সময় হাসান আর সাধনা তিথির সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে নয়, পরিবারের পছন্দ ব্যাটে বলে মিলে যাবার ফল হচ্ছে এই ঈর্ষণীয় জুটি। সময়ের বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। তার বড় ভাই বিয়ের সময় তার বাবার দায়িত্ব পালন করেছে।
সময় তার স্ত্রীকে নিয়ে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠেছে। বাসাটি সিলেটের উপশহরে অবস্থিত। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস বেশ আনন্দে কাটে। সময় সাধনাকে প্রচুর সময় দেয়। বাসায় ফেরার পর তাকে পরম ভালোবাসায় আলিঙ্গন করে যেন পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা সাধনার জন্য।
প্রায়ই গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে জাফলং-এর রাস্তায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনা, রাস্তার ধারে বসে চটপটি এবং ফুচকা খাওয়া, ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’র মত বিশেষ কোনও দিনে ভালো কোনও চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া - এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশ হয়ে গেছে।
সময়ের খুব ভালো লাগে সাধনার সাথে কথা বলতে, দুষ্টুমি করতে, রাগাতে। যখন সময় ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে থাকে তখন সে প্রতিদিন সাধনার সাথে ফোনে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা! ফেইসবুকেও চ্যাট করে, আর স্কাইপতো আছেই একজন আরেকজনকে কম্পিউটারের পর্দায় দেখে প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য।
সাধনার কাছে দুটো জিনিস খুব প্রিয়। একটা হচ্ছে চকলেট আর একটা হচ্ছে আইসক্রিম। বিদেশ থেকে সময় দেশে ফেরার পথে আর কিছু ভুলুক আর না ভুলুক, সাধনার জন্য দামী এবং মজাদার চকলেট আনা কখনই ভুলেনা।
নব দম্পতির মধ্যে ঝগড়া হয়না বললেই চলে। যারাই তাদেরকে একসাথে দেখে ভাবে তাদের জুটির মত জুটি হয়না। এতো সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে! এতো চমৎকার তাদের বোঝাপড়া!
কয়েকদিন ধরে সময়ের মেজাজটা বেশ খারাপ। একদিন সাধনা তাকে জিজ্ঞেস করে,
- কি হয়েছে?
- তেমন কিছু না।
- কি বল কিছু না! তোমাকে যে কেউ দেখলেই ভাববে কোনও এক পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে তোমার উপর।
- লক্ষ্মী বউ আমার, তোমাকে এতো চিন্তা করতে হবে না, বুঝলে।
- কি আশ্চর্য! আমি তোমার বউ না? আমি চিন্তা না করলে কে করবে শুনি?
- আরে বাবা, বললাম তো কিছু হয়নি। কি, বিশ্বাস হচ্ছে না?
- না।
- রাগ করলে নাকি, ময়না পাখি?
- হ্যাঁ।
- কেন?
- তুমি আমাকে বল কি সমস্যা। তা না হলে আমি তোমার সাথে আর কোনও কথা বলব না, বলে রাখলাম।
- তুমি দেখি একদম সিরিয়াস হয়ে গেলে!
- তার মানে বলবা না, তাইতো?
- একটু মাথা ব্যথা করছে।
- হঠাৎ মাথা ব্যথা কেন? কোনও বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করেছ নিশ্চয়ই।
- সত্যি কথা বলতে কি আমি চাইনি তুমি এটা নিয়ে আবার চিন্তায় পড়ে যাও।
- তুমি এটা বলে আমাকে ছোট করলে।
- ছোট করলাম মানে?
- তুমি এটা প্রমাণ করলে যে আমি তোমার কেউ না।
- ধেৎ! কি বল আবোলতাবোল?
- তুমি কেন আমার সাথে সব খোলামেলাভাবে আলোচনা করবেনা?
- করলাম তো?
- ছাই করেছ! ঘোড়ার ডিম করেছ!
- হা, হা, হা।
- এতবার বলার পরে লাটসাহেবের দয়া হয়েছে আমার উপর। শুকরিয়া জাঁহাপনা!
- আচ্ছা বাবা, এই তোমার মাথা ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি আমি আর কখনো এমন করব না।
- যদি কখনো তোমার প্রতিজ্ঞা ভাঙো তখন?
