জীবনে বহুবার বহুকিছুই হতে চেয়েছি। কখনো ভেবেছি ডাক্তার হব। আমাকে ডাক্তার হতেই হবে। পরে আবিস্কার করলাম মানুষের কাঁটা ছেড়া সহ্য করতে পারি না। কাজেই ডাক্তার হবার চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হল। এরপর এঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছি। স্রষ্টার অপার কৃপায় হয়েছি। এঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শেষ বর্ষে ২০০৭ এ নানুবাড়িতে বেড়াতে গেছি। নভেম্বর মাস হবে হয়ত। মনে নেই তেমন একটা। পেপার হাতে নিয়ে দেখলাম বৃটিশ সাহিত্যিক Doris Lessing কে নিয়ে ফিচার লিখেছে। ওইবছর উনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী বয়সের সাহিত্যিক যিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। নোবেল সাইটেসনে ইনাকে বলা হয়েছে ‘নারী অভিজ্ঞতার মহাকবি’। খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম উনার সাক্ষাতকার নানুর খাটে বসে। নিজের লেখালিখি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘নিজেকে লিখতে বাধ্য করি’। বেশ মনে ধরলো কথাটা। ব্যক্তিজীবনে খুব বেশী লেখাপড়া করতে পারেননি। কিন্তু লিখতে লিখতে নিজেকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে নিয়ে গেছেন। ভাবতেই ভাল লাগছিল।
আমার বাবা তখন লন্ডন বেড়াতে গিয়েছিলেন। পেপার থেকে জানলাম Doris Lessing এর অন্যতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস হল The Grass is Singing। বাবাকে ফোনে বললাম, বইটা কিনে আনার জন্য। বইটা এখনও আমার ব্যক্তিগত সংরহে শোভা পাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল; কিন্তু লেখালিখিতে তেমন নয়। কিন্তু Doris Lessing এর কথা জানার পর থেকেই মনে হতে লাগলো একটু লেখালিখি করেই দেখি না। লেখক আমি হতে পারবো না জানি, কিন্তু লেখাগুলো তো রয়ে যাবে। একটা ফ্রি ওয়েবসাইটে নিজের টুকটাক লেখা জমাতে লাগলাম। শুরু করেছিলাম কিছু ইংলিশ কবিতা দিয়ে। একদম আমার নিজের মত করেই। লিখি, ওয়েবসাইটে দেই। দেখতে ভালই লাগে। এর আগে কিছু বাংলায় লিখেছিলাম ছড়া। যেগুলো দৈনিক জনকন্ঠের ছড়া প্রতিযোগিতার জন্য মূলত লিখতাম। সেগুলো একটা ডায়রীতে লেখা ছিল। তখনও বাংলা টাইপিং এর সাথে অভ্যস্ত ছিলাম না। তাই বাংলাতে লেখাগুলো ওয়েবসাইটে দিতে পারিনি। পরে অবশ্য সিঙ্গাপুরে গিয়ে সব টাইপ করে করে দিয়েছি।
এখনো সময় পেলে নিজের মত করে লিখি। যা মনে আসে তাই লিখি। নিজেকে এই একটি মাত্র যায়গায় খুব স্বাধীন মনে হয়। আমার এটাও মনে হয়, আমার লেখালিখি একান্তই আমার। আমার নিজস্ব একটা ভুবন। এখানে আমার কোন জবাবদিহিতা নেই। আমি তো দেশ, সমাজ বা ধর্ম বিরোধী কিছু করছি না বা লিখছি না। যা লিখছি তা একান্তই নিজের একাকীত্ব, ভাল লাগা, মন্দ লাগা থেকে লিখছি। কেউ পড়লো কি না পড়লো সেটা নিয়ে ভাবলে কি আর লেখালিখি করা চলে? রাতারাতি তো সবকিছু হয়ে যায় না। সবকিছুই তো সময়ের গন্ডিতে বাঁধা থাকে। ঠিক আমাদের জীবনের মতই। নিজের মত করে লিখি কিন্তু কখনই নিজেকে লেখক বা কবি ভাবার ধৃষ্টতা দেখাইনি। একক কোন প্রকাশনা করার কথা এখন পর্যন্ত চিন্তা করি নি। অন্যান্য লেখক বন্ধুদের সাথে সঙ্কলনে কিছু কিছু লেখা প্রকাশ করেছি। ওই পর্যন্তই।
আমার এই লেখার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নিজেকে শুধু চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় জীবনের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা নয়। লেহ্য-পেয় জীবন ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। মানুষের চিন্তাধার কোন শেষ নেই। মনকে কোন গন্ডিতে আটকে রাখা যায় না। নিজের মনের মুক্তি নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। কারণ আমার মন যে একান্তই আমার নিজস্ব। এখানে তো কারো অনুপ্রবেশ নেই। মাঝে মাঝে মনের টানেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফিরে ফিরে আসি। কবিগুরুর ভাষায় মন বার বার বলে ওঠে-
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
এই আকাশে-
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে
এই আকাশে...”
