আজ কথা সাহিত্যিক ডঃ হুমায়ূন আহমেদ এর জন্মদিন। ক্ষণজন্মা এক মানুষ! উনাকে আমি সাহিত্যিকই বললাম। আগে ‘জনপ্রিয়’ কথাটা উল্লেখ করলাম না। কারণ উনি এমন একজন সাহিত্যিক যিনি সরাসরি মানুষের মনের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন। যাকে মানুষ তাদের মনের ভেতর একান্তে ভালবাসার জায়গায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছে, তাকে আমার কি দুঃসাধ্য ‘জনপ্রিয়’ নামক চার অক্ষরের একটা শব্দ দিয়ে সীমাবদ্ধ করে দেই? উনি একটা দেশের শিক্ষিত মানুষকে বইমুখী করতে পেরেছিলেন। সাহিত্যের যে জায়গায় হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়ে দিয়েছেন অবিসংবাদিত ভাবে। উনি অতুলনীয় একজন সাহিত্যিক, একজন মানুষ। নব্বইয়ের দশকের যুবশ্রেণীকে বইমুখী করে দেখিয়েছেন উনি। নব্বইয়ের দশকে আমি তো স্কুলের ছাত্র। বই মেলায় যেতামই ‘হুমায়ূন আহমেদ’ এর বই কেনার জন্য। এত বড় মাপের একজন মানুষ, যারা আমরা উনার সম্পর্কে জানি, উনার শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে জানি, আমরাও উনার নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে ভুলেই যাই উনি একজন অধ্যাপক ছিলেন এবং ‘পলিমার রসায়ন’ এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উনার পি.এইচ.ডি ডিগ্রিও ছিল। আমি সেজন্যই উনার নামের আগে আজকে ডক্টর এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ডঃ’ লিখেছি। উনি প্রমাণ করেছেন, আগাগোড়া বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও সাহিত্যের উৎকর্ষে ওঠা যায়। ডঃ হুমায়ূন আহমেদ তার অতুলনীয় লেখনীর মাধ্যমে আমাকে শিখিয়েছেন, ‘বিজ্ঞান’ পড়ুয়া মানেই বেরসিক না, বরং বিজ্ঞান পড়েও সাহিত্যিক হওয়া যায়, সাহিত্যকে ভালোবাসা যায়। সমগ্র আত্মা নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা ভালোবাসা জানাচ্ছি এই মহান মানুষটিকে। জাগতিক শরীর নিয়ে হয়ত আমাদের চোখের সামনে উনি উপস্থিত নেই, কিন্তু উনার প্রতিটি লেখনী এতটাই জীবন্ত, এতটাই প্রকট যে, কখনও মনে হয় না এই মহান সাহিত্যিক আমাদের ধরাধামে আর নেই।
আমার ক্ষুদ্র চিন্তায় বা লেখনীর মাধ্যমে আমি এই মহান ব্যক্তিত্বের কোন আলোচনা আসলেই করতে সক্ষম নই। সেই যোগ্যতাই নেই যে। নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশের কোন মানুষ মনে হয় “কোথাও কেউ নেই” নাটকের কথা ভুলবে না। একটা নাটক যা পুরো জাতিকে আলোড়িত করে দিয়েছি। ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘নক্ষত্রের রাত’ এর মত আরো কত কত জনপ্রিয় নাটকের রূপকার তিনি। কোনটাই কি ভোলার মত? ইউটিউব ঘেটে ঘেটে এখনও প্রতিনিয়ত ডঃ হুমায়ূন আহমেদের নাটক, সিনেমাগুলো খুঁজে খুঁজে দেখি। বারবার দেখি। আগে দেখেছি, তবুও যেন নতুন করে ধরা দেয়। দেখতে ভাল লাগে। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের কোন এক পর্ব দেখতে গিয়ে দুই মিনিটের ব্যবধানে এমন দৃশ্যের অবতারণা করেছেন যে প্রথমে কেঁদে ফেলেছি, কিন্তু চোখের পানি শুকাতে না শুকাতেই আবার হাসতে বাধ্য করেছেন। এমনইতো ছিলেন আমাদের হুমায়ূন আহমেদ! এই কাঁদাচ্ছেন তো আবার হাসতে বাধ্য করছেন। আমাদের জীবনের হুবহু প্রতিফলন ঘটিয়েছেন প্রতিটি দৃশ্যে। উনার লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার কাছে মনে হয় উনার লেখার ‘ইনফর্মাল স্টাইল’। আমরা ঠিক যেভাবে চিন্তা করি, উনি উনার লেখনীতে ঠিক হুবহু সেই কথাই তুলে ধরেছেন। উনার লেখা উপন্যাস পড়লে প্রতিটি চরিত্র এমনভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন মনে হয়, ঘটনাগুলো তো আমি নিজেই দেখেছি, অথবা এই মানুষগুলো তো সব আমার আশেপাশেই রয়েছেন। খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা যে সব বিষয় লেখনীতে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন, সেগুলোই ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখনীতে জীবন্ত হয়েছে। গ্রাম হোক বা শহর, যে কোন লেখনীই যেন আমাদের বাস্তব জীবনের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। ‘তেঁতুল বনে জোছনা’ বইয়ের একটা কথা আমার খুব মনে পড়ে-‘হারামজাদি মরা পাখি শুধু দেখল। মরা পাখির পেছনের ভালবাসাটা দেখল না’।
