জীবন যুদ্ধেরই আরেক নাম। যারা অনেক টাকা পয়সার মালিক, তাদেরকে হয়তো যুদ্ধের ভয়াবহতা খুব বেশী পরিমাণে স্পর্শ করে না কিন্তু যারা নিজের শরীরের ঘাম বেচা টাকায় অর্থের স্বাদ গ্রহন করেন, যদিও তা ক্ষণিকের জন্য, তাদের কাছে জীবন এক নরক যেখান থেকে মুক্তি মিলবে একটা উপায়ে- মৃত্যুর মাধ্যমে! সুন্দরবনের মৌয়ালরাও মৃত্যুকে একপ্রকার হাতে নিয়েই বের হন।
একটা বাচ্চাকে যেমন তার মা খুব পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে স্কুলে পাঠায়, সুন্দরবনকেও প্রকৃতি যেন পরম মমতায় এবং অতি আদরযত্নে সঠিক জায়গায় স্থাপন করেছে। নানা রকম সবুজ গাছ গাছগাছালি আর বন্য পশু পাখীর এক স্বর্গীয় মিলনমেলা যেন এই সুন্দরবন!
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের এ অভিযান শুরু হয় পয়লা এপ্রিল থেকে। চলে টানা তিন মাস। দলনেতা শের আলী, যাকে মৌয়ালরা বলেন বহরদার, তার সাতজনের দল নিয়ে প্রস্তুত। শের মানে বাঘ। শের আলীর গায়ে বাঘের মত শক্তি। তার দুর্দান্ত সাহসের জন্য এলাকার সবাই তাকে সম্মান করেন।
সাতজনের মধ্যে মাহফুজ আলী হচ্ছে শের আলীর ভাই। মাহফুজ মৌয়ালদের সাথে মধু আহরণের ইচ্ছায় যাননা। উনি যান কাঠ কাটতে। ওনার সাথে একটা বেশ বড়সড় কুড়াল। তবে তিনি মৌয়ালদের আশেপাশেই থাকেন।
যাইহোক আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবাই মনেমনে আল্লাহর নাম জপতে জপতে রওনা হন। ওনাদের যাত্রার বাহন হচ্ছে নৌকা। নৌকা বাতাস আর পানির সাথে খেলা করে ধীর গতিতে বয়ে চলে। সবাই একদম নিশ্চুপ।
কারো মুখে কোনও কথা নেই। কারণ সবাই খুব ভালো করেই বুঝেন যে সুন্দরবনে বাঘের ভয় নিয়ে মধু আহরণ করা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও জীবিকার তাগিদে তা করতেই হয়। ক্ষুধার কাছে জীবন যেন অসহায় এক ভিক্ষুক!
সুন্দরবনের জলবর্তী অববাহিকা দেখা যাচ্ছে। সেখানে যেন শ্বাসমূলের মেলা বসেছে! অনতিদূরে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা চোখে পড়ে। বলেশ্বর, কুঙ্গা নদীতে যথেষ্ট ইলিশ ধরা পড়ে এ সময়।
তাছাড়া বাগদা, গলদা, কাঁকড়া, পারশে, মাগুর, গুলশা ট্যাংরা, নোনা ট্যাংরা, কই, শিং, পুঁটি, খলসে, চ্যালা ইত্যাদি মাছতো আছেই। সুন্দরবনের যে অংশে বেশ বড় চর পড়েছে সেখানে শের আলী তার দলবল নিয়ে নামেন।
বনের ভিতরে যাত্রা শুরুর আগে সবসময় তারা একটি প্রার্থনা সভা করেন। এর মাধ্যমে প্রভুর কাছে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান। এরপর প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে লাল কাপড় বেঁধে দেয়া হয়। তাদের বিশ্বাস এ কাপড় বিপদ-আপদ, বিশেষ করে বনের রাজার মানে বাঘের হাত থেকে ওনাদের রক্ষা করবে।
সবাই খুব সতর্কতার সাথে বনের মধ্যে প্রবেশ করেন। সবার হাতে দা ও ধামা। মৌচাক খুঁজে পেতে খুব দেরী হয়নি। চাক পেয়ে সবাই একসাথে ‘আল্লাহ আল্লাহ বলরে’ বলতে থাকেন।
শের আলী চাক ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কাজ শুরুর আগে একটু দেখে নেন যে চাকটি আগের কাটা কিনা। কারণ একবার কাটা চাকের মৌমাছিরা খুব বেশি হিংস্র হয়। যাইহোক এ চাকটি নিশ্চিন্তে কাটা যাবে।
বহরদারের অনুমতি নিয়ে একজন গাছে চড়েন। তারপর তিনি মৌচাকে আগুনের ধোয়া দেন। অন্যরা দা দিয়ে চাক কাটতে থাকেন। নিচে বেতের তৈরি ধামা পাতা আছে। সেখানে কাটা চাক ধরে আছেন আরেকজন।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মতই হয়। হঠাৎ করেই যেন সব এলোমেলো হয়ে যায় যখন একটা বাঘ গগনবিদারী হুংকার দিয়ে আছড়ে পড়ে। যেন এক ছবির মত সাজানো গোছানো শহর মুহূর্তের ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সবাই পাগলের মত দৌড় দিয়ে নৌকার কাছে যাবার চেষ্টা করছেন। শুধু “বাঁও বাঁচাও” আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে আর বাঘের নিষ্ঠুর গর্জন।
