বাড়িতে মানুষ বলতে মাত্র তিনজন- অমর, তার স্ত্রী জয়া আর তাদের অতি আদরের ছয় বছরের ছোট সোনামণি বন্নি। বাড়ীটা দোতলা। নিচতলায় তারা থাকে আর উপরতলার কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি, কয়েকমাসের মধ্যে হয়ে যাবার কথা।
অমর তার ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকে দিনের প্রায় পুরোদিন। ব্যবসা মন্দ যাচ্ছেনা। বাড়ীর সামনে একটা ছোট উঠোন রয়েছে যেখানটার এক কোনায় জয়া খুব শখ করে কিছু সবজি আর কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছে। প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নেয়ার জন্য তার আগ্রহের কমতি কখনো চোখে পড়েনি।
অমর ঘুম থেকে উঠার আগেই পূজার ফুল জোগাড় করাটাও তার দৈনন্দিন আনন্দময় একটা কাজ। মাটিতে যেসব জবা পরে থাকে সেগুলো তেমন একটা ব্যবহার উপযোগী থাকেনা বলে তাকে দোতলাই উঠে জবা পেড়ে আনতে হয় কারন নিচ থেকে পাড়াটা সহজ নয়।
কিন্তু একটা সামান্য সমস্যা আছে এই কাজটায়- সেটা হল এই যে উপরের যেই অংশে জয়া দাড়িয়ে থেকে ফুল পাড়ে, সেই জায়গাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। একটু অসতর্ক হলেই নিচে পরে যাবার সম্ভাবনা।
খুব ভালই কাটছিল সংসার। কিন্তু সুখ আসলে দুঃখ আশেপাশেই ঘাপ্টি মেরে বসে থাকে। কয়েকদিন ধরে অমরকে ফোনে কেউ একজন হুমকি দিচ্ছে এই বলে যে যদি তিন দিনের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা না দেয়া হয় তবে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে। জয়া বলে,
- কেন জানি আমার খুব ভয় লাগছে!
- আরে না, ভয় পাবার কি আছে? আমাকে কি কখনও দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখেছো বলো? এসব নিয়ে আমি ভাবি না। তুমিও ভেবো না।
- আচ্ছা, থানায় একটি জিডি করে রাখলে কেমন হয়?
- আমার মনে হয় না তার কোনও প্রয়োজন আছে।
- তারপরও একটু ভেবে দেখো। করে রাখলেতো দোষের কিছু নেই তাই না?
- আচ্ছা দেখি চিন্তা করে।
অমর এসব কথায় পাত্তা কখনো দেয়নি এবং দিবেও না। সে উল্টো লোকটাকে পুলিশে দেবার কথা বলে ফোন রেখে দেয়। কিন্তু তার স্ত্রী এ ব্যাপারটা নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকে সবসময়। সে অমরকে একটু সাবধানে থাকতে বলে। অমর কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে নারাজ।
সে সবসময় জয়াকে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে। বিষয়টা নিয়ে শুধুমাত্র জয়ার বড় ভাই কার্তিকের সঙ্গে কথা বলেছে। পুলিশ আর মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলায় কে পরতে চায়? যাইহোক, অনেকদিন ধরে আর কোন হুমকিভরা ফোন আসেনি। সুখ যেন তার আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।
বাড়ি থেকে বের হবার আগে জয়ার ভেজা চুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণ নেয়া, তার কপালে চুমু খাওয়া আর অমরের বুকে হাত রেখে জয়ার বলা, “সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু”- সবই আগের মতই চলছিল জীবনের বিরামহীন চাকায় ভর করে।
একদিন সকালে হকার পেপার দিতে এসে যা দেখল তাতে তার শরীর ঠাণ্ডায় জমে যাবার মত অবস্থা। বাড়ীর উঠোনের যে জায়গায় জবা গাছটি সময়ের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে, ঠিক তার নিচে পরে আছে অমর আর জয়ার নিথর দেহ। অমরের লাশের উপর জয়ার প্রাণহীন শরীর।
জয়ার মাথার একপাশ থেথলে গেছে। হাতের রগ কাটা। অমরের কপালে খুব বড় একটা খত। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেছে ময়নাতদন্তের জন্য। এলাকাবাসী বলাবলি করছে এটা একটা দুর্ঘটনা। দোতলায় জবাফুল পাড়তে গিয়ে হয়ত পা পিছলে পরে গিয়েছে।
কার্তিক খবরটা শুনে এসে পুলিশকে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অনুরোধ করেছে। সে মনে করিয়ে দিয়েছে হুমকিভরা ফোনের কথা। অনেকদিন কেটে গেছে। পুলিশ তদন্ত করে কিছুই পায়নি। কার্তিক এবং অন্যান্য আত্মীয়রা কোনোভাবেই এটাকে মেনে নিতে পারছেনা। ওরা নিশ্চিত এটা একটা খুন। ঘটনাটা একটা রহস্য হয়েই থাকলো। জবা গাছটার যদি মুখ থাকত!