আমার শৈশবের উপন্যাস পড়ার শুরুও ডঃ হুমায়ূন আহমেদের বই থেকে। প্রথম উপন্যাস পড়েছি ‘বোতল ভূত’। আরেকটা বই পড়েছিলাম ‘ভূত ভূতং ভূতৌ’ নামে। সেই বইয়ের একটা ভূতের নাম উনি দিয়েছিয়েন ‘ৎৎঘুঁউউৎ’ এই জাতীয় কিছু। ভীষণ অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এটা উচ্চারণ করবো কিভাবে? ‘ৎ’ দিয়ে যে শব্দ শুরু করা যায়, আর এই কারণে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাতে পারে, সেটা আমি সেদিন উনার বই পড়ে শিখেছিলাম। একটা হোমিওপ্যাথের শিশি নিয়ে তার মধ্যে কয়েলের খানিক ধোঁয়া ভরে একটা ‘বোতল ভূত’ বানানোর চেষ্টাও আমি করেছিলাম। এতো গেল শৈশবের কথা। কৈশোরে এসেও কি থেমে ছিল? একের পর এক পড়ছি উনার লেখা উপন্যাস। বই পড়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে তৈরী হয়ে গেল। বন্ধুবান্ধব, কাজিন সবার সাথে আলোচনা হত এসব বইতে কি পড়েছি না পড়েছি নিয়ে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ‘হিমু’ চরিত্রটা আমাদের কাছে প্রিয় হয়ে গেল। হিমুর উদ্ভট সব কর্মকান্ড পড়তাম আর অবাক হয়ে ভাবতাম, আচ্ছা! এসব তো আমরাই চিন্তা করি। উনি আমাদের মনের কথা জানলেন কিভাবে? হিমুর একটা বইতে আছে, হিমু রূপাদের বাসায় ফোন করে। ফোন ধরে রূপার বাবা। হিমু বলে “হ্যালো! এটা কি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন?”। যতদূর মনে পড়ে এমনটা ছিল। অথবা বলে, “হ্যালো এটা কি ফায়ার সার্ভিস?”। মনের মধ্যে গেঁথে গেল। ভার্সিটির তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার এক বান্ধবীর বাসায় ফোন দিয়ে বললাম, ‘হ্যালো! এটা কি ফায়ার সার্ভিস?” ও বুঝতে পেরে সাথে সাথে উত্তর দিল, “হ্যা! কেন আপনার কি মনে আগুন লেগেছে”?
একবার আমরা কতিপয় কাজিনরা মিলে একটা হাতে লেখা ম্যাগাজিন এর মত বের করেছিলাম। সেটা পুরোটাই ছিল ডঃ হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন লেখা হতে অনুপ্রাণিত হয়ে। সোজা কথায় উনাকে নকল করে। আমরা কাজিনরা তখন এক হলেই রাত জেগে জেগে কত কত দুষ্টুমি যে করেছি। দুই একটি ঘটনা আমি কিছুটা শেয়ার করছি। তখনো মোবাইলের যুগ শুরু হয়নি। ল্যান্ড লাইনটাই ভরসা। আমি আর আমার কাজিন সৌরভ (ছদ্মনাম) প্রায় একই বয়সী। তখন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। রাত একটার দিকে আমাকে বললো, দাঁড়াও ফোন (কর্ডলেস) নিয়ে আসি। আমি বললাম কি করবা? বললো, উলটা পালটা নাম্বারে কল দিবো! আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। বলে কি! কর্ডলেস এনে সৌরভ নির্বিকার ভঙ্গিতে একটা নাম্বারে কল দিল। যা মনে আসলো তাই দিল। ঘুম জড়ানো কন্ঠে একজন ভদ্রমহিলা ফোন ধরলেন। সৌরভ নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো, ভাবী আমি পলাশ। ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা পলাশ নামক কাউকে চিনলেন কিনা জানি না। সৌরভ বললো, ভাবী, মা’র অবস্থা তো বেশী সুবিধার না, মা’কে হসপিটালে নেয়া হয়েছে। ভদ্রমহিলা কি বুঝলেন জানি না, আদৌ পলাশ নামে কাউকে চিনলেন কিনা তাও জানি না, ওপাশ থেকে হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলেন। সৌরভ বলল, ভাবী চিন্তা করবেন না, এখন অবস্থা ভাল। এই বলে নির্বিকার ভঙ্গিতে ফোন কেটে দিয়ে আবার আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করতে লাগলো! আমি তখন মাটিতে পড়াগড়ি যাচ্ছি প্রায় হাসতে হাসতে!