প্রায় সবাই তীরে ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র শের আলী বাদে। আতঙ্কে সবার দম বন্ধ হবার মত অবস্থা। অতি দ্রুত পালাতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। শের আলীর ভাইয়ের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে চরের বালিতে এবং তৃষ্ণার্ত বালি সেই নোনা জল নিমিষেই শুষে নিচ্ছে।
সবাই মাহফুজকে পরামর্শ দিলেন যে যা হবার হয়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাই মঙ্গলজনক। কিন্তু মাহফুজের মন তো মানেনা। উনি ওনার বড় ভাইকে এভাবে ফেলে কাপুরুষের মত কিভাবে যাবেন? বাড়িতে গিয়ে কিভাবে মুখ দেখাবেন? তিনি বাকী সবাইকে বললেন,
- আমি আমার ভাইকে না নিয়ে বাড়িতে যাবো না। হয় দুইজন একসাথে ফিরব নতুবা আমারও যেন ঐ বাঘের হাতে মৃত্যু হয়।
এ কথা বলে তিনি খুব দ্রুত হাঁটা শুরু করেন বনের দিকে। মাহফুজ বন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা একাকী বটগাছের মত শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন। বাকীরা একে অন্যের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। যেন সবাই কথা বলাই ভুলে গেছেন!
যে স্থানে বাঘ আক্রমন করেছে ঠিক সেইখানে গিয়ে মাহফুজ অনেক শুকনো জমাট রক্ত দেখতে পান। বৃষ্টি হবার অনেক পরে পিচ ঢালা রাস্তার উপরে যেমন স্যাঁতসেঁতে ভাব থাকে ঠিক তেমনি।
তিনি লক্ষ্য করেন যে রক্তের লাইন একটা নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে গেছে। বুঝাই যাচ্ছে যে শের আলীর দেহটা টেনে হিঁচড়ে কোনদিকে নিয়ে গেছে বাঘটা। মাহফুজ জানেন না ওনার ভাই এখনো জীবিত না মৃত। ওনার মনে ভয় যে উঁকি দিচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবুও সাহসের কাছে ভয় পরাজিত হয় যেমন করে রাতের আঁধার কালো প্রভাতের সূর্যের কাছে মাথানত করে পালায়।
মাহফুজ বালির উপরের দাগ অনুসরণ করে খুব সাবধানে এগুতে থাকেন। উনি চান না যে ওনার পায়ের আওয়াজে বাঘ সতর্ক হয়ে উঠুক। উনি মেপে মেপে পা ফেলছেন। বাঘেদের শ্রবণশক্তি কুকুরের মত অত্যন্ত তীক্ষ্ণ হয়।
অতি দূরের পাতার মর্মর ধ্বনিও খুব স্পষ্ট শুনতে পায় ওরা। অনেকক্ষণ ধরে এগুনোর পরে মাহফুজ বাঘের হালকা গর্জন শুনতে পান। ওনার হৃদয়ের ওঠানামা বেড়ে গেছে। নিজেকে একটা ঝোপের আড়ালে লুকালেন। ওখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন শের আলীর নিস্তেজ দেহটাকে।
মাহফুজ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। তার চোখের হ্রদ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরতেই থাকে। তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন যে ওনার ভাইয়ের দেহ নড়াচড়া করছে না। দেখে মনে হয় যেন একটা মরা কাঠের টুকরা পড়ে আছে।
মাহফুজ কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। আর দেরী করলে বাঘটা হয়তো তার চোখের সামনেই শের আলীর দেহটাকে খুবলে খাবে। যুদ্ধের ময়দানে একজন যোদ্ধার প্রয়োজনীয় সবকিছুই সাথে থাকে। বাঘের সাথে এ যুদ্ধে মাহফুজের সম্বল বলতে শুধুমাত্র একখানি কুড়াল।
সে মনে মনে ঠিক করল যে বাঘকে সে আঘাতটা করবে ঠিক তখনই যখন বাঘের দৃষ্টি থাকবে অন্য দিকে। মোটকথা মাহফুজ বাঘের পেছন দিক থেকে চুপিসারে এগিয়ে গিয়ে আঘাত করাটাকেই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ এবং অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে মনে করে।
মাহফুজ দেখল যে বাঘটা তার ভাইয়ের গলার পাশ থেকে গড়িয়ে পড়া তাজা রক্ত চাটছে। ওনার আর সহ্য হয় না। বাঘটির পেছন দিক দিয়ে গিয়ে গায়ের সজোরে কুড়াল দিয়ে আঘাত করেন বাঘটির পীঠে। বাঘটি আহত হয়ে মাহফুজকে পাল্টা আক্রমন করার সাহস করেনি। সে দৌড়ে বনের গহীনে এক প্রেতাত্মার মত মিলিয়ে গেল!