- তখন তুমি যে শাস্তি দেবে আমি সেটা মাথা পেতে নেব।
- মনে রেখো তুমি এইমাত্র যা বললে।
- মনে থাকবে, সত্যি।
- মাথা কি একটু টিপে দেব।
- না, না, লাগবে না।
- চুপ করে লক্ষ্মী বাচ্চার মত বসে থাকো। একটা কথাও আর শুনতে চাইনা। আমি সরিষার তেল গরম করে নিয়ে আসছি। মাথায় একটু মালিশ করলেই ম্যাজিকের মত ব্যথা গায়েব হয়ে যাবে।
- তাই নাকি?
- দেখই না কি হয়!
সাধনা পাকঘরে গিয়েছে। সময় এই ফাঁকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর টিভির রিমোট খুঁজে পেয়েছে। ঐ সময়কার কোনও অনুষ্ঠানই তার মনমত নয়। শেষপর্যন্ত টিভির সুইচ বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
ইতোমধ্যে সাধনা এসে হাজির। সে পরম মমতায় সময়ের কপালে হাত রাখে। সময়ের খুব ভালো লাগে। তার মনেহয় যেন চোখের রাজ্য জুড়ে ঘুম তার সাম্রাজ্য বিস্তার করবে!
- সময়?
- হু।
- একটা প্রশ্ন করি?
- করো।
- তোমার ব্যবসা কি ভালো যাচ্ছে না?
- ওসব তুমি বুঝবে না।
- বলই না।
- হ্যাঁ, গত কয়েকদিন ধরে একটু মন্দা যাচ্ছে।
- এতে এতো দুশ্চিন্তার কি আছে? ব্যবসায় লাভ লোকসান তো লেগেই থাকে, তাই না?
- হু।
- তাহলে এভাবে নিজের শরীরের বারোটা বাজানোর মানে কি?
- কি যে বল না তুমি?
-আমার কি চোখ নেই? আমি কি বুঝিনা? কচি খুকী পেয়েছ আমাকে?
- কি যন্ত্রণা! তোমার এসব কথায় আমার মাথা ব্যথা বেড়ে যাচ্ছে যেন।
- তাহলে এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন সবসময়? খাওয়া দাওয়াও ঠিকমত করোনা। পরে যখন বড় কোনও অসুখ শরীরে বাসা বাঁধবে তখন বুঝবে!
- তুমি আছো না? তোমাকে দেখলে অসুখ সালাম দিয়ে উলটো পথে একটা দৌড় দিবে! হা, হা, হা।
- বেশ মশকরা হচ্ছে বউয়ের সাথে, তাইনা? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!
সাধনা খুব জোরে সময়ের কান মলে দিয়ে পাকঘরে চলে যায়। সে দুহাত ভালো করে ধুয়ে বেডরুমে ফিরে দেখে সময় নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বেচারাকে দেখে খুব মায়া হয় তার। ঘুম থেকে জাগাতে আর ইচ্ছে হয়নি। রাতের খাবার শেষ করার পর সময় সাধনাকে বলে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক কাজে এক মাসের জন্য তাকে লন্ডন যেতে হবে।
- এক মাসের জন্য!
- হ্যাঁ।
- এর আগে তো কখনো এতদিনের জন্য যাওনি!
- কিছুই করার নেই।
- তোমার পক্ষ হয়ে অন্য কেউ গেলে হয় না?
- না।
- তাহলে আমাকেও নিয়ে যাও সাথে। একটা নতুন দেশ দেখা হবে আর তোমার ভালোমতো খেয়ালও রাখা যাবে।
- এবার না জান। পরেরবার অবশ্যই নিয়ে যাবো। কথা দিলাম।
- তুমি আর তোমার কথা! থাক, কখনই নিয়ে যেতে হবে না।
গভীর রাতে হঠাৎ সাধনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। জানালা খোলা। বাতাস অন্ধের মত একবার ডানে একবার বামে গিয়ে পর্দাটাকে বিরক্ত করছে যেন। ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলো যেন উপচে পড়ছে। তার একবার মনেহল সময়কে ঘুম থেকে তুলে ছাদে গিয়ে চাঁদের আলোয় স্নান করলে কেমন হয়?
