কয়েকদিন আগে শিহাবের বিয়ে হয়েছে। কনের নাম শেফালী সুলতানা। মেয়েটি স্নাতক তবে এখনও কোনও চাকরি পায়নি। শিহাবের অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও মাথাব্যথা নেই। তার কথা হচ্ছে যে বউ চাইলে চাকরি করবে না হয় করবে না।
শিহাব একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তার মা বাবা দুজনই বাড়িতে থাকেন। বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন একসময় অনেক নামকরা শিক্ষাবিদ ছিলেন। বেশ কিছু বইও লিখেছেন তিনি। মা জোহরা বেগম একজন গৃহিণী।
যেহেতু দিনের বেশীরভাগ সময় শিহাব ব্যাংকেই থাকে, তাই শেফালী বাড়িতে তার শ্বশুর শাশুড়ির খেদমতে লিপ্ত থাকে। বিয়ের প্রায় চার মাস হয়ে গেছে কিন্তু শিহাব তার বাবা মার কাছ থেকে শেফালী সম্বন্ধে কোনও নেতিবাচক মন্তব্য শোনেনি।
আসলে শেফালী সর্বগুণ সম্পন্ন একটি মেয়ে। ক্রিকেট খেলায় কোনও কোনও খেলোয়াড় যেমন অল রাউণ্ডার হয়, মানে একাধারে অনেক কাজে পটু হয়, শেফালীও বউ হিসেবে একজন অল রাউণ্ডার বটে।
ইতোমধ্যে জোহরা তার পুত্রবধূকে একটি বাচ্চা নেবার জন্য ইঙ্গিত দিয়েছে কিন্তু শেফালী এ কথা শোনা মাত্রই লাজুক লতার মত গুঁটিয়ে গেছে! শিহাব বাসায় থাকলে মা তাকে এ কথাটি সরাসরি না বললেও কথায় কথায় পাশের বাড়ির বাচ্চা ছেলে মেয়ের কথা বললেই সে বুঝতে পারে যে মা আসলে কি বোঝাতে চায়!
একরাতে শিহাব এ ব্যাপারে শেফালীর সাথে কথা বলে। শিহাব বুঝতে পারে যে এখন সে বাচ্চাকাচ্চা নেয়ার বিষয়ে মোটেও ভাবছে না। যাইহোক, বাতাসে কাগজের টুকরা উড়তে উড়তে যেমন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায়, ঠিক তেমন করেই যেন সময় গড়িয়ে যেতে থাকে।
একদিন শিহাব ব্যাংক থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তার পাশে শেফালীকে দেখতে পায়। তার সাথে আরও দুজন পুরুষ এবং মধ্যবয়সী এক মহিলা আছে। শিহাব শেফালীকে ডাকেনি। সে বাসায় চলে গেছে এই ভেবে যে শেফালী ফিরে আসলেই জানতে পারবে ঐ লোকদের সম্পর্কে।
একটু পরেই শেফালী বাসায় ফিরে আসে। শিহাব তার রুম থেকে শেফালীর গলার স্বর শুনতে পায়। সে কাজের মেয়েকে রান্নার ব্যাপারে কি যেন বলছে। ‘শেফালী’ বলে জোরে ডাকতেই রান্নাঘর থেকে ‘আসছি’ শব্দটি তার কানে ফিরে আসে। শেফালী আসতেই শিহাব জিজ্ঞেস করে,
- কোথায় গিয়েছিলে?
- কোথাও না, এই সামনেই। একটু তরকারি কিনলাম।
- আমি তোমায় দেখলাম।
- তাই?
- হ্যাঁ। তোমার সাথে আরও কয়েকজন মানুষকে দেখলাম; ওরা কারা?
- ওরা আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়। সামনের পাড়ায় ওদের কে যেন পরিচিত থাকে, তাদের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছিল। আমি তরকারি ক্রয় করছিলাম হঠাৎ রাস্তার ওপারে চোখ যেতেই তাদেরকে দেখলাম। আমি ইশারা করতেই আমার দিকে তাকালো।
- অনেক দিন পরে দেখা হল বুঝি?
- ঠিক তাই! অনেক দিন পর।
- তো বাসায় নিয়ে আসলেই পারতে।
- আমি অনেকবার বলেছি কিন্তু ওরা এখন আসতে পারবে না। বললাম না ওদের পরিচিত অন্য একজনের বাসায় যাচ্ছিল। তবে আমি আমার বাসা চিনিয়ে দিলাম। ওরা কথা দিল যে একদিন অবশ্যই আসবে।
- আচ্ছা ঠিক আছে লক্ষ্মী বউ আমার। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে! তাড়াতাড়ি কিছু খাবার দাবার নিয়ে এসো; বড্ড ক্ষুধা লেগেছে!