মাহফুজ আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কুড়ালটাকে গামছা দিয়ে গায়ের সাথে বেঁধে কোনোমতে তার ভাইয়ের পাথরের মত নিস্তেজ, শীতল দেহটাকে টানতে থাকেন। ওনাকে খুব দ্রুত লাশটি নিয়ে নদীর পাড়ে পৌঁছাতে হবে। বলা যায়না আহত বাঘ আরও বেশী হিংস্র হয়।
আবার আক্রমন করার সম্ভাবনা খুব বেশী। ঠিক তখনই বাঘের তুমুল গর্জন কানে আসে। মাহফুজ লাশটিকে টানার গতি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন। ওনার হাত-পা যেন রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ফুটবল খেলা শেষে খেলওয়াররা যেমন নিস্তেজ, শক্তিহীন বোধ করে, মাহফুজের অবস্থাও অনেকটা সেইরকম।
তিনি মনেমনে ভাবেন যে যদি একজন সঙ্গী থাকতেন ওনার সাথে তাহলে কত সুবিধাই না হত! লাশটিকে খুব সহজেই আলগে নেয়া যেত। অনেকক্ষণ টানাহেঁচড়ার পর নদীর পানির কলকল ধ্বনি কানে আসে। মাহফুজের মনটা যেন এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় গোল্ডেন A+ পাওয়া ছেলের মত আনন্দে নাচতে চায়।
মাহফুজ চর দেখতে পেলেন। মনেমনে আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া আদায় করেন। লাশটিকে পানির কাছাকাছি এনে আশেপাশে তাকালেন। ওনার সাথে আসা মৌয়ালদের চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলেন না। ওনার কেন জানি মনে হয়েছিল যে তিনি ফিরে আসা পর্যন্ত ওনারা অপেক্ষা করবেন।
কে জানে! হয়তো অপেক্ষা করে ভেবে নিয়েছেন যে মাহফুজও বাঘের হাতে মারা পড়েছে। তাই চলে গেছেন। যাইহোক মাহফুজের আর তর সইছে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা নৌকা যোগাড় করতেই হবে। সে একবার সূর্যের দিকে তাকাল।
সূর্যটাকে ঠিক একটা হলুদ ডিমের কুসুমের মত মনে হয় তার কাছে। সূর্যাস্ত হতে বেশী দেরী নেই। পাখীদের দল, যাদেরকে আকাশের অলংকার বলা হয়, তারাও নীড়ে ফিরে যাচ্ছে।
আল্লাহর অশেষ রহমতে মাহফুজ একটা নৌকা দেখতে পান। উনি ওনার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করেন,
- এই নৌকা, এই নৌকা, এই!
নৌকার মাঝি মাহফুজকে দেখে চিনতে পেরেছেন। ওনার নাম কালা মিয়া, মাহফুজের এলাকায় থাকেন। উনি নৌকা পাড়ে ভিড়িয়ে শের আলীর লাশ দেখে নির্বাক হয়ে গেলেন যেন। মুখ ফুটে কোনও শব্দ বের হয় না।
তাড়াতাড়ি লাশটিকে নৌকায় তুলে বৈঠা চালাতে শুরু করেন। মাঝি মাহফুজের করুন মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতেই পারলেন না। উনি বুঝতে পেরেছেন যে বাঘের আক্রমনেই এটা হয়েছে। তাই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা আর দিতে চান না।
বাড়ি ফিরে আসার সময় পথ যেন ছোট হয়ে গেছে। খুব দ্রুত নৌকাটি বাড়ির পাড়ে এসে ভেড়ে। মাহফুজের চোখে আর কান্না নেই। তিনি মাঝির সহায়তায় লাশটিকে ধরে বাড়ির উঠানের কাছে নিয়ে আসেন। তখন উঠান ভর্তি মানুষ। যেন এক মেলা বসেছে। সবাই ঘুরে মাহফুজকে দেখতে পায়।
ওনার পায়ের কাছেই শের আলীর নিষ্প্রাণ দেহ শুয়ে আছে, যে দেহে কিছুক্ষণ আগেও প্রাণের উচ্ছ্বাস ছিল কিন্তু এখন আর নেই। প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গিয়েছে, মুক্ত বাতাসে মিলেমিশে একাকার এখন।
সবাই একে একে দৌড়ে মাহফুজের কাছে আসছেন। বাড়ির মহিলাদের বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নার ধ্বনি যেন আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে। মাহফুজ ঠায় মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে, ওনার রক্তাক্ত কুড়ালটি তখনো কাঁধে ধরে রাখা!