নিজের মনেই গুনগুন করি আর নিজেকে হারিয়ে ফেলি। ডুবে যাই এক অমোঘ দুর্নিবার আকর্ষণ নিয়ে আমার লেখালিখির জগতে। নিজেকে খুঁজে পেতে চাই এক অসীমের মধ্যে। আমি জানি আমি সসীম, কিন্তু আমি অসীমের অংশ তো বটে!
আমার লেখালিখি নিয়ে আমার আকান্ত ঘনিষ্টজন বা পরিবারের কোন আগ্রহ নেই। আজ পর্যন্ত দেখিনি। এমনকি আমার বাবা মায়ের মধ্যেও নয়। দুই একবার জোর করে দুই একটা লেখা পড়িয়েছি। খুব অনাগ্রহ না দেখালেও তেমন কোন উৎসাহ আমি উনাদের ভেতর দেখিনি। একটা ওয়েবসাইটে লেখালিখি করে কয়েকদফা পুরস্কার ও পেয়েছি। সেগুলো আমারই মনে থাকে না। উনারা মনে রাখবেন সেটাও আশা করি না। তবুও লিখি। নিজের জন্য লিখি। facebook এ মাঝে মাঝে কিছু পোষ্ট দেই। যাদের মন চায় দেখে, মন্তব্য করে, আমিও উত্তর দেই। আমি এমন কোন বিখ্যাত সেলিব্রিটি নই যে সোশ্যাল মিডিয়াতে দুই একটি লেখা লিখে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব। কি লাভ এমন ধারণা পোষণ করে? লেখালিখিকে যদি বাণিজ্যের পর্যায়ে নামিয়ে ফেলি, তাহলে আমার মনের মুক্তি কোথায় গেল? সেই তো সেই চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গন্ডির ভেতরে নিজের লেখাগুলোকে আবর্জনায় নিক্ষেপ করলাম!
এখন তো অনেকের ধারণা সোশ্যাল মিডিয়াতে যে যত Like নামক বস্তুটি অর্জন করতে পারেন সে তত বিখ্যাত! কত ছোট আর নীচু মানের ধারণা! কে Like দিল বা না দিল তাতে একজনের লেখার দর্শন পালটে যাবে? যারা Like দেন, তাদের কয়জন লেখার মান যাচাই করার ক্ষমতা রাখেন? কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলি’র মুখবন্ধ লিখেছিলেন আরেক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক W. B. Yeats। কবিগুরু ১৯১৩ তে নোবেল পুরস্কার পাবার পরেও সেই কবি Yeats ই কঠোর সমালোচনা করেছিলেন সেই গীতাঞ্জলি নিয়েই। বিশ্ববরেন্য সাহিত্যিকরা যখন লেখেন, তখন কি Like পাওয়ার জন্য লিখেছিলেন? খুব হাস্যকর হয়ে গেল না কথাটা? যারা সাহিত্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞানও রাখে না, তারাই যখন কোন লেখার কঠোর সমালোচনা করতে আসেন, তখন কি সেটা নিদারুণ অপচর্চা হয়ে গেল না? এমন তো শুধু তারাই করতে পারে, যাদের মন সবসময় ‘চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’ নামক একটা সীমাবদ্ধ গন্ডিতে আবদ্ধ থাকে। লেহ্য-পেয় গন্ডির বাইরে আর যাদের কোন জীবন নেই।