আমার আরেক কাজিন মিশু আপা (ছদ্মনাম) আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। আপা তখনই ভার্সিটিতে পড়েন। আমি পড়ি স্কুলে। একদিন আপাদের বাসায় ছিলাম রাতে। রাত জেগে জেগে গল্প করছি আর চা খাচ্ছি। তখন উনিও উনাদের কর্ডলেস ফোন নিয়ে আসলেন। হাতে একটা লাল রঙের লিফলেট! এই লিফলেট এর ইতিহাস একটু না বললেই নয়। তখনকার দিলে অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকেই এসব বেশী দেখতাম। পাবলিক বাসগুলা ফার্মগেট বা মিরপুর দশ নাম্বার গোলচক্করে বা গুলিস্তানে থামলেই কোন কোন লোক বা বোরকা পরা কিছু মহিলা লিফলেট বাসের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিত যাত্রীদের গায়ে। কতিপয় হার্বাল, ইউনানী, আয়ুর্বেদ ওষুধের বিজ্ঞাপন থাকতো আর সেইসব ওষুধ যে সব বিশেষ(!) বিশেষ রোগের মহৌষধ সেসবের নাম লেখা থাকতো। সেগুলোর মধ্যে সবই হচ্ছে মারাত্মর রকমের যৌনব্যাধি। সিফিলিস, গনোরিয়া থেকে শুরু করে এমন এমন কিছু বিষয়ের বর্ণনা সেসব লিফলেটে থাকতো যেগুলো আমার পক্ষে এখানে লেখা সম্ভব হয়। মিশু আপার হাতে ঠিক সেইসব লিফলেটের একটা কপি। উনিও নির্বিকার মুখে একটা নাম্বারে ডায়াল করলেন। একজন লোক ঘুম ভেঙ্গে ফোন ধরল। মিশু আপা টেলিফোন অপারেটরদের মত যান্ত্রিক ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে লিফলেটে উল্লেখিত যাবতীয় রোগের বর্ণনা পড়ে যেতে থাকলো। আপনার কি এই সমস্যা? ঐ সমস্যা? তাহলে জলদি চলে আসুন...! আপনারাই চিন্তা করেন, মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে কোন লোক যদি কোন মেয়ের সুললিত কন্ঠে জটিল কঠিন কোন রোগের বর্ণনা শুনতে থাকে, তাহলে তার মনের পরিস্থিতি কি হতে পারে? আর আমার অবস্থা? আপনারাই চিন্তা করে নিন।
এখন সেই সময় থেকে প্রায় বিশ পঁচিশ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা অনেক বড়ো হয়ে গেছি। কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি। এখন এসব দুষ্টুমি আর করি না। কিন্ত মনে তো পড়েই। একা একাই হাসি। হাসতে হাসতে মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠে যায়। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যায়। কাউকে বলতেও পারি না যে আসলে কি মনে করে হাসতেসি! অল্পবয়সের দোষে এমন কাজ করেছি। সেজন্য এখন বড় হয়ে সর্বান্তকরণে ক্ষমাপ্রার্থী। শুরু করেছিলাম ডঃ হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে। মাঝখানে আমাদের টেলিফোন বিষয়ক কিছু দুষ্টুমির উপাখ্যান তুলে ধরলাম। এর মানে কিন্তু এই না যে এসব আমরা হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে শিখেছি। হুমায়ূন আহমেদ তার জীবন্ত সব লেখা দিয়ে আমার জীবনে সবসময় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।