মনের এ বাসনাকে গলা টিপে মেরে ফেলে তক্ষণই। সাধনার তৃষ্ণা পেয়েছে খুব। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনতে ইচ্ছে হয়নি। একটু একটু ঠাণ্ডাও অনুভব করতে থাকে সে। কে জানে, হয়তোবা বৃষ্টি হয়েছে একটু আগে। তাই বাতাস বেশ ঠাণ্ডা।
সে সময়কে জড়িয়ে ধরে শোবার জন্য পাশ ফিরে দেখে সময় বিছানায় নেই! সাধনা ভাবে সে কি স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করছে? পরমুহূর্তেই সে ভাবে যে সময় হয়তো ওয়াসরুমে গেছে।
সে আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু ঘুম আর ধরা দেয়না। তার মনেহল যে অনেক সময় পাড় হয়েছে কিন্তু সময় এখনো ফিরে আসছে না কেন? অনেক কষ্টে নিজের শরীরটাকে টেনে তুলে ওয়াসরুমে গেল। সেখানে নেই।
এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেরার পথে সময়ের কণ্ঠ কানে এসে বাজে। সাধনা প্রথমে ভাবে যে এটা তার মনের ভুল। কারণ এতো রাতে সময় কার সাথে কথা বলবে? কখনো তো এমন হয়নি?
সাধনা আরেকটু সতর্ক হয়ে শুনার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, সে নিশ্চিত যে সময় কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। তার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে বারান্দা থেকে। সাধনা মনেমনে ভাবে যে সকালে সময় ঠিকই নিজ থেকে বিষয়টা তাকে বলবে।
সে কিছু লুকাবে না বলে তাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছে। সাধনার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা আছে তার স্বামীর উপর। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতেই দু চোখে ঘুম এসে ভর করে। সকালের ঘুম ভাঙ্গানি কাকের দল যথারীতি তাদের ফাটা বাঁশের মত গলায় চেঁচিয়ে সাধনার ঘুম ভেঙ্গে দেয়। কেন জানি তার মনেহয় কাকেরা তার গভীর ঘুম নিয়ে হিংসা করে!
সময়ের লন্ডনে যাবার দিন এসে উপস্থিত। এ কয়েকদিনে একবারও সাধনা ঐ রাত্রিবেলার ফোনালাপ নিয়ে কথা বলেনি। সে নিশ্চিত ছিল যে সময় তাকে এ ব্যাপারে খোলামেলা বলবেই কিন্তু এখন পর্যন্ত বলেনি।
ছাইয়ের নিচে যেমন আগুনের লাল শিখা বেঁচে থাকে অনেকক্ষণ, সাধনার মনেও একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি চুপটি করে বসে আছে যেন। যাইহোক, সময়ের সবকিছু সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে তাকে বিদায় দিতে বিমানবন্দরে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে বিমানবন্দরের দিকে হেঁটে যাবার সময় সাধনা এবং সময়ের মধ্যে দুরত্ম ক্রমশ যতই বাড়ছে, সাধনার ততই মনে হয় এ দুরত্ম হয়তোবা চাঁদের কলঙ্কের মত চিরস্থায়ী হয়ে রবে।
তার চোখের হ্রদ থেকে পানি নিউটনের মধ্যাকর্ষন শক্তি অনুসারে নিচে মাটিকে চুমু দেয়ার জন্য অস্থির। কিন্তু গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁটে হাসির ঝলক তখনও গোধূলির মত স্থির হয়ে আছে। তার শুধুই মনে হচ্ছিল এটাই তাদের শেষ দেখা। সে সময়কে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু দুটো শব্দ বলেছে, “ভালো থেকো”।
সময়কে বিদায় দিয়ে সাধনা তার মায়ের বাসায় চলে গেছে। যাবার পথে সে খুব কেঁদেছে। কান্না যেন পাহাড়ি ঝরনা হয়ে চোখ বেয়ে অঝর ধারায় ঝরেছে। সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। এক মাস পরে সময় দেশে ফিরে আসে। সাথে দ্বিতীয় স্ত্রী।
সময় ফোনে সাধনাকে জানানোর পর ফোনের ওপাশ থেকে ভয়ার্ত আর্তনাদের সাথে ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ কানে আসে। তারপর ফোনের লাইন কেটে যায়। চারিদিক কবরস্থানের মত নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেছে যেন!