অর্থনীতিতে ১৯৯৮ সালে নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যখন নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। উনি উনার এক সাক্ষাতকারে নিজের নামের বানান সম্পর্কে বলেছিলেন। উনার এই নাম আরেক নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া। নামটি দেয়ার সময় কবিগুরু অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের সন্মানিতা মা’কে বলেছিলেন, ‘নামের শেষে য-ফলা টা দিস কিন্তু’! শুধু তখন থেকেই নয় বরং আরো আগে থেকেই আমার য-ফলার প্রতি কেন যেন একটা বিশেষ দূর্বলতা কাজ করে। এর কোন বিশেষ কারণ ব্যাখ্যাতীত। সম্প্রতি আমি এক কন্যা সন্তানের পরে এক পুত্র সন্তানের জনক হয়েছি। ছেলেটা জন্মানোর আগে থেকেই আমার মনে মনে নাম ঠিক করা ছিল। ছেলে হলে এই নাম আর মেয়ে হলে এটা। আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, যদি আমার ছেলে হয় তাহলে কিন্তু আমি একটা বিশেষ ডাকনাম ও রাখবো। আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলাম ‘অনিন্দ্য’। এই বাংলা শব্দটার প্রতি আমার দূর্বলতা শুধু ঐ য-ফলার জন্যই নয় বরং এর অর্থটাও আমার মনকে টানে। য-ফলাটাকে এখানে সোনায় সোহাগা আখ্যান দেয়া যেতে পারে। যে কথা সেই কাজ। ছেলে হল। আমাদের দেশীয় মুসলমানদের প্রচলিত রীতি অনুসারে আমি ছেলেটার একটা আরবী নাম রাখলাম, নবীজীর এক সহচর (সাহাবী) এর নামানুসারে, আর সেই সাথে বাংলা শব্দের ডাকনাম ‘অনিন্দ্য’ রাখলাম। ব্যস এরপর শুরু হয়ে গেল মন্তব্যের পর মন্তব্য। কাউকে বোঝাতে পারলাম, কাউকে পারলাম না। সেক্ষেত্রে বলতে হয়, কেউ যদি না বোঝে, আমার কিছু করার নেই।
‘অনিন্দ্য’ কোন নাম হল? এটা তো হিন্দুদের নাম! প্রথমেই আমাকে এই মন্তব্য শুনতে হল ঘরের মানুষের কাছ থেকেই। আমি বললাম, আমার ডাক নাম টা খেয়াল কর। ‘শাওন’ এটাও তো একটা বাংলা শব্দ। এই নাম ছেলে মেয়ে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান সবাই রাখে। শাওন আহমেদ, শাওন ইসলাম, শাওন ঘোষ, শাওন বন্দ্যোপাধ্যায়, শাওন অধিকারী, শাওন গোমেজ, শাওন বড়ুয়া আরো কত কি! তাহলে অনিন্দ্যতে সমস্যা কোথায়? অনিন্দ্য শব্দের অর্থ হল, যার নিন্দা করা যায় না। নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বেশীরভাগই হিন্দু কন্সেপ্ট থেকে সরে আসতে পারলো না। তবে সবাই নয়। কেউ কেউ (যারা বোঝেন) তারা আমার এই বাংলা নামের ও প্রসংশা করলো। বললো দু’টা নামই সুন্দর হয়েছে। যদি ইসলাম ধর্মের অনুসাশনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, বাচ্চাদের সুন্দর অর্থবোধক নাম রাখতে বলা হয়েছে এবং স্বীয় পিতার সাথে সংযুক্ত করে রাখতে নির্দেশনা দেয়া আছে। তাই তো করেছি আমি। এর ব্যত্যয় কোথায় করলাম? আমি বাংলাভাষী মানুষ। জন্মের পর থেকেই বাংলাতেই কথা বলে শিখেছি। বাংলা ভাষাতেই চিন্তা করি। আমি তো আমাদের ধর্মের পাঠ শিক্ষাগুলোও বাংলাতেই বুঝি, বুঝতে হয়। সেই বাংলা কি তাহলে হিন্দুর ভাষা? ভাষার কি কোন জাত ধর্ম আছে? এই একবিংশ শতাব্দীতে বাস করেও আমাদের মন মানসিকতা কি সংকীর্ণ কিছু গন্ডি থেকে উঠে আসতে পারছে না? নাকি আমরাই এর থেকে বের হতে চাইছি না?
ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুলো আরবী ভাষাতে লিপিবদ্ধ কারণ এই ধর্মের প্রচারক, রাসূলুল্লাহ নিজে আরব এবং আরবী ভাষী ছিলেন। রাসূল যদি চায়নাতে জন্মাতেন, তাহলে কি কোরাণ হাদিস আরবীতে পেতাম না চায়নিজ ভাষায়? আরবী ভাষা অন্য ভাষাগুলোর মতই একটি ভাষা। কোরাণের বানী পৃথিবীর সমস্ত ভাষাতেই প্রায় অনুবাদিত হয়েছে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মন্ত্রগুলো সংস্কৃত ভাষায় লিখিত তার মানে কি সংস্কৃত হিন্দুর ভাষা? এটা কোন যুক্তি? কোরানের বাণী যদি সংস্কৃতে অনুবাদ করা হয়, তাহলে কি সেটা হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ হয়ে যাবে? আর গীতা, বেদ, উপনিষদ যদি আরবীতে অনুবাদিত হয় তাহলে সেটাতে কি মুসলমানরা এই জন্য ভক্তি করবে যে সেটা আরবীতে লেখা হয়েছে? আরবী ভাষায় কি অশ্লীল, অশালীন, ধর্মবিরুদ্ধ কথা লেখা যায় না? যদি সেটা কোন কাগজে লেখা থাকে তাহলেও হয়ত অধিকাংশ মানুষ অজ্ঞানতা বসত সেটাতে চুমু খাবে এই ভেবে যে সেটা আরবী অক্ষরে লেখা আছে বলে। এসব আমাদের অজ্ঞতারই নামান্তর।
মাসি, পিসি, জল, স্নান, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দিদি, বৌদি এই বাংলা শব্দগুলো তো শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য মনে হয় আমরা মুসলমানেরা একেবারে বিধিবদ্ধ মনে করে বসে আছি। হিন্দু বিবাহিতা মহিলাদেরকে মুসলমানরা খুব ঘটা করে “বৌদি” বলে সম্মোধন করেণ। কেন, উনাকে কি ‘ভাবী’ বললে মুসলমানদের জাত চলে যাবে? কোন হিন্দু ভদ্রমহিলাকে, ‘আপু’ বা ‘আপা’ ডাকলে সমস্যা কোথায়? কেন তাকে ‘দিদি’ বলে ডাকতে হবে? ভাই, ভাবী, এগুলা এসেছে উর্দু থেকে। আব্বা আম্মা এসেছে আরবী থেকে। তাহলে কি দাঁড়ালো? উর্দু আরবী ফারসী এগুলা মুসলমানের ভাষা, আর বাংলা হিন্দুদের ভাষা? বাংলাদেশের মুসলমানরা মনের ভুলেও পানিকে ‘জল’ বলবে না। কারণ জল শব্দটা উচ্চারণ করলে মনে হয় সাথে সাথে জাত চলে যাবে। সবাই বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাবে। অনেকেই বলে বসবে, তুই কি হিন্দু? পানিকে জল বললি যে? এই প্রশ্নের উত্তর কি হবে? অথচ কলকাতার মুসলমানদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন তো তারা “ফুফু” কে কি বলে? “খালা” কে কি বলে ডাকে? আপনাদের জ্ঞাতার্থে বিনীত ভাবে জানাচ্ছি, কলকাতার মুসলমানরাও মাসি, পিসি, জল, স্নান, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, দিদি, বৌদি এসব শব্দই ব্যবহার করে। এটাই ওদের সংস্কৃতি। সেক্ষেত্রে বলতে হয়, ওরা আমাদের চেয়েও বাংলা ভাষার সন্মান বেশী ছাড়া কম দিচ্ছে না।
এবার আসি উলুধ্বনি প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের কোন মুসলমান উলুধ্বনি দিবে? সর্বনাশ তাহলে তার সমাজচ্যুত হবার আশঙ্কা আছে। কারণ আমরা ধরেই নিয়েই উলুধ্বনি দেয়া শুধুমাত্র হিন্দুদেরই কাজ! মুসলমানদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আমি স্বীকার করছি, প্রচলিত বাঙ্গালী হিন্দুরীতিতে উলুধ্বনিকে মঙ্গলসূচক ধ্বনি হিসেবে ধরা হয়। এই বিশ্বাস তাদের একান্তই নিজস্ব ব্যপার। আপনি আরব রাস্ট্রগুলোর বিয়েশাদী অনুষ্ঠানগুলো একটু দেখুন। আরবদের যে কোন আনন্দময় ব্যাপার প্রকাশের একটা অপরিহার্য অংশ হল মেয়েদের সমস্বরে উলুধ্বনি দেয়া। একদম সেই উলুধ্বনিই যেটা আপনি হয়ত হিন্দুবিয়ে অথবা পুজাতে শুনে এসেছেন। এটা একান্তই আরব সংস্কৃতির অংশ। স্বয়ং রসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন হিজরত করে মদীনার উপপকন্ঠে এসে পৌঁছুলেন তখন উনাকে দেখা মাত্র অপেক্ষারত আনসার মুসলমান পুরুষরা দফ (এক ধরণের ঢোল) বাজালো, মেয়েরা সমস্বরে উলুধ্বনি দিল, আর বাচ্চারা গেয়ে উঠলো আরবের বিখ্যাত নাশীদ/নাত “ত্বলায়াল বাদরু আলাইনা”। এভাবেই সৃস্টিকর্তার প্রিয় দূতকে মদীনাবাসী বরণ করে আপন করে নিল। কই, রাসূল তো কোথাও উলুধ্বনি দিতে নিষেধ করেন নাই! তাহলে, আমরা বাংলাদেশী মুসমলানরা, যারা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ বলে নিজেদের মনে করি, তাদের তো উচিত বিয়েশাদীতে অন্তত ঘটা করে উলুধ্বনি দেয়া। সেটা তো কেউ করছে না। তখন উলুধ্বনি হয়ে যায় হিন্দুদের? কবে আর কবে আমরা এই সংকীর্ণ মনসিকতা থেকে উঠে আসবো?