- ঠিক আছে আমার আদরের স্বামী! তুমি কয়েক মিনিট অপেক্ষা কর; আমি বিদ্যুতের বেগে যাব এবং আলাদীনের দৈত্যের মত তোমার জন্য সুস্বাদু খাবার নিয়ে আসব!
সুখ নামক পাখীকে সবাই ধরতে চায়। সুখ যেন আকাশের ঐ চাঁদ যাকে হাতে নিয়ে আদর সোহাগে ভরিয়ে দিতে সবার কত না বাসনা! শিহাব এবং শেফালীর সংসারে সেই হীরার মত দুর্লভ সুখ বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে ছুটির দিনে শিহাব যখন বাসায় একা থাকে, তখন কোনও এক অজানা শঙ্কা যেন তার উপর পেত্নীর মত ভর করে! তার শুধু মনে হয় যদি সুনামির মত অজানা, রহস্যময় কোনও শক্তির আঘাতে যদি তার সুখের সংসার কুয়াশার মত মিলিয়ে যায়!
বেশ কয়েকদিন পর শিহাব ঘুম থেকে উঠে দেখে দুপুর তিনটা বাজে! শেফালীর নাম ধরে অনেকবার ডাকাডাকির পরও যখন কোনও সাড়াশব্দ নেই তখন সে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা রাখতেই তার সারা শরীর কেমন যেন দুলে ওঠে। সে সোজাসুজি হাঁটতে চাচ্ছে কিন্তু মাতালের মত এক পা এদিক তো আরেক পা অন্যদিকে ফেলছে!
কোনোমতে দেয়াল ঘেঁসে ঘেঁসে শরীরটাকে পাকঘরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে শেফালী বা মা কাউকেই দেখতে পায়না। পরে শিহাব মা মা বলে চেঁচাতে থাকে কিন্তু মায়ের রুম থেকেও কোনও শব্দ কানে আসে না।
অনেক কষ্টে শিহাব মায়ের রুমে গিয়ে দেখে যে সেখানে খাটের উপর মা এবং বাবা তখনও মরার মত পড়ে আছেন! একদম কাছে গিয়ে মা মা বলে ডেকেও কোনও কাজ হয় না! ঠিক সেই মুহূর্তে শিহাবের সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে! সে তার অজান্তেই বাচ্চার মত কেঁদে ওঠে। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বুদ্ধি করে মা এবং বাবার নিঃশ্বাসটা চেক করে দেখে যে তারা জীবিত আছেন।
সেই মুহূর্তে শিহাব কি ঘটেছে বা কি করবে এই চিন্তা করতে করতেই হঠাৎ তার চোখ গিয়ে পড়ে মায়ের আলমারির উপর। আলমারি খোলা, ভেতরের সবকিছু বাইরে এলোমেলো করে ফেলে রাখা। যেন কোনও বাচ্চা রাগ করে সবকিছু তছনছ করেছে।
শিহাব কাছে গিয়ে দেখে যে টাকা পয়সা এবং গহনা গাটি যা ছিল সব গায়েব! আলমারিতে মূল্যবান কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন শিহাবের আর বুঝতে বাকি রইল না যে শেফালীই এই অঘটন ঘটিয়েছে। বিয়ের নাম করে সে তার পরিবারের সবকিছু লুটে নিয়ে গেছে। এতো বেলা করে ঘুম ভাঙার কারণটাও এখন শিহাবের কাছে দিনের আলোর মত পরিস্কার! নিশ্চয়ই রাতে খাবারের সাথে কোনও না কোনও ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে ঐ ধোঁকাবাজ।
থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এসে সবকিছু তদারক করছে। শিহাবের মোবাইলে শেফালীর যে ছবি ছিল সেটা পুলিশ নিয়ে গেছে। তাছাড়া বিয়ের সময় শেফালীর পক্ষ থেকে যে বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানার উল্লেখ করা হয়েছিল সেসব জায়গায়ও চিরুনি অভিযান চালানো হয়েছে কিন্তু বলাই বাহুল্য যে সেসব ঠিকানা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ময়লার মতই মূল্যহীন। শিহাবের দৃঢ় বিশ্বাস মনে যে একদিন না একদিন সেই ধোঁকাবাজ ধরা পড়বেই। সে আল্লাহ্র অশেষ শুকরিয়া আদায় করে এই ভেবে যে তার বাবা মা এবং সে সহি সালামতে আছে।
ওদিকে শেফালী তার দলবল নিয়ে অন্য জেলায় চলে গেছে। কারণ একই স্থানে বেশী দিন অবস্থান করলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাবার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এখন তারা আরেকটি নিরপরাধ এবং সহজ সরল পরিবারকে টার্গেট করে কিভাবে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়া যায় এবং ফকিরের মত পথে বসানো যায় সেই নীলনকশা আঁকায় ব্যস্ত!