুহার ভেতরে নানা রকমের ছবি এঁকে রাখতো, সেসব কথার ইতিহাসও আমাদের ড্রয়িং পরীক্ষায় লিখতে হত। এক বিভাগ ছিল লিখিত, আরেক বিভাগে ছবি এঁকে রঙ করা। দ্বিতীয় বিভাগটাই ছিল আমার আতঙ্কের নাম। তবে টেক্সটাইলের নকশাটাই যা একটু স্বস্তির কারণ ছিল।

 

ক্লাসে সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার ড্রয়িং পরীক্ষা চলছে। আমার পাশের বেঞ্চে বসেছে বন্ধু রিয়াদ। যেমন তুখোড় ভাল ছাত্র ছিল, তেমনই ছিল ওর আঁকার হাত। বন্ধু রিয়াদ এখন কোথায় যে আছে! স্কুল পাস করার পর ওকে আর দেখিনি। আমি যখন শিল্পাচার্যের মুরগী আর ডিম খাওয়ার কথা লিখছি, তখন দেখি বন্ধু রিয়াদ প্রাণপণ রঙ পেন্সিল ঘষে পিকনিকের দৃশ্যের ছবি এঁকে সেটা রঙ করছে। রিয়াদের আঁকা সেই ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে। এত অপূর্ব এঁকেছিল। ওর চিন্তাধারা একটু অন্যরকমের ছিল। ও শুধু ছেলেমেয়ে আর হাড়িপাতিলের ছবিই আঁকেনি বরং একটা সুন্দর বাসের ছবি এঁকেছিল। পিকনিকে যাবার জন্য বাস তো আসলেই একটা অপরিহার্য পরিবহন। বন্ধু রিয়াদ, পৃথিবির যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ওর জন্য মন থেকে প্রার্থনা করি, ওর সারা জীবন যেন ওর ছবিগুলোর মতই সুন্দর হয়।

 

তখন আমি জীবনের শেষ ড্রয়িং পরীক্ষা দিচ্ছি। ক্লাস এইটে, স্মৃতিময় ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে। ঠান্ডায় আঙ্গুল জমে যাচ্ছে। এর মধ্যেই লিখতে হচ্ছে গুহামানবের ছবি আঁকার কথা। এরপরে আঁকতে বসলাম ফুলদানিতে একগুচ্ছ ফুল! পুরা পৃষ্টার একদম মাঝখানে আমি ছোট পরিসরে কিছু একটা হাস্যকর ফুলদানী আর ফুল আঁকার চেষ্টা করছিলাম। আমার পাশে সম্ভবত ক্লাস সিক্সের একটা ছেলে বসেছিল। ওর ছিল আরবী সাহিত্যের পরীক্ষা। আমি আরবী সাহিত্যে মোটামুটি ভালই ছিলাম। সেই কাহিনী অন্য কোনদিন বলব। ছেলেটা আমাকে কোন একটা শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিল। সেটা বলে দিতেই ওর চোখ গেল আমার ফুলদানির দিকে। বললো, ভাইয়া করেছেন কি? এ কেমন ছবি? আমি বললাম, আমি ভাল আঁকতে পারি না। ছেলেটা আমার অবস্থা বুঝে বললো, আপনার খাতাটা আমাকে দেন। আমি এঁকে দিচ্ছি বড় করে। আপনি শুধু আমার বাক্য রচনাগুলো একটু করে দেন। আমরা আস্তে করে খাতা অদল বদল করে ফেললাম ইনভিজিলেটর স্যারের চোখ এড়ায়ে। স্যার খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে ছিলেন। যেহেতু ড্রয়িং আর আরবী সাহিত্য, এখানে উনার কঠোর হবার মত কোন ঘটনা ছিল না। আর ওটাই ছিল শেষ পরীক্ষা। আমি ছেলেটার আরবী বাক্য রচনা করে দিলাম, আর ও আমার পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে এঁকে দিল সুন্দর একটা ফুলদানী আর তাতে একগোছা ফুল। ছোটভাই, তোমার চেহারা আর নাম কোনটাই আর মনে পড়ে না। তুমি যেখানেই থাকো না কেন, তোমার জীবন ফুলের মতই প্রস্ফুটিত, সৌরভময় হোক।  

View shawon1982's Full Portfolio